সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

মূল্যবোধ ও মনোভাব

অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত

মূল্যবোধ ও মনোভাব

মানুষের মূল্যবোধ এবং মনোভাব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই পঞ্চইন্দ্রিয়, সাধারণ জ্ঞান এবং এর পরিপক্ব অবস্থা পা-িত্যের কথা চলে আসে। শিশুর শৈশব মায়ের কোল থেকে, পরিবার থেকে প্রাথমিক শিক্ষালয় বা গুরুগৃহে। চিকিৎসক হিসেবে আমি মেডিকেল জেনোটিকসে বিশ্বাসী, তাই আমাকে বিশ্বাস করতে হয়-শিশুর জন্মের পর থেকেই চরিত্র গঠনের উপাদান সঞ্চারিত হতে থাকে। কারণ মূল্যবোধ এবং মনোভাব জেনোটিকেলি আমরা গ্রহণ করে থাকি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তা বহমান থাকে। 

শৈশব আর কৈশোরের পরেই মানব সন্তান যুবকে পরিণত হয়। এ কথা সত্য আমাদের যুবসমাজ জনগণের শতভাগ নয়, কিন্তু যুবকরাই দেশের শতভাগ ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে পারে। রাষ্ট্র বিনির্মাণে সব জনগোষ্ঠীর সমর্থন এবং ভালোবাসা দরকার কিন্তু নেতৃত্বে থাকেন কিছু অংশ। যে যুবসমাজ আজকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছেন তাদেরই একটা অংশ ভবিষ্যতে বিভিন্ন খাতে দেশকে নেতৃত্ব দেবেন। জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তাদের জ্ঞান, পান্ডিত্য, চরিত্র, দক্ষতা এবং সর্বোপরি মূল্যবোধের ওপর। জ্ঞান বা পান্ডিত্যের অধিকারী যুবসমাজ এবং জনগণ একটি দেশকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যেতে পারে। সর্বোপরি তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে দেশের উন্নয়ন ঘটাতে সক্রিয় থাকার জন্য। মনে রাখতে হবে, আমাদের পর আরেকটি প্রজন্ম, তারপর আরেকটি প্রজন্ম অনন্তকাল পর্যন্ত আসতে থাকবে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. এপিজে আবদুল কালাম ২০১০ সালের ১৯ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বক্তব্যে উল্লেখ করেন, ‘মনের কোণে শুধু স্বপ্ন আঁকলেই তো হবে না। চাই নিরবচ্ছিন্ন জ্ঞান আহরণ। তা ছাড়া স্বপ্ন কখনই সত্যি হবে না। জ্ঞান তোমাকে মহান করবে। জ্ঞান তোমাকে সফলতার দ্বারে ঠেলে নিয়ে যাবে।

আসলে সাফল্য অর্জন করতে হলে শৈশব থেকে ধারাবাহিকভাবে পরিশ্রম করতে হবে। সমস্যা সমাধানের কৌশল বের করতে হবে নিজেকে। যখন কোনো অভ্যাস, আবেগ, মনোভাব বা মূল্যবোধ ছোটবেলায় মানুষ রপ্ত করে তা সাধারণত সারা জীবনের জন্য স্থায়িত্ব লাভ করে। তারুণ্যের বা যৌবনের হারিয়ে যাওয়া সময়ের কোনো ক্ষতিপূরণ হয় না। আমাদের চলমান সমাজ ব্যবস্থায় এক গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক-সমাজটা অন্যায় ও অবিচারে অভিশপ্ত হয়ে যাচ্ছে, অপরাধীদের ফাঁসি হওয়া উচিত। আমার ব্যক্তিগত মত তাদের শাস্তি বা ফাঁসি দেওয়ার আগে, যুবসমাজকে অন্যায় ও অপরাধ জগৎ থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করা উচিত। কী কারণে অপরাধের সঙ্গে তারা জড়িয়েছে তা খুঁজে বের করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাদের সঠিক পথে পরিচালনা করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্রের উচিত যুবসমাজকে পরিচয় প্রদানে অনীহায় ভুগতে না দিয়ে পরিচয় উন্নতকরণের সুযোগ করে দেওয়া হলেই যুবসমাজ শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারবে। রাষ্ট্রের উন্নয়নে তার ভূমিকা হবে ইস্পাত কঠিন। এক্ষেত্রেই পিতা-মাতা-শিক্ষক এবং নেতৃত্ব রাখতে পারে এক বিশাল ভূমিকা। আমরা হয়তোবা যুবসমাজের ভবিষ্যৎ তৈরি করে দিতে পারব না, কিন্তু তাদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতে পারি। অনেক সময় শুনতে পাই, ভদ্রলোক তার ছেলেকে অতিরিক্ত ভালোবাসা, অবাধ মেলামেশার সুযোগ দিয়ে তাকে নষ্ট করেছে। সাধারণত ছেলেমেয়েদের প্রতি পিতা-মাতার ভালোবাসা নিঃশর্ত এবং নিঃস্বার্থ। যাকে ইংরেজিতে বলা হয় আনকন্ডিশনাল লাভ বা নিঃশর্ত ভালোবাসা। আমার মতে, হয়তো অনেকেই এই নিঃশর্ত ভালোবাসা কী জিনিস তা বোঝেন না। এটা কি পিতা-পুত্রের সম্পর্কই পুত্র যা খুশি তা করবে, পিতা তা মেনে নেবেন, নাকি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একজন অন্যজনকে নির্যাতন করবে সে তা সহ্য করে যাবে। নাকি সন্তান মাদকাসক্ত তাই পরিবার অন্যদের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে তাকেই ভালোবেসে যাবে।

