শিরোনাম
বুধবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

প্যারোলবিহীন যাবজ্জীবন, নির্বিকার ট্যারেন্ট ও কিছু প্রশ্ন...

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন

প্যারোলবিহীন যাবজ্জীবন, নির্বিকার ট্যারেন্ট ও কিছু প্রশ্ন...

ব্রেন্টন ট্যারেন্টকে শেষাবধি প্যারোলবিহীন যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করা হলো। দন্ড বিষয়ে চার দিনের শুনানি শেষে নিউজিল্যান্ডের আদালত এ শাস্তি প্রদান করে। নিউজিল্যান্ডের দন্ড আইনে এটিই সর্বোচ্চ শাস্তি এবং নিউজিল্যান্ডের সাম্প্রতিক ইতিহাসে ট্যারেন্টই সেই ব্যক্তি যাকে এ সর্বোচ্চ দন্ডে দন্ডিত করা হলো। উল্লেখ্য, নিউজিল্যান্ডের আইনে মৃত্যুদন্ড নেই এবং যাবজ্জীবন কারাদন্ডই নিউজিল্যান্ডের সর্বোচ্চ শাস্তি। ১৯৬১ সালে নিউজিল্যান্ডে মৃত্যুদন্ড রদ করে দেওয়া হয়।

২০১৯ সালের ১৫ মার্চ ২৯ বছর বয়সী অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক ব্রেন্টন ট্যারেন্ট নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ৫১ জনকে হত্যা করেন, হামলায় গুলিবিদ্ধ ও আহত হন কয়েকজন। জুনে নিউজিল্যান্ডের হাই কোর্টে ট্যারেন্টের বিরুদ্ধে ৫১ জনকে হত্যা, ৪০ জনকে হত্যাচেষ্টা ও একটি সন্ত্রাসী হামলা চালানোর অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। ভার্চুয়াল শুনানির সময় ট্যারেন্টের আইনজীবী তাঁর পক্ষ থেকে অভিযোগগুলো অস্বীকার করেন, যদিও  এ বছরের ২৬ মার্চ ট্যারেন্ট তার আগের অবস্থান পরিবর্তন করে তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ স্বীকার করে নেন। গত ২৪ আগস্ট শুরু হয় চার দিনের ‘সেনটেন্সিং হিয়ারিং’, ২৭ আগস্ট ট্যারেন্টের দ- ঘোষিত হয়।

দন্ড ঘোষণার সময় বিচারক ক্যামেরন মান্ডের আদালতে ট্যারেন্টকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনার অপরাধ এতটাই জঘন্য যে আপনাকে মৃত্যু পর্যন্ত কারাগারে বন্দী করে রাখলেও শাস্তির প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যাবে না।’ ট্যারেন্টের মতো নৃশংস অপরাধীদের জন্যই নিউজিল্যান্ডের আইনে প্যারোলবিহীন যাবজ্জীবনের বিধান রাখা হয়েছে। কেননা, হত্যাকান্ডের মতো অপরাধের জন্য হত্যাকারীকে (অথবা হত্যাকারীদের) ১০ বছরের প্যারোলসহ যাবজ্জীবন বা ১৭ বছরের প্যারোলসহ যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করা হয়। প্রথম দন্ডের ক্ষেত্রে অপরাধী ১০ বছর পরে এবং দ্বিতীয় দন্ডের ক্ষেত্রে ১৭ বছর পরে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু ট্যারেন্টকে যে দন্ড দেওয়া হয়েছে, তাতে তিনি কোনো দিনই কারাগার থেকে বেরোতে পারবেন না। অর্থাৎ তাকে আমৃত্যু কারাগারে থাকতে হবে।

ট্যারেন্টের মতো ‘ঠান্ডা মাথা’র নৃশংস ও বর্ণবাদী সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে নিউজিল্যান্ডের সব ধর্ম বর্ণ গোত্রের নাগরিককে নিরাপদ রাখার জন্য নিউজিল্যান্ডের আইনে এত কঠোর দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। উল্লেখ্য, দন্ড, দন্ডনীতি, দন্ডের চূড়ান্ত লক্ষ্য ইত্যাদি বিষয় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলোয় নরওয়ে, সুইডেন, নিউজিল্যান্ডের চেয়ে অনেক আলাদা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর দন্ড আইন ও ফৌজদারি ন্যায়বিচার ব্যবস্থা এখনো ‘অপরাধ-প্রতিশোধ’, ‘অপরাধ-শাস্তি’- এসবের মধ্যেই আটকে আছে। কিন্তু নরওয়ে, সুইডেন, নিউজিল্যান্ডসহ পশ্চিম ইউরোপ ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান রাষ্ট্রগুলোর দন্ড আইন, দন্ডনীতি ও ফৌজদারি ন্যায়বিচার ব্যবস্থা ‘অপরাধ-প্রতিশোধ-শাস্তি’র স্তর থেকে ‘অপরাধ-সংশোধন ও পুনর্বাসন’-এ রূপান্তরিত ও উন্নীত হয়েছে।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা দেড় শ বছর আগে যে ‘পেনোলজি ও পানিশমেন্টে’র ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন, আমরা এখনো সে বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছি; অথচ ব্রিটেনসহ উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলো তাদের দেশের ফৌজদারি ন্যায়বিচার ব্যবস্থাকে ‘রিফরমেটিভ জাস্টিস’ বা সংশোধন ও পুনর্বাসনকেন্দ্রিক নীতিমালার ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তার মানে এই নয় যে, উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় অপরাধীদের শাস্তি দেওয়া হয় না বা যে শাস্তি দেওয়া হয় তা অপর্যাপ্ত বা লঘু। ওসব দেশে যা করা হয় তা হচ্ছে, যে কোনো অপরাধে সংশোধনের সুযোগ থাকলে কারাগারে না পাঠিয়ে অপরাধীকে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হয়। সুযোগ দেওয়ার পরও সংশোধিত না হলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। শারীরিক বা মানসিক ত্রুটি বা নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থার কারণে কেউ অপরাধ করলে তাকে ডাক্তার বা মনোচিকিৎসকের কাছে পাঠানো হয় চিকিৎসার জন্য। আবার সিরিয়াল কিলিং ও মাস কিলিংয়ের বিষয়কেও তারা যথেষ্ট গুরুত্ব দেন এবং বিচারের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করেন। যেমন নরওয়ের মাস কিলার ব্রেইভিক, যিনি ২০১১ সালে ৭৭ যুবক ও যুবতীকে হত্যা করেছিলেন, সেই ব্রেইভিককে এ হত্যাকা-গুলোর জন্য ২৩ বছরের কারাদ- দেওয়া হয়, যেটি নরওয়ের দ- আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি। ট্যারেন্টের ক্ষেত্রেও ৫১ জনকে হত্যার জন্য তাকে নিউজিল্যান্ডের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ট্যারেন্ট ও ব্রেইভিককে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কারাগারেই কাটাতে হবে। এ ছাড়া নৃশংস মাস কিলারদের হাত থেকে সমাজের মানুষকে নিরাপদ রাখার আর কোনো উপায় নেই। ট্যারেন্টের দন্ড শোনার পর নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন বলেন, ‘তার মানে, এখন থেকে আমাদের আর তাকে (ট্যারেন্ট) নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, তাকে দেখেতে হবে না এবং তার কথা আর শুনতে হবে না।’ অর্থাৎ এ রকম ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীর কাছ থেকে নিউজিল্যান্ডের সমাজ নিরাপদ। আগেই উল্লেখ করেছি, পূর্বনির্ধারিত ২৪ আগস্ট থেকে ট্যারেন্টকে কী দন্ড দেওয়া হবে, সে-বিষয়ক শুনানি শুরু হয়। শুনানির চতুর্থ দিনে বিচারক মান্ডের ১ ঘণ্টা ব্যয় করেন ট্যারেন্ট কীভাবে গুলি করে মসজিদে নামাজ আদায়রত মুসল্লিদের হত্যা করেছিলেন, তা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, দোষ স্বীকার করার পরও নিষ্ঠুর ওই হত্যাকান্ডগুলোর ব্যাপারে ট্যারেন্টকে অনুতপ্ত বা লজ্জিত হতে দেখা যায়নি। ট্যারেন্ট তার আইনজীবীর মাধ্যমে আগেই জানিয়ে দেন, প্যারোলবিহীন যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিরোধিতা তিনি করবেন না। ফলে দন্ড ঘোষণার পর তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি।

চার দিনব্যাপী শুনানির প্রথম তিন দিন কেটে যায় হত্যাকান্ডের শিকার ব্যক্তিবর্গের আত্মীয়স্বজন ও আহতদের বিলাপ, আহাজারি ও মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার বর্ণনার মধ্য দিয়ে। প্রায় ৯০ জন দুর্ভাগ্যপীড়িত ব্যক্তির ক্রন্দন, আর্তচিৎকার ও দুঃস্বপ্ন-অভিজ্ঞতা বর্ণনার সময় ট্যারেন্ট ছিলেন নির্বিকার।

ট্যারেন্ট কর্তৃক ৫১ মুসল্লিকে হত্যা এবং দোষ স্বীকার ও দন্ডের পরও তার অনুতপ্ত না হওয়া আমাদের এক কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আর বারবার আমাদের এই নিষ্ঠুর ও রূঢ় সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হচ্ছে। জার্মানির নাজি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিমলার, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বাংলাদেশি সহযোগীরা এবং ব্রেইভিক সেই রূঢ় বাস্তবতার সত্যায়নকারী। মানুষের ইতিহাসে হিমলার, ব্রেইভিক, ট্যারেন্টরা শত শত হত্যা করেও থেকেছেন নির্বিকার ও অনুশোচনাহীন। তারা মনে করেন, উগ্র আদর্শ, জাতীয়তা, ধর্ম ও বর্ণবাদের জন্য মানুষ হত্যা জায়েজ! নাজি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিমলার বলেছিলেন, ‘যেহেতু ইহুদিরা জার্মান জাতির জন্য অস্তিত্বের সংকট তৈরি করেছে, ফলে ইহুদিদের হত্যা করার নৈতিক অধিকার জার্মান জাতির আছে।’ হিটলার, হিমলার ও তাদের নেতৃত্বে নাজি বাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লাখ লাখ ইহুদিকে হত্যা করেছেন এবং এ হত্যাকা-গুলোকে তারা মনে করতেন ‘জাস্টিফাইড’।

১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের বাংলাদেশি দোসররা ধর্মের নামে পাকিস্তান রাষ্ট্র রক্ষার জন্য লাখ লাখ মানুষ হত্যা করেছিল। মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদ- দেওয়ার পরও কাদের মোল্লাদের আমরা ‘ভি’ চিহ্ন দেখিয়ে আলাদত প্রাঙ্গণ ত্যাগ করতে দেখেছি। মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়ার পরও নিজামী, মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সমর্থকরা এখন তাদের শহীদ বলে অভিহিত করেন। ৭৭ জনের হত্যাকারী ব্রেইভিক প্রকাশ্য আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছেন, নরওয়েকে মুসলমান ও কমিউনিস্টদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি হত্যাকান্ডগুলো করেছেন, এজন্য তার কোনো অনুতাপ নেই। ব্রেইভিক অনলাইনে প্রায় ১৬০০ পৃষ্ঠার একটি মেনিফেস্টো প্রকাশ করেছিলেন। ট্যারেন্ট প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন ব্রেইভিকের উগ্র মতবাদ দ্বারা এবং ব্রেইভিকের মতো তিনিও ৭৪ পৃষ্ঠার একটি মেনিফেস্টো প্রকাশ করেছিলেন। সবচেয়ে আতঙ্কিত হওয়ার মতো বিষয় হচ্ছে, ৭৭ জনকে হত্যার পরও ব্রেইভিকের মধ্যে কোনো অনুশোচনা ছিল না; ৫১ জনকে হত্যার পরও ট্যারেন্ট নির্বিকার, তার মধ্যে দেখা যায়নি কোনো অনুতাপ। ব্রেইভিক, ট্যারেন্ট, হিমলার, কাদের মোল্লা, নিজামী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীরা মনে করেন, তারা ‘সঠিক কারণে’ ও ‘সঠিক আদর্শে’র জন্য বিরুদ্ধবাদীদের হত্যা করেছেন। এজন্য তারা অনুতপ্ত নন। এই যে ‘নর্মেটিভ’ কারণে হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষের হত্যাকান্ড, সেটিই মানবসমাজ ও মানুষের সভ্যতার সবচেয়ে বড় সংকট।

            লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক

ও অপরাধ বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর