রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

মোতালেবের সৌদি খেজুর বাগান

শাইখ সিরাজ

মোতালেবের সৌদি খেজুর বাগান

২০০৪ সালে চ্যানেল আইয়ে ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানের প্রথম দিকের একটি প্রতিবেদন ছিল ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার এক উদ্যমী তরুণ মোতালেবের সৌদি খেজুর চাষ নিয়ে। মোতালেবের বাড়িটি ভালুকার ‘পাড়াগাঁও’ নামক গ্রামে। প্রথম যখন পাড়াগাঁও যাই, মনে হয়েছিল সত্যিই সে এক গহিন পাড়াগাঁও। গ্রামীণ পরিবেশই গ্রামটির নামের সার্থকতা। এরপর বেশ কয়েকবার সেই গ্রামে যাওয়া হয়েছে। প্রতিবারই দেখেছি অল্প অল্প করে পাল্টে যাচ্ছে গ্রাম, পাল্টে যাচ্ছে মোতালেবের নিজের বাড়িটিও। বৃহত্তর ময়মনসিংহের অনেক স্থানেই মাটির ঘরের ঐতিহ্য ছিল। প্রথম এসে মোতালেবের বাড়িতেও দেখেছিলাম বহুদিনের পুরনো মাটির ঘর। আজ ঠিক সেখানটাতেই দোতলা বাড়ি। সে বাড়ির দেয়ালে নানান ছবি। প্রান্তরজোড়া মরুভূমি, উট, খেজুর গাছের ছবি। বাড়িটিকে এখন বলতে হবে বাগানবাড়ি। সৌদি খেজুরের মোতালেবকে বাংলাদেশের সব প্রান্তের মানুষই কমবেশি চেনে। দেশের মাটিতে আরব খেজুরের চাষ সম্ভব করেই ছেড়েছেন মোতালেব। দরিদ্র কৃষক পরিবারের মোতালেব ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টায় গিয়েছিলেন সৌদি আরব। কাজ করতেন খেজুরবাগানে। ২০০৪ সালে মোতালেব আমাকে বলেছিলেন, ‘উত্তপ্ত মরুভূমিতে খেজুরবাগানে কাজ করতে করতে ভাবতাম, আমাদের নবী করিম (সা.) এ খেজুর খেয়ে জীবন ধারণ করেছেন। আমিও একজন দরিদ্র মুসলিম হিসেবে মনে করি, বাংলাদেশেও যদি চেষ্টা করি আমার রসুলের অসিলায় বাংলাদেশেও সৌদি খেজুরের বাগান হতে পারে। এ বিষয়টি আমার মনের ভিতর সব সময় নাড়া দিতে থাকে। তারপর একদিন নানান জাতের সৌদি খেজুরের বীজ সংগ্রহ করে ব্যাগে ভরে নিয়ে দেশে চলে এলাম।’

দেশে ফিরে শুরু হলো সেই বীজ থেকে চারা উৎপাদনের অদম্য চেষ্টা। আরবের খেজুর দেশে হবে! মানুষ পাগল ভাবতে শুরু করল। খেজুর নিয়ে মোতালেবের পাগলামি দেখে তাঁর বউও চলে গেলেন বাবার বাড়ি। আমি যখন প্রথমবার প্রতিবেদন ধারণ করতে গিয়েছিলাম তখন মোতালেবের প্রথম সাফল্য দৃশ্যমান হয়, অর্থাৎ বীজ থেকে চারা গজিয়ে বেশ বড় হয়ে উঠছিল। তিনি তাঁর স্ত্রীর সামনেই সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, ‘আমার এ খেজুরবাগানের নেশা দেখে সবাই পাগল ভাবত, আমার বউও চলে যান তাঁর বাপের বাড়ি।’ সে কথা শুনে মোতালেবের স্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম কেন তিনি মোতালেবকে ছেড়ে গিয়েছিলেন। উত্তরে তাঁর স্ত্রী বলেছিলেন, ‘সৌদি আরব থেকে মানুষজন সুটকেস ভরে কত জিনিসপাতি আনে, বাচ্চার জন্য জামা-কাপড়, কম্বল, জায়নামাজ, তসবি, সোনা-দানা। আর উনি নিয়ে এলেন এক ব্যাগ খেজুরের বীজ! তাঁরে পাগল ছাড়া আর কী ভাবার আছে! তাঁর এসব পাগলামি ভেবে বাপের বাড়ি চলে গেছিলাম।’ কিন্তু কোনো কিছুই টলাতে পারেনি মোতালেবকে। ২০০১ থেকে ২০০৪- চার বছরের কঠিন সাধনায় বাংলাদেশের মাটিতেই বেড়ে উঠল সৌদি খেজুরের গাছ। ২০০৬ সালে আবার যাই মোতালেবের খেজুরবাগানে। সেবার তাঁর বাগানের গাছে গাছে ঝুলতে দেখেছি আরবি খেজুর। মনোরম সে দৃশ্য। এ দেশের মাটিতে এমন খেজুর ফলবে কে ভেবেছিল, মোতালেব ছাড়া! অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন মোতালেব। বাংলাদেশের বহু কৃষককে আমি কাছ থেকে দেখেছি যাঁদের অদম্য ইচ্ছা, আর ফলফসলের প্রতি প্রেম তাঁদের সাফল্য এনে দিয়েছে। যেমন ছিলেন প্রয়াত হরিপদ কাপালি, হরিধানের আবিষ্কারক।

দরিদ্র কৃষকপুত্র মোতালেবের স্বপ্ন ছিল সচ্ছলতার মুখ দেখবেন। তাই সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছিলেন। সেখানে তাঁর স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কিন্তু রপ্ত হয়েছিল খেজুর চাষাবাদের কলাকৌশল। আর তাই ২০০১ সালে মাত্র ১০ কাঠা জমিতে ২৭৫টি চারা রোপণের মধ্য দিয়ে হয়েছিল এক স্বপ্নের যাত্রা। তারপর দেখেছি মোতালেবের স্বপ্ন থেকে সম্ভাবনা, সম্ভাবনা থেকে আরও সাফল্যের পথে হেঁটে চলেছেন তিনি। একজন দুর্দান্ত স্বপ্নবাজ কৃষি উদ্যোক্তার অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার সংগ্রামটি কাছ থেকে দেখেছি আমি, প্রতিবার দর্শকদেরও দেখাতে চেয়েছি। মোতালেব এখন দেশের অন্যতম সফল খেজুর বাগানের উদ্যোক্তা।

১০ কাঠা দিয়ে শুরু করা মোতালেবের খেজুরবাগান পৌঁছেছে ৫ বিঘা আয়তনের সফল খেজুরবাগানে। যেখানে ছোট বড় মিলে ৬৭৫টি বিভিন্ন জাতের সৌদি খেজুর গাছ। যার অধিকাংশই খেজুর ধরার উপযোগী। এরই মধ্যে ১০০ গাছে নিয়মিত খেজুর ধরছে। গাছে গাছে পাকা খেজুর। বড় বড় গাছের চারপাশ দিয়ে স্থায়ীভাবে যুক্ত করা হয়েছে লোহার মই। উঁচু গাছ থেকে খুব সহজে পাকা খেজুর পাড়তেই সে ব্যবস্থা। মনে পড়ে মক্কা-মদিনায় খেজুরবাগানের প্রতিবেদন ধারণের সময় এ জাতীয় অটোমেটেড মেশিনগুলো দেখেছিলাম। মোতালেবকে প্রশ্ন করেছিলাম, লোহার রড দিয়ে ও রকম মই বানানোর বুদ্ধি পেলেন কোথায়? মোতালেব জানালেন সৌদি আরবে খেজুরবাগানে কাজ করার সময় অটোমেটেড যন্ত্রগুলো দেখেছিলেন। সে প্রযুক্তি তাঁর নেই, কিন্তু অনুরূপ একটা কাঠামো তিনি তৈরি করে নিয়েছেন নিজের মতো করে। মোতালেব বলছিলেন, সব খেজুর বাগান থেকেই বিক্রি হয়ে যায়। ১ হাজার দেড় হাজার টাকা কেজি দরে কিনে নেন ক্রেতারা। প্রতিটি গাছে ৪০ থেকে ৫০ কেজি খেজুর ধরে। এ বছর ইতোমধ্যে ৬০০ কেজি খেজুর বিক্রি করে দিয়েছেন। আরও ৪০০ কেজির মতো বিক্রি করতে পারবেন। অর্থাৎ ১ হাজার কেজি খেজুর পাচ্ছেন।  জাতভেদে খেজুরের দামের কমবেশ আছে। গড়ে ১ হাজার টাকা কেজি হলেও তিনি পাচ্ছেন ১০ লাখ টাকার খেজুর। খেজুরের চেয়ে খেজুরের চারা বিক্রিতেই লাভ তাঁর। তিনি বলেন, বীজ থেকে যে খেজুরের চারা হয়, অধিকাংশই পুরুষ গাছ হয়। ফলে সে গাছ থেকে ফল পাওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু তিনি কলম করে যে চারা বিক্রি করেন তা থেকে ফল আসবে তার নিশ্চয়তা রয়েছে। তিনি প্রতিটি কলমের চারা বিক্রি করেন ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকা দরে। এমন মূল্যবান চারা বেশ কয়েক বছর ধরে উৎপাদন করে আসছেন মোতালেব। আবার কখনো বাগানের বড় গাছও বিক্রি করেন। সব মিলে খেজুরবাগানই তাঁর উপার্জনের একমাত্র ক্ষেত্র। এখন তাঁর হাতে আছে ১০০ কলমের চারা, এগুলো বিক্রি করে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা তিনি অনায়াসেই পাবেন। মহান আল্লাহ খেজুর দিয়ে ভাগ্য পাল্টে দিয়েছেন মোতালেবের।

সফল হতে হলে নতুন চিন্তা এবং তার সঙ্গে পরিশ্রমের বিকল্প নেই, তাই প্রমাণ করলেন মোতালেব। মোতালেব ২০০৪ সালে বলেছিলেন খেজুরবাগান গড়ে তোলার পেছনে তাঁর স্বপ্নের কথা, মহানবী (সা.)-এর দেশের খেজুর তিনি আমাদের দেশের মাটিতে ফলাবেন। আজ ১৬ বছর পর এসে দেখছি, স্বপ্নের পেছনে একাগ্রচিত্তে লেগে থাকলে আল্লাহ তা সফল করেন। মোতালেবের মনোবাসনা পূর্ণ হয়েছে। আজকে মোতালেবের জীবনে পরিবর্তন এসেছে। সংসার থেকে শুরু করে সামাজিক অবস্থান সবখানেই তিনি সম্মানিত হচ্ছেন।

মোতালেব সৌদি খেজুরকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সারা দেশে।

আমাদের দেশে ফলের রাজ্যে বিদেশের যত ফল যুক্ত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সৌদি খেজুর। দিনে দিনে আমাদের ফলের সম্ভার সমৃদ্ধ হচ্ছে। একসময় বাংলাদেশের মাটিতে সৌদি খেজুরের সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। এখন দেশের বহু জায়গায়ই সৌদি খেজুর গাছে ফল আসছে। সেগুলো বাজারেও বিক্রি হচ্ছে। মোতালেবের দেখাদেখি অনেকেই সৌদি আরব থেকে বীজ এনে যেমন বাজার গড়ছেন, অনেকেই বিদেশ থেকে টিস্যু কালচারের চারা এনেও রোপণ করছেন। সরকারের বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পও বিদেশ থেকে বিভিন্ন জাতের আরব খেজুরের টিস্যু কালচারের চারা এনে সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছেন।

যদি সাফল্যের বিবেচনা করতেই হয়, তাহলে মোতালেবের নামই আসবে শুরুতে। এ ষড়ঋতুর দেশের দোআঁশ মাটিতে প্রথমবারের মতো খেজুরের বীজ বপন, গাছ প্রতিপালন ও ফল ধরার ক্ষেত্রে মোতালেবের সাফল্য সত্যিই দৃষ্টান্তমূলক। মোতালেবের কাছে শুরু থেকেই আরব খেজুর নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অভিযানটি ছিল সাধনার মতো। তাঁর সাধনা আজ সফল। মোতালেব বিশ্বাস করেন, একসময় এ দেশের বাজারে যত খেজুর থাকবে, তার বড় অংশটিই থাকবে দেশের মাটিতে উৎপাদিত। আমরা খেজুর নিয়ে নানান খাদ্যপণ্য উৎপাদন এমনকি রপ্তানি বাণিজ্যের কথাও ভাবতে পারব।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর