সোমবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

গবেষণার বহুমাত্রিকতা দরকার

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

গবেষণার বহুমাত্রিকতা দরকার

সারা পৃথিবীতে গবেষণা জ্ঞান সৃষ্টি ও আনন্দের মূল শক্তি হলেও আমাদের দেশে গবেষণা করাটা যেন আজন্ম পাপ। মহাপাপ। নিজেও গবেষণা করব না আর অন্য কেউ গবেষণা করলে তাকেও কীভাবে থামিয়ে দেওয়া যায় আমাদের মনোভাব অনেকটা সে ধরনের। গবেষণা নিয়ে অনেকটা রক্ষণশীল ও প্রাচীনপন্থি ধারণা এখনো আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। আমরা যত না কাজ করি তার থেকে বেশি সমালোচনা করাকে প্রাধান্য দিই। সমালোচনা করতে যোগ্যতা লাগে না, সমালোচিত হতে হলে যোগ্যতা লাগে এ বিষয়টি আমরা ভুলে যাই। গবেষণায় গঠনমূলক সমালোচনা থাকতে পারে। গবেষককে সে গঠনমূলক সমালোচনা ইতিবাচকভাবে নিয়ে তার ভবিষ্যৎ গবেষণাকে সমৃদ্ধ করতে হবে। বিনয় ও অন্যের গঠনমূলক সমালোচনার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ গবেষকের ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করে, তার মনকে উদার করে। উদার মন উদার চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নতুন চিন্তাশক্তি গড়ে তুলতে পারে। সমালোচনার নেতিবাচক রূপটিই হলো অবমাননা। অবমাননা ও সমালোচনা কখনো এক হতে পারে না। যিনি কোনো একটি গবেষণার সমালোচনা করছেন, মূলত তিনি সমালোচনা করছেন নাকি অবমাননা করছেন সে বিষয়টির বোধশক্তি তার মধ্যে থাকা দরকার। পিএইচডি গবেষণা মৌলিক কোনো উদ্ভাবন ছাড়া সচরাচর গ্রহণযোগ্য হয় না। এর ব্যত্যয় যে ঘটছে না তা নয়, তবে তারও এক ধরনের ব্যাখ্যা আছে। কারণ সময় যত গড়িয়েছে সারা পৃথিবীতে মৌলিক গবেষণার ক্ষেত্র তত সংকুচিত হয়েছে তবে গবেষণায় শেষ বলে কিছু নেই। নতুন ধারণার ফলিত গবেষণার চেয়ে মৌলিক গবেষণার গুরুত্ব এখনো পিএইচডিতে অনেক বেশি। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক বিষয়ে গবেষণার সুযোগও কমে আসছে। তবে তাই বলে গবেষণা তো বন্ধ করা যাবে না। এ কারণে এখন সারা পৃথিবীতে ইনটিগ্রেটেড বা মাল্টিডিসিপ্লিনারি গবেষণার কদর বেড়েছে। এখন একজন গবেষকের একটি নির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ থেকে কাজ করার সম্ভাবনা কমে আসছে। এর পরিবর্তে তার বিষয়ের সঙ্গে অন্যান্য বিষয়ের কীভাবে রিলেশন বা সম্পর্ক তৈরি করা যায় সেটি গবেষকদের জন্য প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের বিশেষায়িত জ্ঞান থাকবে তবে সেই বিশেষায়িত জ্ঞানের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখে মৌলিক বা ফলিত গবেষণার নতুন জ্ঞান সৃষ্টি এখন প্রায় অসম্ভব। একজন গবেষক যত বেশি কাজ করবে তত সে তার নিজের বিষয়ের গবেষণার বাইরে এসে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের গবেষণার সঙ্গে নিজেকে সম্পর্কিত করতে পারবে। এটা কি দোষের কিছু? কখনই না, কোনো যুক্তিতেই না। একটা সময়ে এসে গবেষককে দার্শনিকের স্তরে পৌঁছাতে হয়। যদিও অনেকে বলেন দর্শন ও বিজ্ঞান কখনো হাত ধরাধরি করে চলে না। কিন্তু একসময় তো চলেছে। যে সময়টাতে বিজ্ঞান ও দর্শন হাত ধরাধরি করে চলেছে তখন মানুষের মধ্যে বহুমাত্রিক চিন্তাধারা সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের কল্পনার দৃষ্টিসীমা প্রসারিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রকৌশলবিদ্যার একজন শিক্ষার্থীর ‘রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা’ ও ‘অ্যান্টিভাইরাল’ রিলেটেড দুটি রিভিউ পেপার ওয়েব অব সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণাপত্রটি প্রকৌশলীরা লেখায় অনেকেই এটির নেতিবাচক সমালোচনা করেছেন। তবে সেটি ব্যক্তি আক্রমণ ও মর্যাদাহানির পর্যায়ে যাওয়ায় সেটিকে সমালোচনা না বলে অবমাননা হিসেবে চিহ্নিত করা যুক্তিযুক্ত বলে মনে করা যেতে পারে। কেউ কেউ বলেছেন, একজন গবেষক তার নিজ বিশেষায়িত বিষয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করলে তবেই তিনি রিভিউ পেপার লিখতে পারেন। কথাটা অযৌক্তিক নয়। আবার যৌক্তিকও নয়। বরং এটা একটা অমীমাংসিত বিষয় বলা যেতে পারে। মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্সসহ অনেক উন্নত দেশে শিক্ষার্থীরা পিএইচডির জন্য গমন করলে প্রথমত তাদের সম্ভাব্য গবেষণাভিত্তিক বই ও গবেষণাপত্রসমূহ পড়তে দেওয়া হয়। এর মূল কারণ হলো এ পড়ার মাধ্যমে তারা যেন বিষয়টি সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা অর্জনে সক্ষম হন ও সে বিষয়ের ওপর একটি বা দুটি রিভিউ পেপার লেখার যোগ্যতা অর্জন করেন। এর ইতিবাচক দিকটি হলো শিক্ষার্থীরা রিভিউ পেপারসমূহ লিখে সংশ্লিষ্ট কাজের রিসার্চ গ্যাপসমূহ বের করে আনেন। এ রিসার্চ গ্যাপগুলো তখন তাদের পিএইচডি রিসার্চের মূল ফাইন্ডিংস বা লক্ষ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়। এখন গবেষণার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার চেয়ে নতুন জ্ঞান আহরণের দৃষ্টিভঙ্গিকে রিসার্চ সুপারভাইজাররা প্রাধান্য দিচ্ছেন। যে কেউ আহরিত জ্ঞান থেকে রিভিউ পেপার লিখতে পারেন তবে অভিজ্ঞতার মূল্যকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখা যাবে না। অভিজ্ঞ গবেষকরা নবীন গবেষকদের আহরিত জ্ঞান থেকে উত্থিত রিভিউ পেপারের ক্রিটিক্যাল অ্যানালাইসিস করবেন, তাদের দিকনির্দেশনা দেবেন। মোটিভেটেড অ্যাপ্রোচ গ্রহণ করবেন। কিন্তু কাউকে ছোট করে গবেষণার ক্ষেত্রে তার সর্বজনীনতার অধিকার ক্ষুণ্ন করবেন না। কারণ এখানেই একজন প্রকৃত গবেষকের উদারতা, ব্যক্তিত্ব ও মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটে। গবেষকরা এখন ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের সমন্বয়ে মৌলিক গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করছেন। রসায়নের গবেষক তার গবেষণার প্রয়োজনে পদার্থবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের ধারণা নিচ্ছেন। আবার গণিতের গবেষকরা প্রকৌশলবিদ্যার বিভিন্ন ধারণা তাদের গবেষণার সঙ্গে একীভূত করে নতুন ধারণার জন্ম দিচ্ছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও মাইক্রোবায়োলজিস্টরা তাদের গবেষণা এগিয়ে নিতে ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স ও টেকনোলজির জ্ঞান আহরণ করছেন। কেননা দিন যত যাচ্ছে বিভিন্ন শাখার গবেষকদের জ্ঞান আদান-প্রদানে প্রয়োজনীয়তাও তত বাড়ছে। প্রকৌশলীরাও নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে তাদের বাইরের বিষয়ে গিয়ে জ্ঞান আহরণ করছেন। কাজেই একজন প্রকৌশলী যদি তার গবেষণার প্রয়োজনে গবেষণার অন্য শাখার রিভিউ পেপার প্রকাশ করেন তবে বর্তমানে সেটিকে স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখার উদারতা সবার মধ্যে থাকতে হবে। গবেষণার উদ্দেশ্য না বুঝে নেতিবাচক সমালোচনা করাটা যথার্থ নয়। একজন প্রকৌশলবিদ্যার শিক্ষার্থীর পিএইচডির গবেষণার টাইটেল যদি ‘ইমপ্যাক্ট অব ২ডি ম্যাটেরিয়াল অ্যান্ড ন্যানোপার্টিকেলস অন ইম্যুইন্স রেসপন্স’ হয়, তবে এ কাজটিতে সফল হতে হলে শিক্ষার্থীর ইম্যুইন্স রেসপন্সের মৌলিক ধারণা থাকতে হবে। ইম্যুইন্স রেসপন্স নিয়ে আধুনিক গবেষণার ফলাফলও তাকে জানতে হবে। তা না হলে এ ধরনের গবেষণায় সফলতা আনা সম্ভব নয়। এর সঙ্গে শিক্ষার্থীকে ইম্যুইন্স রেসপন্সের মেডিকেল ও টেকনিক্যাল টার্মসমূহ বোঝার জন্য ভাইরোলজিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট ও চিকিৎসদের সঙ্গে জ্ঞানের আদান-প্রদানে সম্পৃক্ত হতে হবে। এমন একটি আশাবাদী গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি করাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। এভাবে আহরিত জ্ঞান ও জ্ঞানের আদান-প্রদানে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জার্নালে কারও বিশেষায়িত জ্ঞানের বাইরে রিসার্চ বা রিভিউ পেপার প্রকাশিত হলে এটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মানসিকতা পরিহার করা দরকার। গবেষণার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। মানুষের জ্ঞান আহরণেরও কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। গবেষণায় বহুমাত্রিক ধারণা গড়ে তোলার মাধ্যমেই গবেষণাকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি দৃষ্টান্তের বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে।

