শনিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

গণতন্ত্রে জন-আকাক্সক্ষার প্রকাশ ঘটে

অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ, এমপি

গণতন্ত্রে জন-আকাক্সক্ষার প্রকাশ ঘটে

মানবসভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে গণতন্ত্র। পাশ্চাত্যে সূচনা হলেও পৃথিবীর সর্বত্রই এর বিকাশ ঘটেছে। বর্তমানে গণতন্ত্রের বিকাশ কেবল রাষ্ট্র পরিচালনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই বরং মানবসভ্যতার সামাজিক, সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় এর প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই। গণতন্ত্রের মাধ্যমে মানুষ তথা জনগণ তার নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে যথার্থ অর্থে জনগণের মধ্য থেকে এবং জনগণের দ্বারা জনগণের জন্য সরকারই হচ্ছে গণতান্ত্রিক সরকার। গণতন্ত্র ভালো কি মন্দ এ তুলনায় গেলে এর ভালো দিকটিই বেশি সমাদৃত হয়। গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের আকর্ষণের অনেক কারণ আছে। গণতন্ত্র শাসনকাঠামোয় জনমানুষের স্থান আছে এবং তাদের প্রতিনিধিত্বের বক্তব্য আছে। শাসিতের কাছে শাসকশ্রেণি দায়িত্বশীল, সংবেদনশীল ও দায়বদ্ধ থাকে। তাতে আইনের শাসন, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি থাকে। গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থায় জবাবদিহির গুরুত্ব অপরিসীম। জবাবদিহিবিহীন সমাজে স্বৈরাচারী, অনৈতিকতা, একচ্ছত্র প্রভুত্ববাদী, দুর্নীতির শিকড় গেড়ে বসে। আমলারা লাগামহীন ক্ষমতার চর্চা করেন। জবাবদিহি ব্যবস্থা মজবুত হলে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন ঘটে, সুশাসন নিশ্চিত হয়। জনগণই যে সব ক্ষমতার উৎস- এ ধারণাটি বাস্তব বলে বিবেচিত হয়। সরকার তথা নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলে জনগণের মৌলিক চাহিদাবলি মেটানোয় সরকার সচেষ্ট থাকে। দুর্নীতি, অরাজকতা, অস্বচ্ছতা, অনৈতিকতা স্থান পায় না। জনগণের অর্থের সঠিক ও কল্যাণমূলক ব্যবহার নিশ্চিত হয়। জনগণ সব সময়ই জানতে পারে কী করছে। অর্থাৎ সরকার ইচ্ছা করলেই স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পারে না।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা : রাষ্ট্র পরিচালনায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকার গঠনের দুটি পদ্ধতি চালু রয়েছে- ১. রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকার : যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, শ্রীলঙ্কা। রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত থাকলেও সেখানে জনগণের নির্বাচিত আইনসভার ভূমিকা অনেক সুদৃঢ় ও কার্যকর। এ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি এবং জনপ্রতিনিধিদেরও জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। রাষ্ট্রপতি-শাসিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত আইনসভার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকারের তিনটি মৌলিক অঙ্গ রয়েছে- আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ। প্রতিটি বিভাগের সুষ্ঠু ও ভারসাম্যপূর্ণ পরিচালনার ওপর রাষ্ট্রের উন্নয়ন নির্ভর করে। যে কোনো একটি উপাদানের কার্যাবলি অন্য দুটো উপাদানের কার্যাবলির ওপর নির্ভরশীল হয়ে রাষ্ট্রে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি করে। একটি উপাদান আংশিক বা পূর্ণভাবে ব্যাহত হলে বাকি দুটোর কার্যাবলিও ব্যাহত হয়।

রাষ্ট্রের তিনটি উপাদানের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নির্বাহী বিভাগ। মূলত সরকারের নীতি, সিদ্ধান্ত ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বশীল অঙ্গ হচ্ছে এ নির্বাহী বিভাগ। সেজন্য বর্তমান বিশ্বে নির্বাহী বিভাগকে গতিশীল ও কর্মমুখী করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলছে। একটি দেশের উন্নয়নের জন্য নির্বাহী বিভাগই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ কথা বলা হয় যে, ‘নির্বাহী বিভাগই হচ্ছে শাসনকার্যের মূল উৎস’। অতএব অনস্বীকার্য যে, নির্বাহী বিভাগ যদি সুষ্ঠু ও কার্যকরভাবে পরিচালিত না হয় তবে দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধিত হতে পারে না। আর এখানেই আসে জবাবদিহির প্রশ্ন। নির্বাহী বিভাগের কাজের জন্য কোথাও না কোথাও জবাবদিহির ব্যবস্থা না রাখলে প্রশাসনে স্বেচ্ছাচারিতা আসে এবং দেশের কল্যাণ ব্যাহত হয়। জবাবদিহির আভিধানিক অর্থ হলো কৈফিয়ত। প্রশাসনিক কাজে যে কেউ তার কাজের জবাবদিহি প্রদানে ব্যর্থ হলে তাকে শাস্তি পেতে হয়। দক্ষ ও উন্নত প্রশাসনের জন্য জবাবদিহির কোনো বিকল্প নেই।

২. সংসদীয় গণতন্ত্র : যুক্তরাজ্য, ভারত, বাংলাদেশ, জাপানসহ পৃথিবীর আরও অনেক দেশে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রয়োগে সরকারের পন্থা সুনির্দিষ্ট ও সংবিধান কর্তৃক সুনিয়ন্ত্রিত। রাষ্ট্র পরিচালনার নির্বাহী কর্তৃত্ব ন্যস্ত থাকে মন্ত্রিপরিষদের ওপর এবং মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা সরকারের নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ব্যক্তিগতভাবে এবং যৌথভাবে দায়ী থাকেন সংসদের কাছে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে দায়ী থাকেন জনগণের কাছে। সরাসরি জবাবদিহির এ ব্যবস্থার জন্য সংসদীয় গণতন্ত্র বর্তমান বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয়। সংসদীয় ব্যবস্থায় সরকারের কর্মকান্ডের সামগ্রিক কেন্দ্রবিন্দু হলো সংসদ। এ ব্যবস্থায় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুও সংসদ। তবে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত আইনসভার কাছে নির্বাহী বিভাগকে সরাসরি ও সামষ্টিকভাবে দায়বদ্ধ রাখার বিধান সংসদীয় ব্যবস্থারই একক এবং অনন্য বৈশিষ্ট্য। এ ব্যবস্থায় সরকারি নীতি নির্ধারিত হয় সংসদে এবং তা বাস্তবায়নে মন্ত্রিপরিষদ সংসদের কাছে দায়ী থেকে কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে থাকে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক কর্তৃত্বের মতো প্রশাসনিক কর্তৃত্বের উৎসও হলো সংসদ। ১৯৮১ সালে আমেরিকার সিনেট কমিটির এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিভাগ এবং বিভাগীয় কর্মকর্তারা কোনো অর্থেই প্রশাসনিক কর্তৃত্বের অধিকারী নন; তারা কংগ্রেস প্রণীত আইনের সৃষ্টি। জাতীয় অর্থের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাকল্পে গ্ল্যাডস্টোনের নেতৃত্বে কমন্স সভায় ১৮৬২ সালে যে আইন প্রণীত হয় তারও মূল লক্ষ্য ছিল প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করা। বাংলাদেশের সংবিধানেও এ সুর পরিলক্ষিত হয়। সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে সংসদ আইনের দ্বারা প্রজাতন্ত্রের কর্মে কর্মচারীদের নিয়োগ ও কর্মের শর্তাবলী নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবেন’। এখানেও প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের নিয়োগ এবং তাদের কর্মের শর্তাবলি নির্ধারণের দায়িত্ব সংসদের কাছে ন্যস্ত আছে। গণতন্ত্রের প্রকৃত শাসন হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আইন/নীতি প্রণীত হয় সংসদে এবং তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব থাকে জনপ্রশাসনের ওপর। নীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য/উপাত্ত সংগ্রহ, সমন্বয় এবং সরবরাহ করে থাকেন প্রশাসকরা। অন্য কোনো বিকল্প থাকলে তা-ও জনপ্রশাসকরা তুলে ধরেন। মাঠ পর্যায়ে এসব নীতিমালা বাস্তবায়ন করেন জনপ্রশাসকরা।

এখানে লক্ষণীয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংসদে যেহেতু নীতি নির্ধারিত হয়ে থাকে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কিন্তু তার প্রয়োগকারীরা অর্থাৎ প্রশাসকরা থাকেন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। তাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন কার্যকর সংসদ এবং দক্ষ ও নির্দলীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা। সরকারের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের জন্যও প্রয়োজন কার্যকর সংসদ এবং দক্ষ ও নির্দলীয় প্রশাসনব্যবস্থা। একটির অভাবে অন্যটির কার্যক্রম কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। সরকারি কর্মকান্ড বাস্তবায়নে চাই এ দুইয়ের সমন্বয় এবং সুসম্পর্ক; যা আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। বাংলাদেশের মতো সীমিত সম্পদের দেশে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য এর প্রয়োজন আরও বেশি। আমাদের আজকের আলোচনাটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে হলেও এ লেখাটি উপস্থাপন করা হলো মূলত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ : দীর্ঘ রক্তাক্ত সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা লাভের সূচনালগ্নে ১৯৭২ সালের ১৪ এপ্রিল নির্বাচিত গণপরিষদে গৃহীত হয় বাংলাদেশের সংবিধান আর ’৭২ সালের সাময়িক সাংবিধানিক আদেশবলে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় সংসদীয় গণতন্ত্র। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীনতা লাভের সূচনাতেই সংবিধান ও সংসদীয় গণতন্ত্র লাভের এরূপ দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বাংলাদেশের ’৭২-এর সংবিধানকে অত্যন্ত যুগোপযোগী এবং শ্রেষ্ঠ সংবিধানসমূহের একটি বলে আখ্যায়িত করা হয়। এ সংবিধানের মূল বক্তব্যই হচ্ছে সংসদীয় গণতন্ত্র। প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ এবং জাতীয় সংসদের কাছে দায়ী মন্ত্রিপরিষদ- এটাই হচ্ছে সংবিধানের মূল বক্তব্য। ’৭২-এর সংবিধানে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু চিহ্নিত করা হয় সংসদকে এবং সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সৃষ্টির মাধ্যমে মন্ত্রণালয়/ বিভাগ সমূহের প্রশাসনিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ন্যস্ত হয় এ সংসদের ওপর। বাংলাদেশে ’৭২ সালে গণতান্ত্রিক চর্চা শুরু হলেও তা ব্যাহত হয় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই। ’৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা এবং তারপর সামরিক শাসন জারি ও সংবিধানকে অকার্যকরের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক চর্চা ব্যাহত শুরু হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে নিরপেক্ষ সরকারের তত্ত্বাবধানে ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় দ্বাদশ সংশোধন আইন এবং ’৯১ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশে আবারও প্রতিষ্ঠিত হয় সংসদীয় গণতন্ত্র। জনগণের সঠিক ইচ্ছার প্রতিফলনই হচ্ছে সরকারি ও বিরোধী দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ফসল।

প্রশাসনিক ব্যবস্থা : মানবসভ্যতার প্রাচীনতম শাসন পদ্ধতির অন্যতম হলো আমলাতন্ত্র। সরকারের কর্মকান্ড পরিচালনার অন্যতম অঙ্গ হলো আমলাতন্ত্র। প্রাচীন এ পদ্ধতি সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান বিশ্বে সর্বত্রই প্রচলিত আছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকান্ডে আমরা প্রশাসনের নিরবচ্ছিন্ন ভূমিকা দেখতে পাই। বাংলাদেশে যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা আমরা দেখতে পাই তা মূলত ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলে এ দেশ শাসনে ব্রিটিশরা যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করেছিল তারই উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা। ব্রিটিশরা এ দেশে শাসনের জন্য যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা স্থাপন করে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরও তা চলতে থাকে। ’৪৭-পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু না হওয়ায় দেশের প্রধান নির্বাহীর ইচ্ছানুযায়ী প্রশাসকরা কাজ করতেন। ব্রিটিশ শাসনামলে তাই আইসিএস (ICS) অফিসাররা স্থানীয় মন্ত্রীদের ওপর মর্যাদা পেতেন এবং পাকিস্তান আমলেও আমরা দেখতে পাই, Warrant of Precidence-এ সংসদ সদস্যদের অবস্থান ছিল যুগ্মসচিবের সমপর্যায়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের পদমর্যাদা সচিবের ওপর নির্ধারিত হয়। তা ছাড়া সংসদ সদস্যদের মেয়াদ খ-কালীন এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা স্থায়ী বলে উন্নয়ন কর্মকান্ডে প্রশাসকরাই মূল ভূমিকা পালন করে আসছেন। প্রশাসকদের অবস্থান এবং স্থায়িত্বের কারণে মাঠপর্যায়ে জনগণ প্রশাসকদেরই সরকার মনে করে। তাই সচরাচর রাজনীতিবিদ, গবেষক, বিভিন্ন পেশাজীবী গ্রুপ আমলাতন্ত্রকে সমালোচনা করে থাকলেও আজ পর্যন্ত এর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে আমলাতন্ত্রের কোনো বিকল্পের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন আমলাতন্ত্রকে জনগণের কল্যাণে কাজে লাগানো। এর জন্য চাই সংসদ ও আমলাতন্ত্রের সমন্বয়। বাংলাদেশ সংবিধানের ৫৫(৬) ধারাবলে ১৯৭৫ সালে যে রুলস অব বিজনেস (Rules of Business, 1975) প্রণীত হয়েছিল তাতে মন্ত্রণালয়ের সব কর্মকান্ডের প্রধান নির্বাহী ছিলেন সচিবরা এবং তারা ছিলেন মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা। ১৯৯৬ সালে রুলস অব বিজনেস পরিবর্তন করে মন্ত্রীদের মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী করা হলেও সচিবরা এখনো Principal Accounting officer হিসেবে কাজ করেছেন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিকাশের পূর্বশর্ত হচ্ছে দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশে ’৭৫-পরবর্তী সময়ে এ দেশে স্বৈরশাসন পরিচালনার কারণে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিকাশ লাভ করতে পারেনি।

প্রশাসনের ওপর সংসদের কর্তৃত্ব : গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সংসদ সদস্যরা নিম্নে বর্ণিতভাবে প্রশাসনিক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন- (১) মন্ত্রীরা স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ে প্রধান নির্বাহী হিসেবে মন্ত্রণালয়ের যাবতীয় কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করেন এবং তাদের কাজের জন্য সংসদের কাছে এককভাবে দায়ী থাকেন। (২) সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ। সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ সংবিধানের ৭৬(১) ধারায় সংসদ সদস্য সমন্বয়ে কমিটি গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। বর্তমানে সরকারি হিসাব কমিটি, বিশেষ অধিকার কমিটি ইত্যাদি ছাড়াও প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের জন্য একটি করে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গঠন করা হয়েছে। সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের পরিবর্তে সংসদ সদস্যদের এসব স্থায়ী কমিটিতে সভাপতি নিয়োগ করেছে। সংবিধানের ৭৬(২ ও ৩)-তে এসব কমিটির কার্যাবলি নির্ধারিত করা হয়েছে, যেমন (ক) খসড়ার বিল ও অন্যান্য আইনগত প্রস্তাব পরীক্ষা করিতে পারিবেন। (খ) আইনের বলবৎকরণ পর্যালোচনা এবং অনুরূপ বলবৎকরণের জন্য ব্যবস্থাদি গ্রহণের প্রস্তাব করিতে পারিবেন। (গ) জনগুরুত্বসম্পন্ন বলিয়া সংসদ কোনো বিষয় সম্পর্কে কমিটিকে অবহিত করিলে সেই বিষয়ে কোনো মন্ত্রণালয়ের কার্য বা প্রশাসন সম্বন্ধে অনুসন্ধান বা তদন্ত করিতে পারিবেন এবং কোনো মন্ত্রণালয়ের নিকট হইতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি সংগ্রহের এবং প্রশ্নাদির মৌখিক বা লিখিত উত্তর লাভের ব্যবস্থা করিতে পারিবেন। (ঘ) সংসদ কর্তৃক অর্পিত যে কোনো দায়িত্ব পালন করিতে পারিবেন। (৩) সংসদ আইনের দ্বারা এই অনুচ্ছেদের অধীন নিযুক্ত কমিটিসমূহকে (ক) সাক্ষীদের হাজিরা বলবৎ করিবার এবং শপথ, ঘোষণা বা অন্য কোনো উপায়ের অধীন করিয়া তাঁহাদের সাক্ষ্য গ্রহণের ব্যবস্থা করিতে পারিবেন। (খ) দলিলপত্র দাখিল করিতে বাধ্য করিবার ক্ষমতা প্রদান করিতে পারিবেন। (১) নবগঠিত এসব কমিটির কাজের ব্যাপ্তি অনেক বিস্তৃত হলেও কমিটিগুলোতে কোনো প্রফেশনাল লোকবল বা লজিস্টিক সাপোর্ট দেওয়া হয়নি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বিকাশে এবং সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণে এসব কমিটিকে আরও বেশি সংগঠিত করা প্রয়োজন। কেননা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কমিটি প্রথা হলো অন্যতম পদ্ধতি যা দিয়ে সংসদ প্রশাসনিক কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মন্ত্রণালয়ের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় মন্ত্রীদের নিয়ন্ত্রণ স্থাপনে মন্ত্রীদের Principal Accounting officer নিয়োগ করা প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনপ্রতিনিধি ও জনপ্রশাসকের সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করা একান্ত বিবেচ্য। রাজনৈতিক নেতৃত্বধীনে জনপ্রশাসকরা আনুগত্যশীল হবেন এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সুনির্দিষ্ট যোগ্যতার পরিচয় প্রদান একান্তভাবে আবশ্যক। কারণ জনপ্রতিনিধিরা ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে অস্থায়ী এবং জনপ্রশাসকদের পদ স্থায়ী। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ঐতিহ্য এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত হলে জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসকদের ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা হয়। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হলে স্বেচ্ছাচারিতা থাকে না, এজন্য বিশ্বের অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশে আইনসভা কর্তৃক বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সভাপতি স্থায়ী কমিটির আইনসভার পক্ষে কার্য পরিচালনার জন্য নির্বাচিত হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে সরকারের জনপ্রতিনিধি ও জনপ্রশাসকরা নিয়ন্ত্রিত থাকেন। অনেক গণতান্ত্রিক দেশে ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ন্যায়পাল হলো সাংবিধানিক সংসদীয় কার্যালয় বা সরকারি প্রশাসন কর্তৃক জনগণের বিরুদ্ধে কৃত অন্যায় অসুবিধার বিরুদ্ধে আইনসভা থেকে জনগণের পক্ষে এসব অনিয়ম প্রতিকারের দায়িত্ব পালন করে। বাংলাদেশের সংবিধানেও এ বিধান রাখা হয়েছে (৭৭)।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনপ্রতিনিধি ও জনপ্রশাসকদের সুসম্পর্কের ওপর নির্ভর করে সমস্ত জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সম্মানের ভিত্তিতে এ সম্পর্ক গড়ে ওঠা সম্ভব। দেশ ও দেশের জনগণ সবকিছুর ঊর্ধ্বে এ ধারণা থেকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মানুষের জন্য কার্যকর ও অর্থনৈতিক উন্নতি নিশ্চিত করা যেতে পারে। জনপ্রতিনিধিদের চিন্তা-চেতনার ফসল থেকে সৃষ্টি নীতিসমূহ বাস্তবায়িত হয় জনপ্রশাসকদের দ্বারা। সে ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধি ও জনপ্রশাসকের মূল লক্ষ্য দেশ ও মানুষের কল্যাণ। এ প্রয়াস সামনে রেখেই জনপ্রতিনিধি ও জনপ্রশাসকদের ভূমিকা কার্যকর করাই দেশ ও মানুষের জন্য কল্যাণকর।

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় চাই কার্যকর সংসদ ও দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা। জনপ্রতিনিধিরা সংসদে আইন প্রণয়ন করেন আর জনপ্রশাসকরা আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে যাবতীয় তথ্য উপস্থাপন এবং মাঠপর্যায়ে সরকারি নীতি বাস্তবায়ন করেন। অন্যদিকে সংসদ সদস্যরা কমিটির মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করেন। তাই সরকারের নীতি বাস্তবায়নে একমাত্র সফল জনপ্রতিনিধিমূলক সরকার গঠনে সহায়ক হতে পারে আর দক্ষ জনপ্রতিনিধিদের ও জনপ্রশাসকদের কর্মকান্ডের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারে সবচেয়ে সুদৃঢ়ভাবে। তাই আজকের পরিবর্তিত বিশ্ব আঙ্গিকের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার ওপর সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আর একবিংশ শতাব্দীর বড় চ্যালেঞ্জ হবে মানুষের সৃজনশীলতার প্রতিযোগিতা, সেজন্যই মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রশ্নটি আজ বিশ্ব পরিমন্ডলে স্থান পাচ্ছে গভীর গুরুত্বসহকারে। বিশ্বের কোনো দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে বিশ্ববিবেককে সোচ্চার হতে দেখা যায়।

লেখক : সভাপতি, সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত কমিটি ও সাবেক ডেপুটি স্পিকার, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ।

 

 

 

 

সর্বশেষ খবর