রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

মজুদদারি ও কালোবাজারি ইসলামে হারাম

মুফতি রুহুল আমিন কাসেমী

মজুদদারি ও কালোবাজারি ইসলামে হারাম

ইসলাম সর্বময় শান্তির ধর্ম। আল্লাহর হুকুমের সামনে সর্বতোভাবে আত্মসমর্পণকারীই প্রকৃত মুসলিম। আর খাঁটি ইমানদার সে, যে নিজেও ধোঁকা খায় না এবং অন্যকেও ধোঁকা দেয় না। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ধোঁকা দেয় সে আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য হবে না।’ তিরমিজি। নবীজি (সা.) আরও ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা ক্রেতাকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে দাম বাড়াবে না। কেননা, প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত জীবিকা ইমানদারের জন্য হারাম।’ আল্লাহ কোরআনে কারিমের মধ্যে ইরশাদ করেন, ‘হে রসুলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু থেকে আহার কর ও সৎকর্ম কর, তোমরা যা কর সে ব্যাপারে আমি সবিশেষ অবহিত।’ সুরা মুমিনুন, আয়াত ৫১। তিনি আরও ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! আমি তোমাদের যে হালাল রিজিক দান করেছি তা থেকে আহার কর।’ সুরা বাকারা, আয়াত ১৭২।

প্রিয় নবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘একজন সৎ ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও নেককারদের সঙ্গে জান্নাতে বসবাস করবে।’ মূল্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য আটকে রেখে অস্বাভাবিকভাবে মুনাফা হাসিল করাকে শরিয়তের পরিভাষায় ‘নহতিকার’ বা মজুদদারি বলা হয়। মজুদদারির ফলে অর্থনৈতিক ভারসাম্য ব্যাহত হয়। এজন্য ইসলামী শরিয়তে একে নিষিদ্ধ ও হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। রসুলুল্লাহ (সা.) মজুদদারকে পাপী ও অভিশপ্ত বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘পণ্যদ্রব্য আটক করে অধিক মূল্যে বিক্রয়কারী অবশ্যই পাপী।’ মিশকাত।

অন্য হাদিসে রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘মূল্য বাড়ার উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি ৪০ দিন পর্যন্ত খাদ্যশস্য মজুদ রাখে, সে আল্লাহর দায়িত্ব থেকে মুক্ত এবং আল্লাহ তার প্রতি অসন্তুষ্ট।’ ইবনে মাজাহ ও বায়হাকি।

‘একজন মজুদদার খুবই নিকৃষ্টতম ব্যক্তি। যদি জিনিসপত্রের দর কমে যায় তবে তারা চিন্তিত হয়ে পড়ে। আর যদি দর বেড়ে যায় তবে আনন্দিত হয়।’ হিদায়া। কেউ যদি মুসলমানদের থেকে নিজেদের খাদ্যশস্য আটকে রাখে (মজুদদারি করে) আল্লাহ তার ওপর মহামারী ও দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন। এ প্রসঙ্গে নবীজি বলেছেন, ‘গ্রামের প্রান্তিক চাষিরা তাদের উৎপাদিত খাদ্যশস্য বহন করে শহরে নিয়ে আসে, তাদের বাধা দিও না, তাদের সঙ্গে আগে সাক্ষাৎ করে তাদের খাদ্যশস্য কম মূল্যে কিনে নিও না।’ আল হাদিস। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, গ্রামের প্রান্তিক চাষিরা অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে খাদ্যশস্য উৎপাদন করে, একটু ভালো দামের আশায় তাদের কাফেলা শহরে এসে ন্যায্যমূল্যে উৎপাদিত খাদ্যশস্য বিক্রি করে খুশিমনে বাড়ি ফিরে যায় এবং শহরের ক্রেতারাও ন্যায্যমূল্যে তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য পেয়ে যায়। এতে কারোরই মনঃক্ষুণ্ন ও প্রতারিত হওয়ার সুযোগ থাকে না। অথচ আজ মুসলমান ব্যবসায়ীদের চরিত্র দেখে ভিন্ন ধর্মের লোকেরাও হতবাক। মানবসভ্যতায় কলঙ্কময় অধ্যায় রচনা করে চলেছে একের পর এক। খাদ্যদ্রব্যসহ সব বস্তুর ওপর রয়েছে নিকৃষ্ট মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কালো থাবা। খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে। দর বৃদ্ধির পাহাড় ডিঙিয়ে বহুগুণে মুনাফা লাভের আশায় কালো টাকার পাহাড় গড়ার লক্ষ্যে। এ কুচক্রী মহল বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। মগের মুল্লুকের মতো, সামান্য ১০-২০ টাকার জিনিস ৪০০-৫০০ টাকা হয়ে যায়। অন্যদিকে  খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনকারী প্রকৃত প্রান্তিক চাষিরা, ন্যায্য মূল্য না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। তদুপরি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সামান্যতম আক্ষেপ নেই। বরং তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে স্বপ্নে বিভোর। যেখানে বিশ্বে রমজান মাসসহ বিভিন্ন সময়ে কেনাবেচার ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয় সেখানে আমাদের দেশে অসাধু ব্যবসায়ীরা এসব সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকে। এ ক্ষেত্রে আল্লামা শামি বলেন, ‘দেশে চরম দুর্ভিক্ষ ও কৃত্রিম সংকট দেখা দিলে ইসলামী আদালতের এসব দুর্নীতিবাজ, সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের গোডাউন ভেঙে তাদের সংরক্ষিত খাদ্যশস্য জনগণের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া বৈধ। যাতে জনগণ তাদের চক্রান্তের শিকার হয়ে কষ্টে জর্জরিত না হয়।’ আল্লাহ আমাদের বোঝার তৌফিক দান করুন।

লেখক : ইমাম ও খতিব। কাওলার বাজার জামে মসজিদ

দক্ষিণখান, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর