শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু প্রণব মুখার্জি

হাসানুল হক ইনু

বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু প্রণব মুখার্জি

‘ভারতরত্ন’ প্রণব কুমার মুখোপাধ্যায় [প্রণব মুখার্জি] গত ৩১ আগস্ট দিল্লির সেনা হাসপাতালে চিকিৎসকদের সব প্রচেষ্টার পরও সবাইকে ছেড়ে মহাপ্রয়াণের পথে চলে যান। তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় পরদিন ১ সেপ্টেম্বর পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়।

পাঁচ দশকের রাজনৈতিক জীবনে তিনি সর্বস্তরের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। রাজনীতি, সমাজনীতি, কূটনীতি থেকে শুরু করে সাহিত্য-সংস্কৃতি- সব ক্ষেত্রেই তাঁর অবাধ স্বচ্ছন্দ ও বিচরণ ছিল। কারাবরণকারী সংগ্রামী ব্রিটিশবিরোধী কংগ্রেসি কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের পুত্র প্রণব মুখার্জির জন্ম ১১ ডিসেম্বর, ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে; পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার কীর্ণাহার শহরের কাছে মিরাটি গ্রামে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর স্নেহধন্য প্রণব মুখার্জি ১৯৬৯ সালে ভারতের রাজ্যসভায় প্রবেশ করার পর থেকে তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রথম বাঙালি হিসেবে তিনি ২০১২ সালে ভারতের ১৩তম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১৭ সালের ২৫ জুলাই অবসরে যান।

‘ভারতরত্ন’ প্রণব মুখার্জি উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ইতিহাসের নানা টানাপড়েনে তিনি সব সময় ছিলেন ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব রক্ষার ও তাকে অগ্রসর করার পক্ষে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রণব মুখার্জির বলিষ্ঠ ভূমিকা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে ভারত হারাল এক মহান রাষ্ট্রনায়ক; উপমহাদেশ হারাল একজন রাজনৈতিক অভিভাবক; বাংলাদেশ হারাল একজন অকৃত্রিম সুহৃদ, বন্ধু ও আপনজন; এবং আমি হারালাম একজন প্রজ্ঞাবানের সাহচর্য। প্রণব মুখার্জির মহাপ্রয়াণে একটি যুগের অবসান হলো।

প্রণব মুখার্জি খুবই বিনয়ী ছিলেন। স্বাধীনতার পর তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। রাজনীতিতে আমি তখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদেও নেই। তার পরও যতবার ভারতে গিয়েছি ততবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে- দিল্লি ও কলকাতায় তাঁর নিজ বাসভবনে আর মন্ত্রীর সরকারি বাসা ১৩ তালকাটোরা রোডে। এমনকি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও রাষ্ট্রপতি ভবনে বেশ কয়েকবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। তিনি সময় দিতেন; সেসব সৌজন্য সাক্ষাতের মতো আনুষ্ঠানিক ছিল না; প্রতিবারই এক ঘণ্টার বেশি বৈঠক হতো। তিনি ভালো শ্রোতা ছিলেন। আমি কথা বলে আনন্দ পেতাম ও সন্তুষ্ট হতাম। ফোনে তাঁকে পাওয়া যেত সরাসরি। নিজেই ফোন ধরতেন। আমার এখনো বেশ মনে আছে, লোকসভা নির্বাচনের দিন পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গিপুরে শেষ বিকালে প্রণব দাদা নিজেই ফোন ধরলেন। বললেন ভোটের ব্যবধান ভালো, বিজয়ের দিকে যাচ্ছেন। এত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি ফোন ধরবেন, বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু ফোন ধরলেন, কথা বললেন। এটা যে কেবল আমার বেলায় প্রযোজ্য, তা নয়। অনেকেই তাঁকে ফোনে পেতেন। এই হচ্ছেন প্রণব মুখার্জি; নিরহংকার সজ্জন একজন ব্যক্তি। তাঁর কাছে পৌঁছানো যায়। সহজেই তাঁকে কাছে পাওয়া যায়, সহজেই তাঁর কাছে যাওয়া যায়, সহজেই দেখা-সাক্ষাৎ করা যায়।

অনানুষ্ঠানিক ও ঘরোয়াভাবে অনেকবার দেখা-সাক্ষাৎ হলেও শুধু একবার দিল্লিতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রণব মুখার্জির সঙ্গে আমার একই মঞ্চে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল, ২০১৭ সালের জুনের প্রথম সপ্তাহে রাষ্ট্রপতি ভবনের মিলনায়তনে। একসময়ের ভারতের বিদেশ সচিব মুচকুন্দ দুবের বাউল লালন শাহর শতাধিক গানের হিন্দি তরজমার বই ও গানের সিডির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রধান অতিথি হন এবং আমি ছিলাম বিশেষ অতিথি। ২০১৮ সালে শেষবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয় ঢাকায়। বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। চমৎকার ভাষণ দেন। হোটেল সোনারগাঁওয়ে দলের নেতৃবৃন্দসহ দেখা করি তাঁর সঙ্গে। যতবার দেখা হয়েছে ততবারই একটা বিষয় আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে- অসাম্প্রদায়িকতা ও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক। তিনি সব সময় বলতেন, অসাংবিধানিক প্রক্রিয়া যে কোনো দেশের জন্য ও উপমহাদেশের জন্য একটা অভিশাপ।

প্রণব মুখার্জি বই পড়তে ভালোবাসতেন। বাংলাদেশের লেখকদের বই পড়তেন ও সংগ্রহ করতেন। তিনি বইয়ের নাম ও লেখকের নাম বলতেন। প্রতিবারই আমি কিছু বই নিয়ে যেতাম এবং তাঁকে উপহার দিতাম। শেষবার তাঁকে শতাধিক বই একসঙ্গে দিয়ে আসি। তিনি অনেকক্ষণ ধরে বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখেন। খুব খুশি হয়েছিলেন। তিনি বলতেন, A Politician must read poetry to keep his mind alive and Sensitive.  অর্থাৎ ‘একজন রাজনীতিককে অবশ্যই কবিতা পড়তে হবে মনকে জীবন্ত ও সংবেদনশীল রাখতে।’ আবার বলতেন, Education without values is like a flower without fragrance. অর্থাৎ, ‘মূল্যবোধ ছাড়া শিক্ষা গন্ধহীন ফুলের মতো।’ এসব তিনি বলার জন্য বলেননি; বিশ্বাস থেকে বলতেন; নিজ জীবনেও তা লালন করতেন। তাই তিনি রাজনীতির বটবৃক্ষ, আবার জ্ঞানের মহিরুহও। তাই অনেকে তাঁকে দার্শনিক রাজনীতিকও বলে থাকেন।

বাংলাদেশের জন্য প্রণব মুখার্জির অনেক দরদ ছিল। তবে আমার বিবেচনায় চারটি বিষয়ে তাঁর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

প্রথমত, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা প্রশংসনীয়। প্রণব মুখার্জি তাঁর লেখা ‘দ্য ড্রামাটিক ডিকেড : দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ারস’ বইয়ে বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ভারতের ভিতরে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের পক্ষে ইন্দিরা গান্ধীর জোরালো কূটনৈতিক যুদ্ধে ৩৬ বছর বয়সী প্রণব মুখার্জি সম্মুখযোদ্ধার ভূমিকা রাখেন। কিন্তু ’৭১ সালের জুনে রাজ্যসভায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য তাঁর ওকালতির বিষয়টি বিশেষভাবে সবার নজর কাড়ে। বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘১৯৭১ সালে রাজ্যসভার বাজেট অধিবেশনে আমি বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ নিই। আমি বলেছিলাম, ভারতের উচিত বাংলাদেশের প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়া। আমি সংসদকে এও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে, বিশ্ব ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনায় হস্তক্ষেপ করার বহু নজির আছে।’ পরে ভারত তা-ই করে।

দ্বিতীয়ত, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড এবং সামরিক শাসকদের ক্ষমতা জবরদখলের ঘটনা বাংলাদেশকে পাকিস্তানপন্থা ও সাম্প্রদায়িকতার পথে ঠেলে দেয়। বারবার সামরিক শাসনের ছোবলে ক্ষতবিক্ষত বাংলাদেশ সব দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়তে থাকে। সর্বশেষ ২০০৭-০৮ সালে জেনারেল মইন উদ্দিন ও ফখরুদ্দীনের আধাসামরিক শাসনকালে প্রণব মুখার্জি ছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ২০০৭-০৮ সালের জরুরি অবস্থার সময়কার পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে উল্লিখিত বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘... আমি যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী; বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেওয়ার ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে ভারত সহায়তা করেছিল।’ পরের ইতিহাস সবার জানা। ২০০৮ সালের শেষে অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্থা হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, এরশাদের জাতীয় পার্টি, জাসদসহ মহাজোট বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার গঠন করে। বাংলাদেশের নতুন যাত্রা- পাকিস্তানপন্থা থেকে ফেরত যাত্রা- শুরু হয়। বাংলাদেশ আবার ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশের পথে চলতে শুরু করে। সংবিধানে চার মূলনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়, যুদ্ধাপরাধের বিচার ও সাজাসহ সাম্প্রদায়িক জঙ্গি সন্ত্রাস দমন হয়। সীমান্ত-সন্ত্রাসের সব চক্রান্ত স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। অসাংবিধানিক সামরিক শাসনের ধারা থেকে নির্বাচন ও সাংবিধানিক ধারায় প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই একটা মোড় বদলের ইতিবাচক ও ফলপ্রসূ রাজনৈতিক বিষয়।

তৃতীয়ত, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বেশ কিছু দ্বিপক্ষীয় সমস্যা আছে যার নিষ্পত্তি দরকার। কিছু নিষ্পত্তি হয়েছে। এসব ঝুলে থাকা সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে উজান থেকে বয়ে আসা ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদ-নদীর পানি বণ্টন; এর মধ্যে আবার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বহমান গঙ্গা-পদ্মার পানি ব্যবস্থাপনা। আমি সব সময় বলি, ভারত-বাংলাদেশের সহযোগিতায় অনেক সমস্যার সমাধান হয়েছে, কিন্তু ওগুলো হচ্ছে সহযোগিতার ছোট ছোট জানালা খোলার ঘটনা; সহযোগিতার সোনার সদর দরজা খোলার সোনার চাবি হচ্ছে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার পানি ব্যবস্থাপনার ঐক্যবদ্ধ স্থায়ী সমাধানের চুক্তি। গঙ্গা-পদ্মার পানি বণ্টনের সমাধান- সে সোনার চাবিটা হাতে নেওয়ার প্রথম উদ্যোগ। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর সরকার একটা পদক্ষেপ নেয়। পরে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান আরেকটা উদ্যোগ নেন। কিন্তু ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর গঙ্গা-পদ্মার পানি বণ্টন বিষয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও একটি কার্যকর চুক্তি সম্পাদনে সফল হন। যে কোনো দুই দেশের বিরাজিত সমস্যা সমাধানে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য, ব্যক্তি-ব্যক্তি সম্পর্ক ও প্রচেষ্টা দরকার হয়। গঙ্গা-পদ্মার পানি বণ্টনের চুক্তি সম্পাদনে প্রণব মুখার্জির ভূমিকা ছিল খুবই ইতিবাচক; এতে অনুঘটক হিসেবে তিনি সফলতা প্রদর্শন করেছেন। আমি মনে করি প্রণব মুখার্জির প্রচেষ্টা বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও গভীর করতে সাহায্য করেছে।

চতুর্থত, সন্ত্রাসবাদ একটা বিশ্ব-বিপদ। উপমহাদেশেও তা আতঙ্ক ছড়ায়। আন্তসীমান্ত সন্ত্রাসও [cross-border terrorism] দুই দেশের শান্তি বিনষ্ট করে। ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদের উপর্যুপরি সামরিক শাসন এবং বেগম খালেদা জিয়া ও জামায়াতের শাসনকাল সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গি সাম্প্রদায়িকতাকে লালন-পালন করত এবং তাদের সময় আন্তসীমান্ত সন্ত্রাসকেও উৎসাহিত করা হতো। এটা বাংলাদেশের জন্য ভালো নয়; প্রতিবেশীর জন্যও ভালো নয়। রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় [non-state] উভয় ধরনের সন্ত্রাসবাদ শান্তির শত্রু। সন্ত্রাসবাদের বিপদ ও হুমকি থেকে উপমহাদেশকে মুক্ত করার জন্য প্রণব মুখার্জি সব সময় জোরালোভাবে সোচ্চার ছিলেন। বিশেষ করে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভিতর আন্তসীমান্ত-সন্ত্রাস একটা বিষাক্ত কাঁটা; এটা উপড়ে ফেলা কর্তব্য। তাহলে দুই দেশের অবিশ্বাসের জায়গাটা কমে যাবে, বিশ্বাসের খুঁটি আরও পোক্ত হবে। তাই প্রণব মুখার্জি বলেছেন, Let us not forget that terrorism knows no borders. All of us are vulnerable to terrorist attacks. অর্থাৎ ‘আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, সন্ত্রাসবাদের কোনো সীমান্ত নেই। আমরা সবাই সন্ত্রাসী হামলার মুখে বিপন্ন।’

দ্বিপক্ষীয় প্রতিবেশী-সম্পর্ক বিষয়ে প্রণব মুখার্জি বলেছেন, Neighbours may have disagreements; tension can be a subject of frontiers. But sponsorship of terrorism through non state actors is a matter of deep concern to the entire nation. অর্থাৎ, ‘প্রতিবেশীর মধ্যে ভিন্নমত থাকতে পারে; উত্তেজনা একটি সীমান্ত-বিষয়ও হতে পারে। কিন্তু অরাষ্ট্রীক [non-state actors] চক্রের পৃষ্ঠপোষকতার মধ্য দিয়ে পরিচালিত সন্ত্রাসবাদ সমগ্র জাতির জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়।’ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ পরিচালিত হওয়ার পর থেকে এ ধরনের সন্ত্রাসবাদের বিষাক্ত কাঁটা উপড়ে ফেলার সুযোগ আসে। প্রণব মুখার্জি সন্ত্রাসবাদমুক্ত ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক গড়তে বিশেষ ভূমিকা রাখেন; যা উভয় দেশের জন্য মঙ্গলজনক হয়েছে।

সন্ত্রাসবাদ শুধু উপমহাদেশ নয়, পুরো বিশ্বের জন্য বিপদ; সেজন্য উভয় দেশের একসঙ্গে কাজ করা দরকার। প্রণব মুখার্জি তাই বলেছেন, the age of war is not over. We are in the midst of the fourth world war; the Third was cold war. The war against terrorism is the fourth, and it is a world war because it can raise its evil head anywhere in the world. অর্থাৎ, ‘যুদ্ধের কাল শেষ হয়ে যায়নি। আমরা চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে আছি; তৃতীয়টি ছিল শীতলযুদ্ধ। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটি হচ্ছে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ এবং এটা একটা বিশ্বযুদ্ধ এজন্য যে, এ অশুভ যুদ্ধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে বিশ্বের যে কোনো জায়গায়।’ ঠিক কথা। তাই ভারত, বাংলাদেশসহ সব শান্তিকামী দেশ ও জনগণের ঐক্য দরকার সন্ত্রাসবাদ দমনে।

প্রণব মুখার্জি দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে মাথা ঘামাতেন নিরন্তর। সম্পর্ক রক্ষা ও গড়ার দৃষ্টিভঙ্গি কী হওয়া উচিত সে বিষয়ে তাঁর স্পষ্ট পরামর্শ ছিল। তিনি বলেছেন, We can change our friend if we so desire. We cannot change our neighbours. They are going to stay where they are. It is for us to decide whether we will live in perpetual tensions without neighbours or in peace. The choice is ours. অর্থাৎ, ‘চাইলে আমরা বন্ধু পরিবর্তন করতে পারি। আমরা প্রতিবেশী পরিবর্তন করতে পারি না। তারা যেখানে আছেন সেখানেই থাকবেন। এটা আমাদেরই ঠিক করতে হবে যে, আমরা প্রতিবেশীহীন চিরস্থায়ী উত্তেজনার মধ্যে থাকব, নাকি তাদের নিয়ে শান্তিতে থাকব। পছন্দ আমাদের নিজেদের ব্যাপার।’ এটা খুব বাস্তববাদী বক্তব্য। আমি এর সঙ্গে যুক্ত করে বলি- হ্যাঁ, স্ত্রী বা স্বামী বদল করা যায়, কিন্তু প্রতিবেশী বদল করা যায় না; প্রতিবেশীর সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করার সংস্কৃতি রপ্ত করা তাই আমাদের অবশ্য-কর্তব্য।

প্রতিবেশীর সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করার সংস্কৃতিটি ভারত-বাংলাদেশ উভয় সরকারেরই রপ্ত করা উচিত। মনে রাখতে হবে, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের বাঁধন ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ঝরা রক্তে; এ বাঁধন ছিন্ন হতে পারে না। তা ছাড়া ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক উপমহাদেশের শান্তি-স্থিতি-উন্নয়নের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। ২০১৭ সালের জুনে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে মুচকুন্দ দুবে’র লালনের হিন্দি অনুবাদের বইয়ের উদ্বোধনকালে মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বলেন, ‘অসাম্প্রদায়িকতা, মানবতা ও ধর্মনিরপেক্ষতাই ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের প্রকৃত মেলবন্ধন হওয়া উচিত; লালন শাহ তাঁর যোগ্য প্রতিনিধি।’ প্রণব মুখার্জি আজ নেই; কিন্তু তাঁর দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য ও উক্তি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে আরও উচ্চতর থেকে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যেতে বাতিঘরের মতো পথ দেখাবে। রাজনৈতিক-সামাজিক অঙ্গনে প্রণব মুখার্জির বিচরণ পাঁচ দশক ধরে। আমার পক্ষে তাই তাঁর যথার্থ মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। তাঁর পরও আমার উপলব্ধিতে, তথ্য-উপাত্ত দেখে তাঁকে যেভাবে বুঝেছি সে বোঝাগুলো হচ্ছে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।

প্রণব মুখার্জি সারা জীবন অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র ও মানবতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন। সমাজবাদী অর্থনীতিতে অনুরক্ত ছিলেন। দক্ষিণ এশিয়ায় সমমর্যাদার ভিত্তিতে সম্মানজনক পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন।

গণতন্ত্রকে তিনি সংখ্যাগুরুর আধিপত্য হিসেবে দেখতেন না; পরমতসহিষ্ণুতার ও বিরুদ্ধমত তুলে ধরার স্বাধীনতা মনে করতেন। তিনি বলেন, The defining feature of any democracy is that it replaces the rule of men by the rule of Law and achieves this by creating institutions of government and processes for their functioning.  অর্থাৎ, ‘যে কোনো গণতন্ত্রের নির্ধারক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, তা ব্যক্তি-শাসনকে আইনের শাসনে পরিণত করে এবং তা অর্জন করা হয় সরকারি প্রতিষ্ঠান তৈরি ও তা কার্যকরের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।’ আবার আর এক বক্তব্যে তিনি বলেন, Democracy breaths through a vibrant parliament, an independent judiciary, a responsible media, a vigilant civil society. It survives through accountability, not profligacy. অর্থাৎ, ‘গণতন্ত্র শ্বাস-প্রশ্বাস নেয় প্রাণবন্ত সংসদ, একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, একটি দায়িত্বশীল গণমাধ্যম এবং এক সজাগ নাগরিক সমাজের মধ্য দিয়ে। তা বেঁচে থাকে জবাবদিহির ভিতর দিয়ে, স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে নয় ...।’

উপমহাদেশে গণতন্ত্রের অনেক সংগ্রাম হয়েছে; কিন্তু এখনো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ যথাযথভাবে শিকড় গাড়েনি। প্রণব মুখার্জির কথার সুর ধরে আমিও বলি, গণতন্ত্র হচ্ছে আইনের শাসন, স্বশাসন ও সুশাসন। আর আইনের শাসন মানেই হচ্ছে গণতন্ত্রের সীমা আছে। আমি তাই বলি, গণতন্ত্র হচ্ছে মশারি ঢাকা একটা আরামদায়ক বিছানা, যেখানে শুয়ে বসে বাইরের সব কিছু দেখা যায়, বাইরে থেকেও সব দেখা যায়, কিন্তু পোকা-মাকড়-মশা-মাছি বিছানায় ঢুকতে পরে না।

প্রণব মুখার্জি গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও দুর্নীতি- এ তিনের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টি চমৎকারভাবে নির্ধারণ করে বলেছেন, There can be no democracy without secularism.  অর্থাৎ, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া কোনো গণতন্ত্র নেই।’ এবং, Corruption is a cancer that erodes democracy and weakens foundation of our state. অর্থাৎ, ‘দুর্নীতি হচ্ছে ক্যানসার যা গণতন্ত্রের ক্ষয় সাধন করে এবং আমাদের রাষ্ট্রীয় ভিত দুর্বল করে দেয়।’ সুতরাং উপমহাদেশে যারা এক মুখে গণতন্ত্রের কথা বলেন, আর আরেক মুখে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বর্জন করেন; আবার যারা দুর্নীতিকে অর্থনীতির সহসঙ্গী মনে করে নীরব থাকেন; তারা আর যাই হোন, গণতন্ত্রী নন। তাদের হাতে গণতন্ত্র কখনই নিরাপদ নয়। এসব মুখোশধারী উপমহাদেশে বিভাজনের রাজনীতি করেন এবং অশান্তির বীজ বপন করেন।

বৈষম্য ও দারিদ্র্য সমাজ ও গণতন্ত্রকে নড়বড়ে করে তোলে। তাই গণতন্ত্র মজবুত হবে যদি বৈষম্য কমে যায়, দারিদ্র্য উচ্ছেদ হয়। প্রণব মুখার্জি তাই বলেন, Poverty has no religion, hungry has no creed, and despair has no geography... We must not be satisfied with mere poverty alleviation. We must commit ourselves to the goal of poverty elimination. অর্থাৎ, ‘দারিদ্র্যের কোনো ধর্ম নেই, ক্ষুধার কোনো মতবাদ নেই এবং হতাশার কোনো ভূগোল নেই। আমাদের কেবল দারিদ্র্য দূরীকরণে সন্তষ্ট থাকা উচিত নয়, আমাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে দারিদ্র্য নির্মূলের লক্ষ্যে।’ অন্য আর এক জায়গায় তিনি বলেন, There is no humiliation more abusive than hunger. Trickle down theories do not address the legitimate aspirations of the poor... অর্থাৎ, ‘ক্ষুধার মতো অবমাননাকর নিপীড়ন আর নেই। অর্থনীতির চুইয়ে পড়া তত্ত্ব গরিবদের ন্যায্য আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে না।’ এসব প্রণব মুখার্জির জীবনের কথার কথা নয়। তিনি বাস্তবে তার চর্চাও করতেন। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে দম্ভ মনে করতেন না এবং প্রদর্শনের বিষয়ও ভাবতেন না। জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ককে তিনি বেশি গুরুত্ব প্রদান করতেন।

প্রণব মুখার্জি সমঝোতার কারিগর ছিলেন। সংকট মোচনে সবাই তাঁর পরামর্শ চাইতেন। তিনি ছিলেন ক্ষমতা ও জনগণের মেলবন্ধনের প্রতীক। সামাজিক বাঁধন রক্ষার অনুঘটক। রাজনৈতিক ক্ষমতাকে দায়িত্ব ও কর্তব্য মনে করতেন। রাজনৈতিক সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে প্রাধান্য দিতেন।

প্রণব মুখার্জি চলনে-বলনে-চেহারায়-কাপড়ে-চোপড়ে একেবারে খাঁটি বাঙালি ছিলেন। বাঙালিয়ানার মূর্ত প্রতীক ছিলেন। তিনি আপাদমস্তক একজন রাজনীতিক হলেও জ্ঞানমন্দিরের বাসিন্দা ছিলেন। প্রণব মুখার্জি ক্ষমতার প্রাসাদে অধিষ্ঠান করলেও তাঁর বিচরণ ছিল সাধারণ জনতার হৃদয়ে। তাঁকে স্পর্শ করা যেত। প্রণব মুখার্জির প্রতিভা ছিল। ইন্দিরা গান্ধীর হাতের ছোঁয়ায় সে প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটতে শুরু করে। সেই দীপ্তি নিয়েই মহাপ্রয়াণের পথে চলে গেছেন তিনি। প্রণব মুখার্জি অমর থাকবেন।

লেখক : সভাপতি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ।

সর্বশেষ খবর