শনিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

অনন্তলোকে রাহাত খান

দুলাল আচার্য

অনন্তলোকে রাহাত খান

পরপারে চলে গেলেন সাংবাদিকদের অভিভাবক ও সাংবাদিকতার দিকপাল রাহাত খান। দীর্ঘদিন দৈনিক ইত্তেফাকে কাজ করা রাহাত খান সর্বশেষ দৈনিক ‘প্রতিদিনের সংবাদ’-এর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। রাহাত খান ১৯৪০ সালের ১৯ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার পূর্ব জাওয়ার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ষাটের দশকে তিনি কর্মজীবনে প্রবেশ করেন শিক্ষক হিসেবে। ’৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষাজীবন শেষ করে ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে যোগ দেন। এরপর জগন্নাথ কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেন। ’৬৯ সালে দৈনিক সংবাদে সাংবাদিকতা জীবনের হাতেখড়ি রাহাত খানের। পরে ইত্তেফাকে যোগ দেন। তিনি ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক এবং সর্বশেষ ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় দৈনিক ‘বর্তমান’। তিনি রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসসের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে পালন করেন।

রাহাত ভাইয়ের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ১৯৯৭ সালে। তখন আমি সাপ্তাহিক মুক্তিবার্তায় কাজ করি। মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের এ ম্যাগাজিনটিতে বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব ছিল আমার। পরে শেখ রেহানা প্রকাশিত ও সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’য় কাজ করতে গিয়ে বেবী আপার মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের পরিধি আরও বিস্তৃত হয়।

তাঁর অধীনে আমার পেশাগত কাজের দায়িত্বের সময় ছিল মাত্র ছয় মাস। সময়টা ২০১৩ সাল। ওই বছরের আগস্টে আমি জনকণ্ঠের সম্পাদকীয় বিভাগ ছেড়ে দৈনিক বর্তমানে একই বিভাগে যোগ দিই। রাহাত ভাই তখন পত্রিকাটির উপদেষ্টা সম্পাদক। সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করার কারণে প্রতিদিনই তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হতো। নিয়মিত সম্পাদকীয় মিটিংয়ে দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি-ইতিহাসসহ নানা বিষয়ে কথা হতো। প্রতিদিন আমাদের দুটি করে সম্পাদকীয় লেখা হতো। সম্পাদকীয়গুলো তোশারফ ভাই দেখার পর রাহাত ভাই দেখতেন। রাহাত ভাই আমাকে রাজনীতিবিষয়ক সম্পাদকীয়গুলো বেশি দিতেন। বলতেন, ‘তুমি এটা লিখবে, আমাকে দেখিয়ে নিও।’ মাঝেমধ্যে বলেও দিতেন কী দিয়ে শুরু ও শেষ করব। সে সময় এক সম্পাদকীয়তে ‘বিরোধী দলের নাশকতা’ শব্দগুলো লিখেছিলাম। প্রকাশ হওয়ার আগেই বিষয়টি নিয়ে খুব আপত্তি উঠল। কেউ কেউ বললেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলে মালিক ও প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হবে- এভাবে লেখা যাবে না। রাহাত ভাই বললেন, ‘নাশকতাকে তো নাশকতাই বলা হবে, এটাই যাবে।’ সেদিন তাঁর এ দৃঢ় উচ্চারণ আমাকে সাহস জুগিয়েছিল।

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমি আবারও জনকণ্ঠে ফিরে আসি। আসার সময় রাহাত ভাই বললেন, ‘দুলাল! আমি যদি ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে যাই, তোমাকে ডাকব।’ সেদিন রাহাত ভাইয়ের বিষণ্ন মুখ অসহায়ের মতো দেখাচ্ছিল। এর কিছুদিন পর রাহাত ভাইও বর্তমান ছেড়ে দেন।

২০১৫ সালের প্রথম দিকের কথা। একদিন স্বদেশ দা (তখন জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক) আমার হাতে একটি লেখা দিয়ে বললেন, ‘রাহাত ভাই এখন থেকে নিয়মিত লিখবেন, ওনার জন্য একটা দিন ঠিক কর।’ আমি তালিকা দেখে সোমবার উপসম্পাদকীয় পাতার জন্য দাদাকে বললাম। স্বদেশ দা তোয়াব ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে সোমবারই নির্ধারণ করলেন। সেই থেকে তিনি জনকণ্ঠে বেশ কিছুদিন লিখেছিলেন। এ লেখার সুবাদেই রাহাত ভাইয়ের সঙ্গে সপ্তাহে দু-একবার কথা হতো। আজ রাহাত ভাই নেই, আমার জন্য সবই স্মৃতি।

একজন সাংবাদিক হিসেবে সমাদৃত হলেও রাহাত খান ছিলেন আপাদমস্তক কথাসাহিত্যিক। বর্ণাঢ্য জীবনে রাহাত খান ছোটগল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও উপন্যাসের নিপুণ কারিগর হয়ে উঠেছিলেন। ’৭২ সালে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অনিশ্চিত লোকালয়’ প্রকাশিত হয়। তাঁর উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘অমল ধবল চাকরি’, ‘ছায়াদম্পতি’, ‘শহর’, ‘হে শূন্যতা’, ‘হে অনন্তের পাখি’, ‘মধ্যমাঠের খেলোয়াড়’, ‘এক প্রিয়দর্শিনী’, ‘মন্ত্রিসভার পতন’, ‘দুই নারী’, ‘কোলাহল’, ইত্যাদি। জনপ্রিয় ও বিখ্যাত থ্রিলার সিরিজ মাসুদ রানার রাহাত খান চরিত্রটি তাঁকে অনুসরণ করেই তৈরি। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার,  ১৯৯৬ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।

শুধু সাংবাদিকতাই নয়, বাংলা ভাষার সাহিত্য অঙ্গনে যে কজন লেখক আলো ছড়িয়েছেন, রাহাত খান ছিলেন তাঁদের অন্যতম। একদিকে তিনি ছিলেন প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক, উদার ও উন্নত মনমানসিকতার অধিকারী, অন্যদিকে তাঁর কর্মের মধ্য দিয়ে ঋদ্ধ হয়েছে দেশের শিল্প-সাহিত্য অঙ্গন। ’৭৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম যে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন হয়, তার কার্যনির্বাহী সাধারণ সম্পাদক ছিলেন রাহাত খান। সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কবি জসীমউদ্্দীন ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। দেশের বিভিন্ন সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একনিষ্ঠ নিবেদিত কর্মী ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার আগে-পরে রাজপথের আন্দোলন সংগ্রাম নিয়ে তিনি বহু কলাম, প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন তিনি। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও ছাত্রলীগের প্রায় প্রতিটি আলোচনা সভায় তিনি সপরিবার বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে বক্তৃতা করেছেন, কবিতাও লিখেছেন। রাহাত খান শুধু কর্মজীবনে নয়, ব্যক্তিজীবনেও নিরহংকার ও অমায়িক মানুষ ছিলেন। তিনি সুন্দর ও নান্দনিক জীবন যাপন করতেন। তাঁর সৃষ্টিকর্ম যুগ যুগ ধরে টিকে থাকবে। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যজগতে অসাধারণ অবদানের জন্য রাহাত খান স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

লেখক : সহকারী সম্পাদক

প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর