সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

প্রবাসে বাংলাদেশিদের নতুন কৃষি বিপ্লব

শাইখ সিরাজ

প্রবাসে বাংলাদেশিদের নতুন কৃষি বিপ্লব

খাদ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রে বাঙালি বরাবরই অন্যরকম। আশৈশব যে ভাত, মাছ, সবজি খেয়ে এসেছে, পৃথিবীর যে প্রান্তেই যাক না কেন সেই দেশীয় খাবারের প্রতি টান থেকেই যায়। সৈয়দ মুজতবা আলীর ভ্রমণগদ্যেই পাই, বহুদেশ ভ্রমণের সময় তার প্রাণ কেঁদেছিল শুধু চারটি আতপ চাল, উচ্ছে ভাজা, সোনামুগের ডাল, পটোল ভাজা আর মাছের ঝোলের জন্য। আমাদের খাদ্যের সঙ্গে যুক্ত কৃষির ইতিহাস। কৃষিপ্রাণ বাংলাদেশি বিশ্বের যেখানেই ছড়িয়েছে, সেখানেই নিয়ে গেছে আমাদের কৃষি-কালচার। সময় পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে কৃষির বহুমুখী উপযোগিতা এখন ধরা দিয়েছে সবার কাছেই। একসময় বিদেশে পাড়ি জমানোর সঙ্গে কৃষিকাজের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পেত না কেউ। কৃষি ছিল বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের মানুষের বেঁচে থাকার পেশা। আজ কৃষি সবচেয়ে লাভজনক এক নাগরিক উদ্যোগ। গত দেড় দশকে কৃষির সম্প্রসারণ ঘটতে দেখলাম মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। একসময় মধ্যপ্রাচ্যের সবজি ও ফলের বাজারগুলোতে প্রবাসী বাঙালিরা ব্যবসা বাণিজ্যে বেশ প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। এরপরেই তারা দিনে দিনে কৃষিতে ঝুঁঁকতে থাকে। কৃষি তাদের আরও লাভের স্বপ্ন দেখায়। এখন মধ্যপ্রাচ্যে রীতিমতো সবুজ বিপ্লব ঘটে গেছে। ওমান, কাতার, সৌদি আরব, কুয়েত সবখানে প্রবাসী বাঙালিরা অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর সামনে কৃষির আকর্ষণীয় সাফল্য তুলে ধরেছে। 

এর ধারাবাহিকতায় ইউরোপ আরেমিকার দেশগুলোতে ছড়াতে থাকে বাঙালিদের কৃষি উদ্যোগ। আপনাদের হয়তো মনে থাকবে, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে খরাপ্রবণ এলাকা ক্যালিফোর্নিয়ার পাম ডেজার্টে মোহাম্মদ ইসলাম নামের এক বাঙালি কৃষি উদ্যোক্তা সেখানে কৃষিকাজ করে সবচেয়ে বেশি লাভের স্বপ্ন সফল করে দেখান। তার সেই স্বপ্ন শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয় সারা পৃথিবীতে হৃদয়ে মাটি ও মানুষের দর্শকদের কাছে অনন্য এক কৃষি উদ্যোগ হিসেবে আজও অনুপ্রেরণা জুগিয়ে চলেছে। ভিতরে ভিতরে এখন অসংখ্য মানুষ কৃষি উদ্যোগ নিয়েছেন। সাফল্যের নজিরও গড়ছেন। সে রকম একটি গল্পই আপনাদের শোনাতে চাই। নিউইয়র্কের নিউ হ্যাম্পটন। সেখানে প্রবাসী চিকিৎসক ডা. জাভেদ হোসেন জুয়েল তার বন্ধুদের নিয়ে গড়েছেন ৪৫ একরের এক কৃষি খামার। সেই কৃষি খামার নিছকই মনের খোরাক জোগাতে নয়, বুঝে শুনে একটি বাণিজ্যিক উদ্যোগ। পেশায় ডাক্তার হলেও কৃষির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে পেরে দূরদেশেও আবাদের উদ্যোগ নিয়েছেন দেশি ফল-ফসলের। ডা. জাভেদ জানালেন, প্রবাসী বাঙালিরা আমেরিকানদের মতো ফ্রোজেন খাবার খেতে খেতে পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। তাদের মাঝে দেশীয় শাকসবজির জোগান নিশ্চিত করতেই ৬ জন বন্ধুর এ কৃষি উদ্যোগ। এ বছর দ্বিতীয়বারের মতো উৎপাদন করছেন তারা। যার নাম দিয়েছেন বাংলা ফ্রেশ কৃষি খামার।

তাদের কৃষি খামারের দিগন্তজোড়া মাঠের দিকে তাকালে মনে হবে যেন দেশের ফসল সমৃদ্ধ কোনো একটি মাঠ। এক একটি প্লটে একেক সবজি। টমেটো, লালশাক, কলমিশাক, বেগুন, ঢ্যাঁড়শ, মিষ্টিকুমড়া, লাউ, কচুশাক, মরিচসহ বহু ধরনের বাংলাদেশি ও দক্ষিণ এশীয় শাকসবজির উৎপাদন করছেন তারা। মন জুড়ানো ঢ্যাঁড়শের খেত। ফলনও ভালো হয়েছে। জাভেদ বলছিলেন, এক দিন পর উঠালেও ৫০০ পাউন্ড ঢ্যাঁড়শ ওঠে তাদের খেত থেকে, এমন ফলন এসেছে। গত দুই বছরেই প্রবাসী বাঙালিদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে খামারটি। বহু প্রবাসী বাঙালিরা ছুটির দিনে ছুটে যান সেখানে। যাকে বলে অ্যাগ্রোট্যুরিজম। কৃষি প্রকৃতিতে বেড়ানোও হয়, ফেরার সময় তরতাজা সবজিও কেনা হয়।

ডা. জাভেদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, এ বিদেশ-বিভুঁইয়ে হঠাৎ এমন কৃষি খামার করার ইচ্ছা জন্মাল কেন। জানালেন, মূলত তিনটি উদ্দেশ্য নিয়ে তারা কাজটি শুরু করেছিলেন। এক. এখানকার বাঙালিদের মাঝে পুষ্টি সরবরাহ নিশ্চিত করা। দুই. অনেক প্রবাসী বাঙালি আছেন ব্যতিক্রম পেশাজীবী যারা চাইলে এখানে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পরে। তিন. এর একটা অর্থনৈতিক গুরুত্বও আছে। তিনি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, শুধু গ্রিন ভেজিটেবলের প্রতি মৌসুমে বাজার রয়েছে ৩.৪ মিলিয়ন ইউএস ডলারের। অর্থাৎ অর্থনৈতিক লাভবান হওয়ার বড় সম্ভাবনার ক্ষেত্র এটি। এ উদ্যোগে যুক্ত আছেন আশরাফুর রহমান। তিনি ২০০৬ সালে ইউএসএ আসেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই আমেরিকার চাকচিক্যের মোহ দূর হয়ে যায়। দেশের সবুজ প্রান্তরে বড় হওয়া আশরাফ মানসিকভাবে টিকে থাকার স্বার্থেই এ কৃষি উদ্যোগে যুক্ত হন। তিনি জানান, তার পড়াশোনার বিষয় ছিল অ্যাগ্রোফরেস্টি, তাই কৃষির প্রতি টান তার আগে থেকেই। আরেকজন সহযোগী নড়াইলের বিপ্লব সর্দার। তিনি ২০০৫ সালে ইউএসএ আসেন। তিনি জানান, এ উদ্যোগ নিয়ে তাদের স্বপ্ন এখন অনেক দূর। কৃষি উদ্যোগ ছড়িয়ে দিতে চান আমেরিকার অন্য প্রদেশেও। মো. সাকি শরিফ সোহাগ। ২০০৯ সালে আমেরিকা আসেন। এখানকার নিত্যকার কাজ আর বাসা করতে করতে তিনিও ক্লান্ত ছিলেন। সেই ক্লান্তি দূর হয়েছে এ কৃষি উদ্যোগে যুক্ত হয়ে। দিনে দিনে কৃষিতে অভ্যস্ত হচ্ছেন। অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আগামীতে আরও বড় কিছু করার ইচ্ছা তার। উদ্যোক্তাদের বাইরেও কর্মী হিসেবে যুক্ত রয়েছে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি। ফসল উৎপাদন থেকে ফসল তোলা এবং প্যাকেটজাত করে বাজারে পৌঁছানো তাদের কাজ। কথা হলো এমন দুয়েকজনের সঙ্গে। তারা জানালেন, বাংলাদেশের বাইরে এসে কৃষির সঙ্গে যুক্ত থাকতে পেরে তারা খুশি। এ কৃষিখামার কভিড-১৯ সময়ের দুর্যোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুরের ওয়াজেদ আলী। পেশায় ছিলেন একজন ট্যাক্সিচালক। কিন্তু কভিড-১৯ এসে থেমে গিয়েছিল তার পেশাগত জীবন। এ দুঃসময়ে কর্মসংস্থান হয়েছে এ কৃষি খামারটি।

উদ্যোক্তা ডা. মাহবুবুর রহমান। তিনিও একজন চিকিৎসক। তার দৃষ্টিতে পুষ্টি ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন কার্যক্রমে যুক্ত থাকতে পারাটা সৌভাগ্যের। প্রবাসী শিক্ষিত এই একদল উদ্যোক্তার কাছে সুস্থ ও নিরাপদে বেঁচে থাকার মূল ক্ষেত্র এখন কৃষি। তারা বলছেন, মৌসুমভিত্তিক ফসল উৎপাদনের এ প্রক্রিয়াটি তাদের সারা বছর উজ্জীবিত রাখবে। যার মূল অনুপ্রেরণা পেয়েছেন হৃদয়ে মাটি ও মানুষ থেকে। এমন কথা শুনে আমিও উজ্জীবিত হই। আমার কাজেও পাই অনুপ্রেরণা। শুধু যে নিজেরাই ফসল উৎপাদন করবেন এমন নয়। যদি অন্য বাঙালিরাও সবুজ সবজি উৎপাদন কার্যক্রম হাতে নেন তাহলে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত তারা। উৎপাদিত সবজির মূল ক্রেতা প্রবাসী বাঙালিরা। তবে ভারতীয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের নাগরিকদের কাছেও বেশ চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের নাগরিকদের কাছে বাংলাদেশের পাটশাকের যথেষ্ট কদর রয়েছে বলে জানালেন ডা. জাভেদ। 

বাংলাদেশের কোনো শাকসবজি নেই তাদের খামারে! তাদের এ খামার শুরু হওয়ার আগে নর্থ আমেরিকায় বাংলাদেশি লালশাক পাওয়া যেত না। এখন লালশাক থেকে শুরু করে কচুশাক সবসময় পাওয়া যায়। কিন্তু আবহাওয়া বিবেচনায় সেখানে এ খামারটিতে মাত্র ৩ থেকে ৪ মাস ফসল ফলানো সম্ভব। কিন্তু আমেরিকার অন্যসব স্টেটে এ সময়ের পরেও উৎপাদনের মৌসুম থাকে। এ জন্য শুধু নিউইয়র্ক নয় গোটা আমেরিকাতেই মৌসুমভেদে দেশীয় শাকসবজি উৎপাদনের উদ্যোগটি ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে।

গোটা পৃথিবীতেই দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে প্রবাসী বাঙালিদের কৃষি উদ্যোগ। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর সংস্কৃতি নতুন করে ছড়িয়ে যাচ্ছে বিশ্বময়। করোনা পরিস্থিতিতে গোটা পৃথিবী যখন উৎপাদন আর অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে তখন আমাদের কৃষি নিয়ে বহুমুখী স্বপ্ন দেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বের যে কোনো জাতি-গোষ্ঠীর মাঝে বাংলাদেশের কৃষি হতে পারে সাহসের ঠিকানা। আর এ ক্ষেত্রে প্রবাসী বাঙালিরাই আছেন চালকের আসনে। নিউইয়র্কের নিউ হ্যাম্পটনের ছয় শিক্ষিত সচেতন উদ্যোক্তার এ কৃষি উদ্যোগ আরও বহু মানুষকে উজ্জীবিত করবে কৃষি উদ্যোগে। এভাবেই অব্যাহত থাকবে পৃথিবীর দেশে দেশে নতুন সবুজ বিপ্লবের অগ্রযাত্রা।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর