ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা ব্রিটিশ শাসন পাকাপোক্ত করতে যারা ভূমিকা রেখেছেন তার অন্যতম ওয়ারেন হেস্টিংস। প্রথমে ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর এবং পরে গভর্নর জেনারেল (১৭৭৪-১৭৮৫) হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ওয়ারেন হেস্টিংস ভারতে রাজনৈতিক প্রাধান্য স্থাপনের ব্যাপারে তাঁর পূর্বসূরিদের অনুসৃত দ্বিধাগ্রস্ত নীতি পরিহার করেন। রাজ্যবিস্তারে প্রতিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণে তিনি কোনো ধরনের শৈথিল্য প্রদর্শন না করে নতুন নতুন এলাকা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। বস্তুত ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্য বিস্তারের কৃতিত্ব তাঁর। তা সত্ত্বেও ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কতগুলো অভিযোগ উত্থাপন করে তাঁর বিচারের প্রয়াস পায়। এসব অভিযোগের মধ্যে ছিল দুর্নীতি, অত্যাচার ও অননুমোদিত যুদ্ধ ঘোষণা। ১৭৮৫ সালে দেশে ডেকে পাঠিয়ে পার্লামেন্টে তাঁর বিচার করা হয়, তবে তিনি শেষ পর্যন্ত নিষ্কৃতি লাভ করেন।
১৭৩২ সালের ৬ ডিসেম্বর ওয়ারেন হেস্টিংস অক্সফোর্ড সায়ারের চার্চিলে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারে অর্থ সংকটের কারণে এক পিতৃব্য তাঁর ভরণপোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ পিতৃব্য তাঁকে লন্ডনে নিয়ে আসেন এবং ওয়েস্টমিনস্টারের একটি স্কুলে ভর্তি করে দেন। স্কুলে তিনি অসাধারণ মেধার পরিচয় দেন। স্কুলের পাঠ সমাপনান্তে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে একটি সামান্য চাকরিতে যোগদান করে বাংলায় আসেন। ১৭৫০ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি কলকাতা পৌঁছেন। এ সময় কাশিমবাজার ছিল রেশমি বস্ত্র সংগ্রহের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। তাঁর প্রথম কর্মস্থল হিসেবে হেস্টিংসকে সেখানে পাঠানো হয়। ১৭৫৬ সালে সিরাজউদ্দৌলা যখন কলকাতা আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হন হেস্টিংস তখন কাশিমবাজারে ছিলেন। সিরাজ পথিমধ্যে কাশিমবাজার দখল করেন এবং সেখানকার ব্রিটিশদের বন্দী করেন। সিরাজের কলকাতা দখলের পর সেখান থেকে পলায়ন করে যেসব ব্রিটিশ ফলতায় আশ্রয় নিয়েছিলেন বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে হেস্টিংস তাঁদের সঙ্গে মিলিত হন। সেখানে তিনি মেরি নাম্নী এক বিধবাকে বিয়ে করেন। মেরির সাবেক স্বামী সিরাজের কলকাতা অবরোধের সময় নিহত হয়েছিলেন। মেরির গর্ভে হেস্টিংসের যে দুটি সন্তান জন্মায় তারা অচিরেই মারা যায়।
১৭৫৮ সাল থেকে হেস্টিংস মুর্শিদাবাদে নতুন নবাব মীরজাফরের দরবারে কোম্পানির রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৭৬০ সালে কোম্পানি মীরজাফরকে সরিয়ে তাঁর জামাতা মীর কাসিমকে নবাবি দান করে। কিছুদিন পরই হেস্টিংস কলকাতা গিয়ে গভর্নর হেনরি ভ্যানসিটার্টের কাউন্সিল সদস্য হন। ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে নবাবকে কতটুকু ক্ষমতা দেওয়া হবে এ ব্যাপারে কাউন্সিল ছিল দ্বিধাবিভক্ত। হেস্টিংস গভর্নরের পক্ষাবলম্বন করেন। হেস্টিংস ও ভ্যানসিটার্ট এ বিষয়ে ছিলেন নমনীয়। নবাবের সঙ্গে কোম্পানির বিরোধ শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে পর্যবসিত হয় এবং পরিণামে নবাব বাংলা থেকে বিতাড়িত হন। ভ্যানসিটার্ট পদত্যাগ করে দেশে চলে যান এবং ১৭৬৫ সালে হেস্টিংসও তাঁকে অনুসরণ করেন।বিলেতে হেস্টিংস কোম্পানির ভবিষ্যৎ ভারতনীতি প্রভাবিত করার এবং একটা সম্মানজনক পদে অধিষ্ঠিত হয়ে উপমহাদেশে প্রত্যাবর্তনের চেষ্টা করেন। ১৭৬৮ সালে মাদ্রাজের ফোর্ট সেন্ট কাউন্সিলের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে হেস্টিংস নিয়োগ লাভ করেন।
গ্রন্থনা : জাফর খান।