সত্যেন বোস একদিন কার্জন হলের ক্লাসরুমে হাইজেনবার্গের সদ্য আবিষ্কৃত অনিশ্চয়তার নীতি পড়াচ্ছিলেন, এমন সময় একটা ভুল করে বসলেন, ভুলটা এ রকম- দুটি মুদ্রাকে যদি টস করা হয়, তাহলে দুটিতেই হেড ওঠার সম্ভাবনা কত, তার হিসাব। প্রথাগত পরিসংখ্যানবিদ্যার হিসাবে এখানে চার রকমের ফল হতে পারে, হেড-হেড, হেড-টেল, টেল-হেড, টেল-টেল। মানে দুটি মুদ্রাতেই হেড ওঠার সম্ভাবনাটা হলো চার ভাগের এক ভাগ। কিন্তু সত্যেন স্যার যে ভুল করে বসেছেন বোর্ডে হিসাব করতে গিয়ে! ভুল করে তিনি এ সম্ভাবনাটাকে চার ভাগের এক ভাগের বদলে লিখে ফেলেছেন তিন ভাগের এক ভাগ হিসাবে। ছাত্রদের কেউ কেউ মিটিমিটি হাসছে। ভুলটা ধরতে পেরে সত্যেন স্যার লজ্জায় লাল হয়ে গেছেন, এত বড় ভুল কী করে করলেন! কিন্তু পরে তিনি এ ভুল থেকে এক নতুন ধরনের পরিসংখ্যান বের করে আনলেন, যা কেবল পরমাণুর চেয়েও ছোট কণিকার ক্ষেত্রে খাটে। প্রথাগত পরিসংখ্যান পরমাণুর চেয়ে ছোট কণিকার জন্য প্রযোজ্য নয়, বরং আপাতদৃষ্টিতে ভুল মনে হওয়া এ নতুন পরিসংখ্যানই এসব কণিকার আচরণকে ব্যাখ্যা করতে পারে। শিরোনাম দিলেন Planck’s Law and the Hypothesis of Light Quanta। আর পাঠিয়ে দিলেন তখনকার দিনে পদার্থবিজ্ঞানের খ্যাতনামা এক জার্নালে। কিন্তু বিধি বাম! জার্নালের সম্পাদক ও অন্য গণিতবিদ ও পদার্থবিদেরা ভাবলেন, বোস হয়তো একেবারে গোড়ায় গলদ করে এ পেপারটা লিখেছেন, তাই পত্রপাঠ রিজেক্ট করে দিলেন তারা বোসের এ গবেষণাপত্রকে। রিজেক্ট হওয়া সত্ত্বেও তিনি হাল না ছেড়ে চিঠি লিখে ফেললেন আইনস্টাইনকে। পরে আইনস্টাইন তাঁর গবেষণা দেখে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, ‘আসলে সত্যেন বোসের গবেষণায় ভুল নেই, বরং এভাবে চিন্তা করলে প্রকৃতির এসব খুদে কণিকার কাজকারবার সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। পরে আইনস্টাইনের সুপারিশে এটি পাবলিশ হলো প্রখ্যাত জার্নাল Zeitschrift für Physik-এ।

আবেদ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন নিয়ে পড়লেও পরে তিনি জিনবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে একজন খ্যাতিমান বিজ্ঞানী হয়েছেন। স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কটরমন রমন-প্রভাব আবিষ্কারের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন ১৯৩০ সালে। সমগ্র এশিয়ার মধ্যে তিনিই হলেন বিজ্ঞানে প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। তাঁর নোবেল বিজয়ী গবেষণার সবটুকুই সম্পন্ন হয়েছিল কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’-এর ছোট্ট একটা গবেষণাগারে। গবেষণার ক্ষেত্রে রমন নিজেই নিজের পথ খুঁজে নিয়েছিলেন। নিজের পৃথিবীর বাইরে এসে অনেক পৃথিবী তৈরি করাই একজন প্রকৃত গবেষকের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। গবেষণার ক্ষেত্রে গবেষকের কোনো সীমারেখা থাকবে না বরং বহুমাত্রিক বৈচিত্র্যের চিন্তাশীলতা থাকবে। তবেই দেশ গবেষণায় এগিয়ে যাবে।

লেখক : শিক্ষক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।

 

 

 

সর্বশেষ খবর