মঙ্গলবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

সত্যি সেটাই ছিল প্রণবদার সঙ্গে শেষ দেখা

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

সত্যি সেটাই ছিল প্রণবদার সঙ্গে শেষ দেখা

কারও মন এত খারাপ ও শরীর অসাড় হতে পারে ধারণায় ছিল না। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যার পর শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের আগে প্রায় দুই সপ্তাহ তেমন স্বাভাবিক বোধশক্তি ছিল না। বিষণ্নতায় সারা দেহ-মন ডুবে ছিল। কিছুই ভালো লাগত না। সুস্থভাবে কোনো কিছু ভাবতে পারছিলাম না। সে ছিল আকাশ-বাতাস উলট-পালট করা এক অস্বাভাবিক মৃত্যু। আর গত সোমবার ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি আমাদের প্রিয় মানুষ শ্রী প্রণব মুখার্জির স্বাভাবিক মৃত্যু আমাকে নিদারুণ এলোমেলো করে দিয়েছে। গত সোমবার লেখা পাঠানোর পর প্রণবদার মৃত্যু সংবাদ পাই। একটা শোকবার্তার জন্য বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজামকে ফোন করেছিলাম। ফোন ধরেই বলেছিল, ‘দাদা! লেখাটার কি কোনো অদলবদল করব?’ বলেছিলাম, না। যা আছে থাক। লিখেছিলাম, ‘আর কি দেখা হবে প্রণবদার সঙ্গে’। না, আর হলো না। ১৬ মার্চ, ২০১৬ প্রণবদার সঙ্গে ছিল শেষ দেখা। তিনি তখন ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি। তাঁর প্রিয় পত্নী আমার দিদি শুভ্রা মুখার্জি পরপারে চলে গেছেন। বড় একা হয়ে পড়েছিলেন তিনি। স্বামী-স্ত্রী যারা ভালো থাকেন, মিলেমিশে থাকেন তাদের একজন চলে গেলে অন্যজন বেশি দিন বাঁচেন না। এটাই প্রকৃতির রীতি। প্রণব মুখার্জি হিন্দুর ঘরে জন্মেছিলেন। আমি একজন নিষ্ঠাবান ধর্মপ্রাণ মুসলমানের সন্তান। আমি আল্লাহ-রসুল ছাড়া কিছু বিশ্বাস করি না, মানিও না। কিন্তু প্রণব মুখার্জিকে নিয়ে আমার বলতেই হবে, পরিচয়ের দিন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি যে হিন্দু আমার কাছে তেমন মনে হয়নি। কারণ তিনি আমার ঘরে আমার বিছানায় রাত কাটিয়েছেন, পূজা-অর্চনা আহ্নিক করেছেন। আমি তাঁর বাড়িতে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ আদায় করেছি। রাষ্ট্রপতি ভবনেও নামাজের সময় জায়নামাজ বিছাতে কোনো অসুবিধা হয়নি। ঢাকা মসজিদের শহর, দিল্লিও খুব একটা কম নয়। নামাজের সময় দিল্লির মসজিদ থেকে মাইকে আজানের ধ্বনি শোনা যায়। পুরনো দিল্লি তো ঢাকার মতোই, নতুন দিল্লিও খুব একটা কম নয়। মসজিদ মন্দির গুরুদুয়ায় ভরা। আজান শুনলেই দিদি বলতেন, ‘বাঘা! নামাজ পড়ে নাও।’ আমিও নামাজ পড়ে নিতাম। সেসব ভাবলে এখন বড় অবাক লাগে।

দিদি শুভ্রা মুখার্জির মৃত্যুর সংবাদ শুনেছিলাম বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমানের কাছে তাঁর অফিসে। মনে হয় ১২টা সাড়ে ১২টা হবে। আমি কী একটা কাজে গিয়েছিলাম। তিনি যখন অনেক বড় ছিলেন না, তখন তার সঙ্গে আমার পরিচয়। দিল্লিতে গিয়েছিলেন অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিম ও অন্যদের সঙ্গে। সেই থেকে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়। তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহের জামালপুরের মানুষ। তাঁর এক ভাই অ্যাডভোকেট খলিলুর রহমান সিরাজগঞ্জের আনোয়ার হোসেন রতু ভাইয়ের মেয়ে বিয়ে করেছেন। রতু ভাইয়ের সব থেকে ছোট মেয়ে ইমালদা হোসেন দীপা আমাকে বাবা বলে। সত্যিই সে আমার মেয়ের মতো। মেয়ে বাবাকে যতখানি ভালোবাসে, অনুভব করে সে তা থেকে মোটেই কম করে না। বাবা তার সন্তানদের যতটা ভালোবাসে আমিও দীপাকে ততটাই ভালোবাসি। কথা বলতে বলতেই হঠাৎ আতিউর রহমান বললেন, ‘আপনার একজন প্রিয় মানুষ চলে গেলেন।’ তিনি বললেন, ‘রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির স্ত্রী একটু আগে মারা গেছেন।’ আমার দেহমন নাড়া দিয়ে উঠেছিল। আর কথা এগোয়নি। বয়সী মানুষ, বাচ্চাদের মতো কাঁদতে পারি না। তবু বুকজুড়ে কান্না আসছিল। মা যেদিন মারা যান সেদিন যেমন শ্বাস নিতে পারছিলাম না, অনেকটা তেমনই লাগছিল। মনে হয় পরদিন টুঙ্গিপাড়া যাওয়ার কথা ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাড়ি ফিরে ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে ফোন করেছিলাম। অত সহজে পেয়ে যাব আশা করিনি। কিন্তু পেয়েছিলাম। ফোন পেয়ে বলেছিলেন, ‘বাঘা! মন খারাপ কোরো না। অতটা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকার চেয়ে চলে গেছেন, সেটাই ভালো। তুমি দোয়া কোরো। তোমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন, তোমাকে পেলে গীতা বড় খুশি হতেন। তোমার দোয়া নিশ্চয়ই কাজে লাগবে।’ সদ্য স্ত্রীহারা প্রণবদার কথা শুনে বেশ বিচলিত হয়েছিলাম। মানুষ বড় হলে মনে হয় তার শোকতাপ থাকে না, অন্যকে সান্ত্বনা দেওয়াই মূল কাজ হয়ে দাঁড়ায়। পুরো পরিবার নিয়ে পরদিন টুঙ্গিপাড়া পিতার কবরে গিয়েছিলাম। টুঙ্গিপাড়া থেকে ফিরে প্রণবদার ফোন পেলাম, ‘বাঘা! গীতার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে তুমি এসো।’ শ্রাদ্ধের আগে ২৭ আগস্ট, ২০১৫ দিল্লি গিয়েছিলাম। পরদিন ১৩ নম্বর তালকাটরা রোডে শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান। বাড়িতে ঢুকে প্রণবদার কাছে যেতেই মুন্নী ছুটে আসে। দাদা মুন্নীকে বললেন, ‘কাকুকে অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে যাও।’ ছেলে অভিজিৎ ও পিন্টু মুখার্জি খালি গায়ে আচার পালন করছিল। পুরোহিত আর ওদের থেকে ৪-৫ ফুট দূরে বসেছিলাম। ডানে-বাঁয়ে ছিলেন কংগ্রেসের মুখপাত্র আনন্দ শর্মা, হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রীর ছেলে এবং দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল।

 

রাষ্ট্রপতি ভবনে ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি লেখকের বই পড়ছেন ও লেখক

মানুষ পৃথিবীতে আসে, সময় হলে চলে যায়। কিন্তু স্মৃতি থাকে। স্মৃতি কোনোটা মধুর হয়, কোনোটা আবার তিক্ত। রাতে দাদার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম। আমি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে কথা বলেছিলেন তা হলো- ‘হাসিনা-রেহানার সঙ্গে তুমি থাকবে ভেবেছিলাম। হাসিনা তোমাকে ফেলে তোমার দিদির শেষকৃত্যে অংশ নেবে তা ভাবতে পারিনি। কারণ হাসিনার সঙ্গে তুমিই তোমার দিদির পরিচয় ঘটিয়েছিলে। আমরা তখন ৭ নম্বর তালকাটরা রোডে থাকতাম। তুমি তোমার গাড়িতে করে হাসিনাকে সেখানে নিয়ে এসেছিলে।’ হ্যাঁ, প্রণবদার ৭ নম্বর তালকাটরা রোডে আমি যেদিন প্রথম যাই সেদিন বাঘাকে দেখতে সবার আগে দিদি শুভ্রা মুখার্জি ছুটে এসেছিলেন। অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘বাঘা! তোমার কথা কত শুনেছি। কলকাতার আত্মীয়স্বজন মুক্তিযুদ্ধের সময় তোমার নামে পাগল ছিল, আজ দেখা হলো। কী সৌভাগ্য আমার।’ প্রণবদা আসার আগেই তিনি অটোগ্রাফের খাতা এগিয়ে দিয়েছিলেন, ‘বাঘা! একটা অটোগ্রাফ দাও তো।’ আমি তখনো তেমন লিখতে পারতাম না। স্বাক্ষর পর্যন্তই ছিল আমার বিদ্যা। তবু কেরাবেরা করে দুই কথা লিখেছিলাম। এই একই রকম আরেকজনকে অটোগ্রাফ দিয়েছিলাম। সে ঘটনাও বিচিত্র। ’৭৩ সালের শুরুর দিকে জিয়াউর রহমান তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপপ্রধান। কী এক কাজে তার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি গেছি। জিয়াউর রহমান বীরউত্তম বাড়ি ছিলেন না। ওর আগে আমি বেগম খালেদা জিয়াকে দেখিনি। আমি গিয়ে ড্রয়িংরুমে বসতেই তিনি ছুটে এলেন। অনেক কথাবার্তা বললেন। তারপর হঠাৎ করেই অটোগ্রাফ খাতা বের করে দিলেন। আমি কোনোভাবে দুই কথা লিখে স্বাক্ষর করেছিলাম। দুজন সেপাই তখন জিয়াউর রহমানের বাড়ির কাজ করছিল। হঠাৎ সালাম করে বলল, ‘স্যার! আমাদের বাড়ি ভূঞাপুর। আমরা আপনার বাহিনীতে ছিলাম।’ সেই সঙ্গে বলল, ‘বাড়িতে গিয়েছিলাম একটা ঘরের জন্য। চেয়ারম্যানের কাছে দুই বান্ডিল টিন চেয়েছিলাম, কিন্তু দেয়নি।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে দুজনকে পাঁচ পাঁচ দশ বান্ডিল টিন ও অন্যান্য জিনিস দেওয়ার কথা লিখে দিয়েছিলাম। তখন টিনের দাম ছিল ১৫০ টাকা বান্ডিল। ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে আমরা অনেক টিন নিয়েছিলাম। সেখান থেকে তাদের দেওয়া হয়েছিল। জিয়াউর রহমানের আসতে একটু দেরি হবে তাই ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিল এবং ব্রিগেড মেজর আবদুল গাফফার বীরউত্তম তাদের অফিসে নিয়ে গিয়েছিলেন। একটু পর জিয়াউর রহমান এলে আবার তার ঘরে নিয়ে আসা হয়। আলাপ-আলোচনা করে গাড়িতে বসলে হঠাৎই কেন যেন স্টার্ট হচ্ছিল না। নতুন গাড়ি, কিন্তু সেলফ নিচ্ছিল না। ধাক্কা দিয়ে স্টার্ট করতে হবে। যখন দু-তিন জন মিলে ধাক্কা দিচ্ছিলাম তখন জিয়াউর রহমানও হাত লাগিয়েছিলেন। আমি খুবই অভিভূত হয়েছিলাম। সেদিনের খালেদা জিয়ার অটোগ্রাফ নেওয়া, জিয়াউর রহমানের গাড়ি ধাক্কা দেওয়ার পরও যদি তেমন থাকত তাহলে কতই না ভালো হতো। এরও কদিন পর কী এক প্রয়োজনে প্রণবদার বাড়ি গিয়েছিলাম। দিদি বললেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মেয়েরা নাকি দিল্লিতেই থাকে। তুমি কি জানো তারা কোথায় থাকে? ওদের সঙ্গে একবার দেখা করা যায় না?’ বলেছিলাম, জানি। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তাড়াতাড়িই ব্যবস্থা করব। যারা আমাদের দেখাশোনা করতেন তাদের ব্যাপারটা বললে আমতা আমতা করছিলেন। একটু ওপরে কথা বললে মনে হয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় ব্যক্তি বললেন, ‘বেশ তো। একটা বাঙালি পরিবারের সঙ্গে কথাবার্তা হলে মন ভালো থাকবে। নিয়ে যান। দেখা করিয়ে আনুন।’ মনে হয় এক বা দুই সপ্তাহের মধ্যেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোন শেখ হাসিনাকে ৭ নম্বর তালকাটরা রোডে নিয়ে গিয়েছিলাম। শুভ্রাদি তো খুশি হয়েছিলেনই আমার বোনও কম খুশি হননি। সেই থেকে তাদের পরিচয় গভীর হয়। কত হবে, তিন বছরের মধ্যেই কংগ্রেস আবার ক্ষমতায় আসে। কংগ্রেসের দুঃসময় কেটে যায়, ইন্দিরাজির সুদিন। সেই সঙ্গে প্রণবদারও। প্রণবদা বাণিজ্যমন্ত্রী হয়ে ২ নম্বর যন্তরমন্তর রোডের বাড়িতে যান। যন্তরমন্তর সূর্যঘড়ির জন্য বিখ্যাত। গুলালের মতো বাঁকা মস্ত বড় এক দেয়াল। যেটায় সূর্যের আলো পড়তেই দাগ কাটা চিহ্ন দেখে সময় বলে দেওয়া যায়। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছি মিনিট তো দূরের কথা সেকেন্ডেরও গরমিল হয় না। প্রণবদা যত দিন যন্তরমন্তর রোডের বাড়িতে ছিলেন তত দিন তাঁর সকালে খবরের কাগজ পড়ার সাথী ছিলাম। ৬টা-সাড়ে ৬টায় তিনি বাগানে বসতেন। ভারতের সমস্ত পত্রিকা এক-দেড় ঘণ্টা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন। আমিও পড়তাম। চা আসত, নাশতা আসত, ফল আসত। দু-এক বার দিদি আসতেন, স্কুলে যাওয়ার সময় পিন্টু, মুন্নী আসত। অভিজিৎ তখন এইট-নাইনে, মুন্নী থ্রি-ফোর, পিন্টু কেবল স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। পিন্টুকে দিদি পালতে এনেছিলেন। কুড়িয়ে পাওয়া সন্তানের মা হওয়া দিদির শখ। মৃত্যুর সময়ও তিন-চারটা পালক সন্তান রেখে গেছেন। একদিন দাদা-দিদি প্রগতি ময়দানের কাছে যমুনার পাড়ে হাঁটছিলেন। সেই প্রাতর্ভ্রমণে পরিত্যক্ত পিন্টুকে পেয়েছিলেন। সেই পিন্টুকে লেখাপড়া শিখিয়ে বিয়ে দিয়েছিলেন। মৃত্যুর সময় সেই পিন্টুর স্ত্রী দিদিকে সবচাইতে বেশি দেখাশোনা করেছে আর করেছে ভাই বউ খোকনের স্ত্রী। ওদের দেখাশোনা করার কথা ভোলা যায় না। পিন্টুর বিয়েতে প্রণবদা নিজে ফোন করে দাওয়াত করেছিলেন। কার্ড পাঠিয়েছিলেন। তিনি তখন দেশরক্ষা মন্ত্রী। সেনাবাহিনীর সুবার্ত পার্কে গিয়েছিলাম। তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন এ পি জে আবদুল কালাম। সোনিয়া গান্ধী, অটল বিহারি বাজপেয়ি, লালকৃষ্ণ আদভানি কার সঙ্গে দেখা হয়নি সেখানে। সে এক এলাহি কারবার। খুব উৎসাহ নিয়ে প্রণবদা পিন্টুর বিয়ে দিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানে আমার যাওয়া নিয়ে প্রণবদা লম্বা বক্তব্য দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ থেকে আমি গেছি, মুক্তিযুদ্ধে আমার ভূমিকা, বঙ্গবন্ধুর কত কাছের ছিলাম, ইন্দিরাজি কতটা ভালোবাসতেন এসব বলে আমাকে তো তিনি তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আমি একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছিলাম। কী ভালোই যে বাসতেন। তাঁর কোনো অহমিকা ছিল না। তাঁকে যেমন হুতাশহীন নিঃস্ব দেখেছি আবার ক্ষমতার শীর্ষেও দেখেছি। কিন্তু মানুষ হিসেবে কোনো বদল দেখিনি। ’৮৯ সালে আমি যখন ইংল্যান্ডে যাই তখন আমার বোন মাননীয় সভানেত্রী ঢাকা থেকে সাজেদা চৌধুরীকে পাঠিয়েছিলেন। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী আর অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান গিয়েছিলেন। দিল্লি থেকে গলফ এয়ারে লন্ডনে গিয়েছিলাম। তাই প্রণবদাকে বলেছিলাম, আপনাদের কাউকে লিখে দিন আমাকে সাহায্য করতে। তিনি স্বরাজ পালকে ছয়-সাত লাইনের একটা চিঠি লিখেছিলেন। তার মূল কথা ছিল, ‘টাইগার আমাদের খুবই প্রিয়। ইন্দিরাজি ওকে খুব ভালোবাসতেন। পারলে ওকে সহায়তা কোরো।’ লন্ডনে গিয়ে চিঠিটা পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। হঠাৎ একদিন রাতে জাগোয়া গাড়ি নিয়ে স্বরাজজি এসে হাজির। তখন তিনি পৃথিবীর ২০-৫০ জন ধনীর মধ্যে একজন। একটা ইনভেলাপে আমাকে ১০ হাজার পাউন্ড দেন। আমি বলেছিলাম, এ দিয়ে এখন আমি কী করব? আমার তো এখানে টাকার দরকার নেই। ইচ্ছে হলে যাওয়ার সময় দেবেন। তিনি বারবার বলছিলেন, ‘আপনি এটা রাখুন। যাওয়ার সময় অবশ্যই দেব। শুধু যাওয়ার সময় কেন, যখন আপনার প্রয়োজন তখনই বলবেন। আমাকে পেতে অসুবিধা হলে আমার স্ত্রীকে বলবেন। সেজন্যই তাকে নিয়ে এসেছি।’ অনেক বলে-কয়ে শেষে ১ হাজার পাউন্ড রেখে বাকিটা ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। নিতে চাচ্ছিলেন না। বারবার বলছিলেন, ‘দাদা চিঠি দিয়েছেন। আপনার যদি টাকা-পয়সার কোনো অসুবিধা হয় তখন মুখ দেখাব কী করে?’ বলেছিলাম, এখানে মানুষ এত ভালো জানা ছিল না। দেখা করতে এলেই টাকা দেয়। সকালে দরজার নিচে যেমন পত্রিকা পাই তেমনি ইনভেলাপে চিঠির বদলে টাকা পাই। যেদিন লন্ডন থেকে চলে আসি সেদিন এয়ারপোর্টে এসে স্বরাজ পাল ২০ হাজার পাউন্ড দিচ্ছিলেন। আমি আঁতকে উঠেছিলাম এত টাকা কী করে নেব! এমনিতেই তখন আমার কাছে ৭-৮ হাজার পাউন্ড ছিল। এখন তো পাউন্ড এক শ কয়েক টাকা। তখন ছিল ১৪০ টাকার ওপরে। স্বরাজজিকে বলেছিলাম, আমি তো এটা নিতে পারছি না। দিল্লি অথবা কলকাতায় কাউকে দিতে বলবেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে একটা ফোন নম্বর দিয়ে দুই কথা লিখে দিয়েছিলেন। এ ছিল প্রণবদার ছোট্ট চিঠির ক্ষমতা।

প্রয়াত প্রণব মুখার্জিকে নিয়ে এক লেখায় শেষ হবে না। আগে যখন দাদাকে নিয়ে কিছু লিখতে যেতাম কলম হরহর করে চলত, থামতে চাইত না। গত সোমবার আর আজ মঙ্গলবার হাত-পা-মাথা-মস্তিষ্ক সব যেন অচল হয়ে গেছে। কিছুই কাজ করতে চাচ্ছে না। কত কথা লিখতে হবে- কত দুঃখের কথা, আনন্দের কথা। আশা করি লিখতে পারব। অনেকে মনে করে শুরু থেকেই প্রণবদা বিশাল ছিলেন। তা কিন্তু নয়। বাংলা কংগ্রেস থেকে তিনি রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। তাঁর বাবা কামদাকিঙ্কর মুখার্জি একজন ত্যাগী নেতা ছিলেন। জেল খেটেছেন অনেক বছর। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার দুবার সদস্য ছিলেন। সে হিসেবে রাজনীতি ছিল তাঁর রক্তে। তাই রাজনীতির সঙ্গে থেকেই মাস্টারি করতেন, সাংবাদিকতাও করেছেন। ’৭৩-এ ইন্দিরাজি তাঁর এক বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হয়ে দিল্লি ডেকে নিয়েছিলেন। তারপর তিনি আর পিছে ফিরে তাকাননি। প্রণবদা সর্বভারতীয় মস্ত বড় নেতা হয়ে উঠেছিলেন ’৭৭-এ ইন্দিরাজির ক্ষমতা হারানোর পর।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

 

সর্বশেষ খবর