মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সেই সব দিন

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সেই সব দিন

পানি ছাড়া যেমন মাছ বাঁচে না, জনসমর্থন ছাড়া তেমনি রাজনীতি চলে না। ২০১৫ সালে বিএনপির লাগাতার হরতাল-অবরোধে মানুষ বড় বেশি উতালা ও বিক্ষুব্ধ হয়েছিল। জনগণের যে কষ্টের সীমা ছিল না, সেদিকে বিএনপি মোটেই তাকায়নি। সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা মুহূর্তের জন্যও বিবেচনা করেনি। পরিণতিতে তিন থেকে সাড়ে তিন মাস পর আপনা-আপনি হরতাল-অবরোধ থেকে জনগণ সরে আসে। বিএনপি ও ২০-দলীয় জোট জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তারা হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহারেরও সুযোগ পায়নি। সে হরতাল-অবরোধে বিএনপি যে জনসম্পৃক্ততা হারিয়েছে তা একবারের জন্যও মূল্যায়ন করেনি। এরপর আসে ২০১৮-এর ডিসেম্বরের নির্বাচন। ভোটারদের একেবারে হতাশ করে কাউকে ভোট দিতে না দিয়ে সরকার যখন মানুষের ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয় ঠিক তখন ঐক্যফ্রন্টের ঝরে পড়া থালার ভাতের মতো যে আটজন সংসদ সদস্য হয়েছিলেন তাঁরা সংসদ থেকে পদত্যাগ না করে একসময় শপথ নেওয়ায় জনগণ আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং বিএনপিকে জনস্বার্থবিরোধী একটি লোভী দল হিসেবে বিবেচনা করতে থাকে। অতিসম্প্রতি কয়েকটি উপনির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ নিয়ে দেশবাসীকে যা দেখাল তা আরও নিন্দনীয়। ঢাকা-৫ ও ১৮ আসনের মনোনয়নের সময় সমর্থকদের মারামারি, রক্তারক্তি দেশবাসীকে খুবই হতাশ করেছে। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হওয়ার পর আমার দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগও তার শরিক হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে নয়, ধীরে ধীরে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বিএনপির কর্তৃত্বে চলে গেছে। নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে পরমুহূর্তেই আবার শপথ নিয়ে সদস্য হওয়ার দ্বিচারিতার কারণে ঐক্যফ্রন্ট ত্যাগ করেছিলাম। বিএনপি নেতারা নিজেরাই বলেছেন, উপনির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য ছাড়া কাজের কাজ কিছু হবে না। সে সময় যেমন মনোনয়নের জন্য রক্তারক্তি হয়েছিল, সেদিনও তেমনি প্রতিদ্বন্দ্বীরা রক্তারক্তি করেছেন। অথচ নির্বাচনে কাজ করেননি, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য আন্দোলনে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। অথচ মনোনয়নের জন্য রক্ত ঝরাতে কেউ পিছ-পা হননি। সত্যিই এমন জনবিচ্ছিন্ন স্বার্থবাদী দল কখনো জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে না। গুলশানে বিএনপি কর্মীর কপাল বেয়ে রক্ত পড়তে দেখে দেশের মানুষের কোনো সহানুভূতি জাগেনি বরং অনেক অনেক হতাশা ও ঘৃণা জেগেছে।