নিঃশর্ত ভালোবাসা হলো, আমি বিপদে আপদে যে কোনো পরিস্থিতিতে তোমার পাশে থাকব। শুধু সুসময়ে থাকব দুঃসময়ে থাকব না তা নয়। যে দুঃসময়ে পাশে থাকে সেই প্রকৃত বন্ধু, আত্মীয় বা হিতাকাক্সক্ষী। আর যারা শুধু সুসময়ে পাশে থাকেন তারা হলেন সহচর, সঙ্গী, তারা সত্যিকার বন্ধু নয়। তাদের শুধু বিনোদন ও আপ্যায়ন দিয়ে পাওয়া যায়। নিঃশর্ত ভালোবাসা বোঝায় নিজের সব কিছুকে বলিদান বা ত্যাগ করা। এ ধরনের ভালোবাসা সন্তানকে অঙ্গহীন করে তুলতে পারে, কারণ সব ভালোবাসা তখন তার কাছে অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।

একটি চলন্ত ট্রেন যখন লাইনচ্যুত হয়ে যায়, তখন ওই ভারী ট্রেনকে শক্তিশালী ক্রেইন দিয়ে পুনরায় লাইনে বসাতে পারলে এবং লাইনচ্যুতির কারণে ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত না হলেই, চালক তাকে চালাতে পারে। তেমনি যুবসমাজ যদি লাইনচ্যুত হয় তাহলে পিতা-মাতাই প্রথম চেষ্টা করবে তা লাইনে আনতে। না হলে রাষ্ট্র দায়িত্ব নেবে, তাদের লাইনে আনার জন্য। তারপরও যদি সব চেষ্টার পরে তাকে বা তাদের সঠিক পথে না ফেরানো যায় তখন চিন্তা করতে হবে সম্পূর্ণভাবে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন করার জন্য। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র তথা অভিভাবককে কঠোর হতে হবে। আমরা অনেক সময় বলে থাকি যুবসমাজের কী অধঃপতন, কিন্তু কখনো কি চিন্তা করি এ জন্য কে দায়ী, তারা না আমরা। শুরুতে আমরা, তারপর সমাজব্যবস্থা এবং সর্বশেষ রাষ্ট্রব্যবস্থা। জনসম্পদের সঠিক মূল্যায়ন এবং তাদের শ্রেণিভেদে, যোগ্যতাভেদে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ দিলেই অনেকটা সংশোধিত হয়ে যাবে, কারণ নেতৃত্বদানে সবাই আগ্রহী এবং নেতৃত্বের সুযোগ কিছুটা হলেও মানুষকে সৎপথে চলতে সাহায্য করে।

বর্তমানে তরুণদের অধৈর্য শব্দটি সমার্থক হয়ে গেছে। তার পিছনে কীসের ভূমিকা বেশি, তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহার নাকি প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার নৃশংস ঘটনার অবলোকন। এ পরিণতির জন্য দায়ী কে। তাই দরকার পর্যাপ্ত দিকনির্দেশনা দেওয়া এবং তাদের মগজে ভালো মূল্যবোধের বীজ বপন করা। ভালো মূল্যবোধের বীজ বপন করা যায় তাহলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ছড়িয়ে যাবে এবং একটা সুন্দর, চরিত্রবান মূল্যবোধের জাতি হিসেবে আমরা গড়ে উঠব।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।          

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর