সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

অনন্য সৈয়দ মুজতবা আলী

আফতাব চৌধুরী

অনন্য সৈয়দ মুজতবা আলী

উনিশ শ আঠারো সাল। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির আরও পাঁচ বছর পর বাঙালি কবি তখন বিশ্বনন্দিত, বিশ্বকবি অভিধায় পরিচিত। ১৪ বছরের এক অনুসন্ধিৎসু কিশোর কৌতূহল বশে একটি চিঠি লিখলেন রবীন্দ্রনাথকে। তারপর দুরু দুরু চিত্তে তার অপেক্ষা। নাহ রবীন্দ্রনাথ তাকে ফিরিয়ে দিলেন না। সে কিশোরের উদগ্রীব আকাক্সক্ষা কবিকে ভাবিয়ে তুলল। কৌতূহলী সে ছেলেকে তিনি আমন্ত্রণ জানালেন শান্তিনিকেতনে।

১৯২১ সালে সে কিশোর ভর্তি হয়ে যান শান্তিনিকেতনের স্কুল বিভাগে। কবিগুরুর কাছে বলাকা শেলী-কীটপসের কবিতা পড়ার সৌভাগ্য লাভ করেন তিনি। এখানে পাঁচ বছর অধ্যয়ন করে শান্তিনিকেতনের প্রথম স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করার বিরল গৌরব অর্জন করেন। সেদিনের সে কিশোর তার অনন্য সাধারণ অধ্যবসায় ও জ্ঞান-সাধনার বলে কালে হয়ে উঠেন বাংলা-সাহিত্যের নতুন এক দিগন্তের উন্মোচক। রসরচনায় তার তুলনা একমাত্র তিনিই। সাহিত্য-আকাশের এ উজ্জ্বল নক্ষত্রের জন্ম ১৯০৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তৎকালীন সিলেট জেলার করিমগঞ্জ শহরে। তার নাম-সৈয়দ মুজতবা আলী। বাবা খান বাহাদুর সৈয়দ সিকান্দার আলী ছিলেন রেজিস্ট্রেশন বিভাগের চাকরিজীবী। তার বড় দুভাই সৈয়দ মুস্তফা আলী ও সৈয়দ মুর্তজা আলী সাহিত্য ক্ষেত্রে খ্যাতির অধিকারী ছিলেন। শৈশব থেকেই সৈয়দ মুজতবা আলী সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত। তখন থেকেই তিনি ছিলেন ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতের উৎসাহী পাঠক। শান্তিনিকেতনের পাঠ চুকিয়ে তিনি লেখাপড়া করতে যান আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ওখানকার পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখেই ১৯২৭ সালে শিক্ষা বিভাগের চাকরি নিয়ে তিনি পাড়ি জমান আফগানিস্তানের কাবুল শহরে। সেখানে এক কৃষিবিজ্ঞান কলেজে তিনি পড়াতেন ইংরেজি ও জার্মান ভাষা। ইতিমধ্যে আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে মুজতবা আলী বার্লিন চলে যান এবং বনবিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। দুই বছর পড়াশোনা করে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল- দি অরিজিন অব খোজাস অ্যান্ড দেয়ার রিলিজিয়ন্স লাইফ টু ডে (The origin of khojas and their religions life today) .জার্মানি থেকে শিক্ষা সমাপন করে তিনি ১৯৩২ সালে দেশে ফিরে আসেন। এরপর আবার ইউরোপ গিয়ে ওখান থেকে কায়রো গিয়ে আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৩৬ সালে তিনি বরোদা কলেজের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ৪৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ আট বছর তিনি এ কলেজে অধ্যাপনা করেন। ৪৯ সালে কিছুদিনের জন্য পালন করেন বগুড়া কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব। ৫০ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং একই সালে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব কালচার রিলেশনন্স-এর সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ৫২ সাল থেকে ৫৪ সাল ২ বছর আকাশবাণীতে চাকরি করেন। ৫৫ সালে তাকে আকাশবাণী কটক কেন্দ্রের পরিচালক নিযুক্ত করা হয়। পরে তাকে ইসলামী সংস্কৃতির বিভাগীয় প্রধানরূপে নিযুক্ত করা হয়। মুজতবা আলী পরিণত বয়সে সাহিত্য সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় সত্যপীর ও টেকচাঁদ নামে কলামিস্ট হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৪৮ সালে দেশ পত্রিকায় দেশ বিদেশ লিখতে শুরু করেন। এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলে (১৯৪৯ সালে) বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।

তিনি সর্বমোট ১৬টি ভাষা জানতেন। এর মধ্যে রয়েছে সংস্কৃত, ইংরেজি, জার্মান, ফরাসি, ইতালিয়ান, আরবি, ফারসি, উর্দু, হিন্দি, উড়িয়া, অসমিয়া, গুজরাটি, মারাঠি। এতগুলো ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভের কারণে তার ভিতর সৃষ্টি হয়েছিল অসাধারণ বৈদগ্ধ। তার এ ভাষাজ্ঞানের সমৃদ্ধি ঘটেছিল বিশ্বভারতীতেই। তিনি বিধুশেখর শাস্ত্রী এবং ফরমিকির কাছে সংস্কৃত ভাষা, সংখ্যা ও বেদান্ত দর্শন অধ্যয়ন করেন। ড. মার্ক কলিন্সের কাছে ইংরেজি, ফারসি ও জার্মান, মরিস সাহেবের কাছে ফরাসি, বেনোয়ার কাছে ফরাসি ও জার্মান, বগদানফের কাছে ফরাসি ও আরবি এবং তুচ্ছির কাছে অধ্যয়ন করেন ইতালিয়ান।

সৈয়দ মুজতবা আলী তার অনন্য গদ্যশৈলীর গুণে স্বল্প সময়ে সমকালীন পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হন। আরবি-ফারসি শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে এদেশীয় আঞ্চলিক শব্দকে ভিন্ন কলাকুশলতার সুনিপুণ ব্যবহার তাকে সাহিত্য ক্ষেত্রে বিরল হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তার রচনাশৈলীতে রয়েছে এমন এক শেষাত্মক রসঘন প্রয়োগ, যা পাঠককে গভীর অভিনিবেশে পৌঁছে দেয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর