রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

সাইফুর রহমানকে নিয়ে কিছু কথা

আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী

সাইফুর রহমানকে নিয়ে কিছু কথা

চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদ, আধুনিক বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রকৃত রূপকার দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী, বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন ১০ সদস্যের অন্যতম, স্থায়ী কমিটির দীর্ঘকালীন সিনিয়র সদস্য এম সাইফুর রহমানের একাদশ মৃত্যুবার্ষিকী ছিল ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০। মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধাচিত্তে স্মরণ করছি। এটা আমার পরম সৌভাগ্য যে দুই দশক নিবিড় সান্নিধ্যে থেকে তাঁকে চেনা, জানার ও তাঁর সঙ্গে কাজ করার অনন্য সুযোগ আমার হয়েছিল। এম সাইফুর রহমান অত্যন্ত মেধাবী একজন ছাত্র। তিনি ১৯৪৯ সালে মৌলভীবাজার সরকারি হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন, ’৫১ সালে সিলেট মুরারী চাঁদ কলেজ থেকে আইকম ও ’৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাণিজ্য বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে সাইফুর রহমান ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেন এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকার জন্য তিনি গ্রেফতার হন এবং প্রায় এক মাস কারাবরণ করেন। ’৫৪ সালে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি পড়তে বিলাত যান এবং ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট (ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস) থেকে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি পাস করেন। সাইফুর রহমান ’৬২ সালে যুক্তরাজ্যে অ্যাডভান্সড ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি আর্থিক ও মুদ্রানীতি এবং উন্নয়ন অর্থনীতিতে বিশেষায়িত শিক্ষা গ্রহণ করেন। সাইফুর রহমান ’৬০ সালের প্রথমার্ধ থেকে ’৬২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি ব্রিটিশ অক্সিজেনের অর্থ পরিচালক হিসেবে করাচিতে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ’৬২ সালে ঢাকায় এসে পাকিস্তানের সবচেয়ে বৃহৎ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি পার্টনারশিপ ফার্ম ‘রহমান রহমান হক’ চালু করেন। তিনি ১৯৬২ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তাঁর দীর্ঘ পেশাগত জীবনে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতমানের ‘রহমান রহমান হক’ কোম্পানি পরিচালনা করেন। তিনি বাংলাদেশে অবস্থানরত প্রায় সব বহুজাতিক কোম্পানি, তেল-গ্যাস উত্তোলন, পরিবহন, ব্যাংকিং, ইন্স্যুরেন্স ইত্যাদি বিষয়সহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার পরামর্শকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (ICAB)-এর প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট  অব ল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের প্রিন্সিপাল ও বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতির প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

সাইফুর রহমান ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় বেতন কমিশনে প্রাইভেট সেক্টর থেকে একমাত্র সদস্য। ’৭৩ সালে তিনি তৎকালীন সরকারপ্রধানের অনুরোধে জাতীয় মজুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। সাইফুর রহমান ’৭৬ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রপতি এ এস এম সায়েমের বাণিজ্য উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। ’৭৮ সালের মার্চে তিনি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলের ১০ জন প্রতিষ্ঠাতার একজন। পরে এ দলটিই প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ’৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিতে রূপান্তরিত হয়। তিনি ’৭৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মৌলভীবাজার সদর থেকে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ’৭৮ থেকে ’৮২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভায় বাণিজ্য ও অর্থমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৯১ সালের খালেদা জিয়া সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় জুলাই, ১৯৯১ সালে তিনি VAT System প্রবর্তন করেন। তিনি বাংলাদেশে মুক্তবাজার সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রবর্তক হিসেবে সমধিক পরিচিত। ’৭০-এর দশকের শেষের দিকে এ প্রক্রিয়া চালু হয়।

সাইফুর রহমান ’৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে মৌলভীবাজার সদর-রাজনগর ও সিলেটের জৈন্তাপুর-গোয়াইনঘাট আসন দুটি থেকে এবং পুনরায় ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে সিলেটের সদর-কোম্পানীগঞ্জ ও মৌলভীবাজার সদর-রাজনগর দুটি আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।  সাইফুর রহমান ১৯৯১ সালে দ্বিতীয়বার অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশে  প্রথমবারের মতো করের পরিসর বৃদ্ধির লক্ষ্যে মূসক (মূল্য সংযোজন কর) প্রথা প্রবর্তন করেন। ১৯৯১-৯৬ সালে তিনি ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক সংস্কার সাধন করেন। এ ছাড়া ’৯৫ সালে টাকাকে সীমিত আকারে ভাসমান মুদ্রা বিনিময় হার প্রথার চালু করেন। তিনি বাণিজ্য উদারীকরণ ও বেসরকারিকরণের উদ্যোগ নেন এবং  শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির সূচনা করেন। সাইফুর রহমান ১৯৯৫ সালে কলাম্বিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ দেশসমূহের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানদের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পক্ষে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব প্রদান করেন। এ ছাড়া ওই বছর মালয়েশিয়ায় বসনিয়া যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্বাসনের জন্য আয়োজিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থা-ওআইসির সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানদের সম্মেলনেও বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। সাইফুর রহমান ১৯৯৪ সালে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল- আইএমএফের ৪৯তম সম্মেলনে ওই দুই সংস্থার বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং পরবর্তী বছর ১৯৯৫ সালে স্পেনের মাদ্রিদে সংস্থা দুটির ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মদন মোহন কলেজ তাঁরই ঐকান্তিক প্রয়াস ও একক প্রচেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উন্নীত হয়েছিল। সিলেটবাসীর সার্বিক ও ঐতিহাসিক প্রয়োজনে তিনি নিয়মনীতির লাল ফিতা অগ্রাহ্য করে তা বাস্তবায়ন করেছিলেন। যার সুবিধা আজ সিলেটবাসী উপভোগ করছে। মনে রাখতে হবে, এটিই প্রথম কোনো বেসরকারি কলেজ যা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উন্নীত হয় এবং প্রথম স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পাঠদানরত  শিক্ষকদের জন্য এমপিও সুবিধা প্রদান করা হয়। যে কারণে তৎকালীন শিক্ষা সচিব তাঁর নোটে  লিখেছিলেন- সিলেট মদন মোহন কলেজের স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পাঠদানরত শিক্ষকদের  এমপিওভুক্তিকরণ বিশেষ ব্যতিক্রমের কারণে অনুমোদন করা হলো কিন্তু এটি উদাহরণ হিসেবে অন্য কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে গণ্য হবে না।

লেখক : সাবেক রাজনৈতিক সচিব।

সর্বশেষ খবর