মঙ্গলবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

সংগ্রামে সাফল্যে ৪৩ বর্ষে বিএনপি

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর

সংগ্রামে সাফল্যে ৪৩ বর্ষে বিএনপি

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির ৪২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ৪২ বছর অতিক্রম করেছে বাংলাদেশের জনপ্রিয় এই রাজনৈতিক দলটি। বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তক এবং একটি অগ্রসর, সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী দর্শনের ওপর ভিত্তি করে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। এ দল তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশে তৎকালীন রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ করে একটি সুসংহত রাজনৈতিক কাঠামো, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, সামাজিক ন্যায়বিচারের ওপর ভিত্তি করে একটি সমাজব্যবস্থা নির্মাণের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। বিভক্ত একটি সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে সদ্যস্বাধীনতা অর্জিত যুদ্ধবিধ্বস্ত, দুঃশাসন, হতাশাগ্রস্ত একটি জাতিকে আশার আলো দেখিয়ে ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সংঘবদ্ধ করার কাজে মনোনিবেশ করে। কাজটি অত্যন্ত দুরূহ ছিল।

একদিকে বাম অন্যদিকে ডান, একদিকে ধর্মীয় রাজনৈতিক প্রভাব অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা এসব ভিন্নমুখী চিন্তা-চেতনার মানুষ ও জাতিকে একটা প্ল্যাটফরমে নিয়ে এসে ন্যূনতম বিষয়গুলোয় ঐক্য সৃষ্টি করে রাষ্ট্র নির্মাণের কাজ শুরু করার কাজটি সত্যই অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ছিল। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার দূরদৃষ্টি, প্রজ্ঞা, অসাধারণ মেধা, অধ্যবসায় এবং দেশপ্রেম সে অসাধ্যকে সাধন করে। বিএনপি প্রকৃত পক্ষেই একটি উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলে পরিণত হওয়ার কাজ শুরু করে। এ দেশের মানুষের দেশপ্রেম, স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা, পরিশ্রম এ কাজটিকে সহজ করে তোলে; যার ফলে শহীদ জিয়া দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা এবং বিএনপি সবচেয়ে জনপ্রিয় দলে পরিণত হয়।

১৯৭৫-এর বিয়োগান্ত পট-পরিবর্তনের পরে শহীদ জিয়া রাজনৈতিক দৃশ্যপটে আবির্ভূত না হলে বাংলাদেশের পরিণতি কী হতো এ সম্পর্কে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম লিখেছেন, It’s hard to imagine what would have happened to Bangladesh had Ziaur Rahman been assassinated in 1975 instead of 1981. A failed state on the model of Afghanistan or Liberia might well have resulted. Zia saved Bangladesh from that fate.

বাংলায় তরজমা করলে- ‘এটা ভাবা বেশ কষ্টসাধ্য যদি জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালে নিহত না হয়ে ’৭৫ সালে নিহত হতেন তবে বাংলাদেশের ভাগ্যে কী ঘটত; আফগানিস্তান অথবা লাইবেরিয়ার মতো একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতো। জিয়া বাংলাদেশকে সেই ভাগ্যবরণ করা থেকে রক্ষা করেছিলেন।’

‘যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের Politics and Governance বিভাগের অধ্যাপক মারকান ফ্রান্ডা জিয়াউর রহমান সম্পর্কে বলেছিলেন, Ziaur Rahman is a historic figure in Bangladesh, in part because he has established the nation’s first effective government, but primarily because of his efforts to build institutions that can carry forward a new concept of Bangladeshi nationalism. Zia wants people to be enthusiastic about building up the country. He wants them to be vigilant and prepared to resist, militarily if necessary, pressures from outside. He wants people to have confidence that that they can grow things themselves, without relying on foreigners. He wants them to have pride in their religion, and to have no problems with the minority communities.

‘জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। কিছুটা এজন্য যে, বাংলাদেশে তিনি প্রথম একটি কার্যকর সরকার গঠন করেছিলেন, প্রাথমিকভাবে এজন্য যে, তিনি তাঁর নতুন চিন্তা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের দর্শনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্মাণ করতে শুরু করেছিলেন। জিয়া জনগণকে রাষ্ট্র বিনির্মাণের কাজে উৎসাহসহকারে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি দেশের বাইরে থেকে যে কোনো সামরিক হামলা প্রতিহত করার জন্য জনগণকে তৈরি থাকতে বলেন। জনগণকে নিজেদের পণ্য নিজেরাই উৎপাদন করার জন্য অনুপ্রাণিত করেন, বিদেশের দিকে তাকিয়ে না থেকে। নিজ ধর্মের জন্য গর্ববোধ করে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষার আহ্বান জানান।’

প্রকৃতপক্ষে জিয়াউর রহমানের সুযোগ্য নেতৃত্বের কারণেই বাংলাদেশ ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে উঠতে থাকে। হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলতে শুরু করে। একদলীয় শাসনব্যবস্থা থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা, অর্থনীতির রুদ্ধদ্বার খুলে দিয়ে মিশ্র অর্থনীতি ও মুক্তবাজার অর্থনীতির সূচনা, নতুন উদ্যোক্তা, নতুন বিনিয়োগ, উৎপাদনের নতুন কর্মযজ্ঞ শুরু করে। কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বাংলাদেশের জন্য অপার সম্ভাবনার সুযোগ সৃষ্টি করে। বিএনপিকে সে কর্মযজ্ঞের চালিকাশক্তি হিসেবেই জনগণকে তৈরি করতে শুরু করেছিলেন।

বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের দর্শন মানুষকে তার স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য, ঐতিহ্য, কৃষ্টি-জীবন বোধ, ধর্মীয় বোধ রাষ্ট্রচিন্তায় মাথা তুলে দাঁড়াবার শক্তি জোগায়। সামনে বহুদূর এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখায়। বিশ্বরাজনীতিতে শহীদ জিয়া ও বাংলাদেশের নাম মর্যাদার সঙ্গে উচ্চারিত হতে থাকে। বিএনপির শুভ সূচনা এখান থেকেই। বিএনপির শক্তির উৎস স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুসংহত করার আকাক্সক্ষা থেকে উৎসারিত হয়। আর সেজন্যই বিএনপি এত জনপ্রিয়। মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিচ্ছবি বিএনপির রাজনীতির মধ্যে দেখতে পায়।

খাল খনন কর্মসূচি, উন্নত প্রযুক্তি, বর্ধিত উৎপাদন, গণশিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, গ্রাম সরকার, ১৯ দফা কর্মসূচি, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মূল্যবোধ বাংলাদেশের জনগণকে নতুন স্বপ্ন দেখায়। তাদের রাজনৈতিক মুক্তি এবং অর্থনৈতিক মুক্তির পথ দেখতে পায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের মানুষের, এই মহান নেতার নেতৃত্ব বেশি দিন পাওয়া যায়নি। শহীদ জিয়ার শাহাদাতের পর মানিক মিয়া এভিনিউতে যে নজিরবিহীন লাখ লাখ মানুষের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাধীনতাকামী, গণতন্ত্রকামী মানুষ যে ছুটে এসেছিল তাদের প্রিয় নেতাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে- তাতেই প্রতীয়মাণ হয় তিনি কতটা জনপ্রিয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রুদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তে শহীদ জিয়াকে হত্যার মধ্য দিয়ে জনগণকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল। কিন্তু শহীদ জিয়া জনগণের হৃদয় থেকে উৎসারিত ভালোবাসা এবং মাটির যে দর্শন দিয়েছিলেন সে দর্শনের শক্তিতে বিএনপি প্রকৃতপক্ষেই একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে যায়। যদিও দেশি-বিদেশি চক্র ক্ষমতায় সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ ও ক্রীড়নক সরকারকে অধিষ্ঠিত করে তবু রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ, সমভিজ্ঞ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপিকে জনগণের কাছে নিয়ে পৌঁছায়।

বেগম জিয়া স্বাধীনতার পতাকা নিয়ে সারা দেশের গ্রামে-গঞ্জে, পথে-প্রান্তরে, স্বাধীনতার পক্ষে গণতন্ত্রের গান গেয়ে বিএনপিকে একেবারে মাটির কাছে নিয়ে যান। দীর্ঘ নয় বছর স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই ও সংগ্রাম বিএনপিকে জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য, আস্থাশীল, সক্রিয় কার্যকর রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। বিএনপি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। ১৯৯০-এ স্বৈরাচার পতন এবং ’৯১-এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা, রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে। ১৯৯১-৯৬-এর খালেদা জিয়া সরকার জনগণের কল্যাণে মৌলিক পরিবর্তন আনে। বেগম খালেদা জিয়া প্রকৃতই একজন ক্যারিশমাটিক দেশনেত্রীতে অভিষিক্ত হন। ইতিহাসে তাঁর স্থান সুনির্দিষ্ট।

রাষ্ট্রপতির শাসনব্যবস্থা থেকে সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়ে আসা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে এর উৎকর্য সাধন বিবিসি, রয়টার্স, সিএনএনসহ অনেক বিদেশি সংবাদ চ্যানেল খুলে দেওয়া, পোশাকশিল্পের প্রণোদনা বৃদ্ধি, কৃষি ক্ষেত্রে ন্যায্য মূল্যে উপকরণ প্রাপ্তি সহজ করা, কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা, প্রবাসে শ্রমিকদের কর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়নের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ সুবিধা সৃষ্টি- সর্বোপরি সুশাসন প্রতিষ্ঠা বেগম খালেদা জিয়ার ১৯৯১-৯৬ সরকারকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। বিএনপি দল হিসেবে আরও সংগঠিত এবং জনপ্রিয় হয়। ’৯৫ সাল থেকে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি অশুভ আঁতাত করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৭৩ দিন হরতাল-অবরোধ করে অচলাবস্থার সৃষ্টি করে।

বিএনপি জনমতকে মর্যাদা দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধান, সংবিধানে সন্বিবেশিত করে এবং পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন ঘোষণা করে। এটাও গণতন্ত্রের ইতিহাসে একটা নতুন নজির। দেশের কল্যাণের জন্য সাংবিধানিক ধারা অব্যাহত রেখে জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটু ইতিবাচক নতুন অধ্যায় শুরু করে। গণতন্ত্রচর্চার পটভূমি তৈরি হয়। পরবর্তী নির্বাচনগুলোয় হানাহানি ছাড়াই অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি ১১৬টি আসন নিয়ে বাংলাদেশের পার্লামেন্টারি ইতিহাসে সর্ববৃহৎ বিরোধী দল গঠন করে এবং সহনশীল গণতান্ত্রিক রাজনীতির সংস্কৃতির সূচনা হয়। এটা নিঃসন্দেহে বিএনপির ইতিবাচক রাজনীতির পরিচায়ক। এরপর দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট দুই তৃতীয়াংশ আসনে জয়লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।

দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচত হন। একজন নারী রাজনৈতিক নেতার জন্য এটা একটা বিরল সম্মান। বিএনপি সরকার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার নিয়ে আসে। বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়। পোশাকশিল্পের প্রসার, বিদেশে শ্রমিক কর্মসংস্থান ব্যাপক বৃদ্ধি, অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য গতি সঞ্চার করে এবং প্রবৃদ্ধি ৭-এর ঘরে উঠে আসে। এ অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে উঠে আসার ভিত্তি তৈরি করে দেয়। আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বিভিন্ন রিপোর্টে বাংলাদেশকে এশিয়ার উদীয়মান বাঘ হিসেবে চিহ্নিত করে।

আর সেটাই কাল হয়ে দাঁড়ায়। বিএনপি সরকারকে বিভিন্নভাবে বিপদগ্রস্ত করার চক্রান্ত শুরু হয় দেশি-বিদেশি কুশীলবদের। ২০০৫ সাল থেকে দেশে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টির ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ২০০৭ সালে সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সরিয়ে দিয়ে তথাকথিত সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিন অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে দুই বছর বেআইনিভাবে শাসন করে এবং বাংলাদেশকে বিরাজনৈতিকীকরণের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রধান দুই দলের নেত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে অন্তরিন করা হয়। মাইনাস টু থিওরি কার্যকরের প্রচেষ্টা শুরু করে।

আওয়ামী লীগ আপস করলেও দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কোনো আপস করেননি। তাঁর অনমনীয় দৃঢ় মনোভাবের কারণে সরকার বাধ্য হয়ে দুই নেত্রীকে মুক্তি দিয়ে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করলেও বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে বিএনপি নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার, হয়রানি, মিথ্যা মামলার কারণে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও নির্বাচনে যেতে হয়। নির্বাচনে পরিকল্পনা অনুযায়ী বিএনপিকে মাত্র ২৯টি আসন দিয়ে বিরোধী দলের আসনে বসতে বাধ্য করে। এরপর আদালতকে ব্যবহার করে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে পুনরায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হয় এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ রুদ্ধ করা হয় এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অনিশ্চয়তা ও জাতিকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়।

বিএনপি এ বিষয়ে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ২০-দলীয় জোট গঠনের মাধ্যমে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের আন্দোলন শুরু করে। শেষ পর্যন্ত ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলো এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। ১৫৪ জন প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করে পার্লামেন্ট গঠন করে সরকারি দল। সে নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য না হলে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকে।

এর পরের ইতিহাসও সবার জানা। বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপির বিরুদ্ধে দমন-পীড়নের স্টিম রোলার চলতে থাকে। দলের চেয়ারপারসন থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ কাউকেই মামলা থেকে রেহাই দেওয়া হয়নি। বিশেষ করে ২০১৫ সালে এ নির্যাতন চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার, হয়রানি, সাজা দেওয়া হয়। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১ লাখ মামলায় আসামির সংখ্যা প্রায় ৩৫ লাখে পৌঁছায়। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে কারাগারে নেওয়া হয়।

দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও গণতন্ত্র মুক্তির আন্দোলনে সারা দেশে অসংখ্য নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, অত্যাচার-নির্যাতন চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। দলের নেতৃত্বের দায়িত্ব গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বিদেশে অবস্থানরত সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ওপর ন্যস্ত হয়। শহীদ জিয়া ও গণতন্ত্রের আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান বিদেশে অবস্থান করেও তার অসাধারণ সাংগঠনিক যোগ্যতা ও মেধা দিয়ে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে সক্ষম হন। তার নেতৃত্বে বিএনপিতে নতুন গতির সঞ্চার হয়। বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার জন্য বিএনপি গণফোরাম, জাসদ, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, নাগরিক ঐক্য ও বিকল্পধারার একটি অংশ নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে, দেশনেত্রীর মুক্তি এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দল ধানের শীষের প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেয়।

সে নির্বাচন কীভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে রাতের আঁধারে প্রহসনে পরিণত করে এবং গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয় তা সবাই পর্যবেক্ষণ করেছেন। দেশনেত্রী বন্দী, অসুস্থ, ছয় মাস সাজা স্থগিত করার কারণে বাসায় অবস্থান করছেন। রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে তাঁকে বিরত রাখা হয়েছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘ এক যুগ বিদেশে নির্বাসিত-জীবন যাপন করছেন। তার নেতৃত্বে সিনিয়র নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে তৃণমূল নেতারা অসংখ্য মামলা মাথায় নিয়ে দলকে সচল রাখার জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করছেন।

সব বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে, সব নির্যাতন, দমন-পীড়ন জয় করে বিএনপি অতীতে যেমন ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তেমনি এখনো জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করে গণতন্ত্রের প্রতীক দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করবে এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের পার্লামেন্ট গঠন করবে এবং গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবে। ৪২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এটাই বিএনপির লাখো কোটি নেতা-কর্মী ও সমর্থকের শপথ। অন্ধকারের পর অবশ্যই নতুন সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হবে সংগ্রামী মানুষের জনপদ বাংলাদেশ।

লেখক : মহাসচিব, জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি।

সর্বশেষ খবর