কংগ্রেস এ উপমহাদেশের সবচেয়ে পুরনো দল। প্রতিষ্ঠার পর দলটি বহুবার বহু শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দলটি এক মহিরুহে পরিণত হয়েছে। শত ঝড়-ঝাপটায়ও কেউ তার শিকড় ওল্টাতে পারেনি। যাকে নিয়ে আলোচনা তিনি একসময় বাংলা কংগ্রেস করতেন। তাঁরা কেউ উড়ে এসে জুড়ে বসেননি। সবাই ছিলেন নিবেদিত কংগ্রেসি। মতবিরোধের কারণে কিছু নেতা আলাদা কংগ্রেস করে মানুষের কাছে যেতে চেষ্টা করেছিলেন। সেই বাংলা কংগ্রেস থেকে ১৯৬৯ সালে শ্রীপ্রণব মুখার্জি প্রথম রাজ্যসভার সদস্য হন। আমাদের মতো ভারতে এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদ বা পার্লামেন্ট নয়। সেখানে শাসন পদ্ধতি অন্যরকম। প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকার। পাকিস্তান আমলে আমাদের দেশেও তেমনটাই ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে পাঁচ প্রদেশ, আমরা পূর্ব পাকিস্তান এক প্রদেশ- মোট ছয় প্রদেশ। ভারতে অনেক প্রদেশ। সেখানে প্রাদেশিক পরিষদ ও কেন্দ্রীয় পরিষদ আলাদা। প্রাদেশিক পরিষদকে বলে বিধানসভা আর কেন্দ্রীয় পরিষদ হচ্ছে লোকসভা। লোকসভা আর বিধানসভায় সরাসরি ভোট। কিন্তু রাজ্যসভায় তেমন নয়। রাজ্যসভার সদস্য হতে হলে লোকসভা ও বিধানসভার ভোটে নির্বাচিত হতে হয়। যাতে কখনো কোনো দিন রাজ্যসভার সব সদস্যের মেয়াদ একসঙ্গে শেষ না হয় তার জন্য ভাগেভাগে বা স্তরে স্তরে মেয়াদ শেষের বিধান করা হয়েছে। লোকসভা ও বিধানসভায় পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন হয়। কিন্তু রাজ্যসভায় দু-এক মাস পরপরই নির্বাচন হয়। কিন্তু প্রত্যেক সদস্যের সময় পাঁচ বছর। রাজ্যসভা ও লোকসভার সদস্যের নাম এমপি, বিধানসভার সদস্যের নাম এমএলএ। রাজ্যসভায় মাঝেমধ্যে নির্বাচন হওয়ার কারণ ১০ জন একসময় নির্বাচিত হয়েছেন, তার পরের মাসে অথবা ছয় মাস পর ২০-২৫ জন, তারপর আবার ১০-১৫ জন এভাবে চলতেই থাকে। কারও মেয়াদ যখন শেষ হয় তখন হয়তো কারও ছয় মাস, কারও নয় মাস, কারও আবার এক বছর থাকে। তাই রাজ্যসভায় আসা-যাওয়া চলতেই থাকে। সে রাজ্যসভায় প্রণব মুখার্জি প্রথম সদস্য হয়েছিলেন ’৬৯ সালে। তিনি তখন পশ্চিমবঙ্গেই থাকতেন। কালেভদ্রে দিল্লি যেতেন অধিবেশনে যোগদান করতে। প্রণব মুখার্জির বাবা কামদাকিঙ্কর মুখার্জি একজন স্বাধীনতা যোদ্ধা এবং বলিষ্ঠ নেতা ছিলেন। তাঁর ছেলে হিসেবে প্রণব মুখার্জি অনেকের আশা-ভরসার স্থলে পরিণত হয়েছিলেন। কিছু মানুষের আচার-আচরণে এমনিতেই একটা আস্থার বাতাবরণ সৃষ্টি হয়। তেমনটা প্রণব মুখার্জির ক্ষেত্রেও হয়েছিল। তিনি খুব সরল-সোজা মানুষ ছিলেন। তুখোড় মেধার অধিকারী হলেও ছলচাতুরীর লেশমাত্র তাঁর মধ্যে ছিল না। তিনি ’৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে রাজ্যসভায় জোরালো দাবি জানিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে দুনিয়ার অনেক দেশে গেছেন। ছোটখাটো মানুষ হলেও তাঁর কথার ধার ছিল ভীষণ। যুক্তিতর্কে তিনি ছিলেন সাবলীল। তাই অল্পতেই লোকজনের চোখে পড়তেন। ইন্দিরা গান্ধীর চোখেও পড়েছিলেন ’৭৩ সালের এক বক্তৃতার সময়। তিনি তাঁকে দিল্লি যেতে বলেছিলেন। ইন্দিরাজির কথামতো প্রণব মুখার্জি দিল্লি যান। তখন তাঁর থাকার কোনো ঘরও ছিল না। আস্তে আস্তে এগোতে থাকেন। উপমন্ত্রী হন, সেখান থেকে প্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রী, শেষমেশ ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি। মনে হয় না শত বছরে আর কোনো বাঙালি ভারতের রাষ্ট্রপতি হবেন। কোনো বাঙালি যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না তা এক অলিখিত বিধান। তা যদি না হবে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর প্রণব মুখার্জিই হতেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তা হয়নি। নরসিমা রাও প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। একেবারে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক মানুষ মনমোহন সিং দুবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। যার পরিণতি আজ কংগ্রেস ভোগ করছে, ভারত ভোগ করছে। কিন্তু প্রণব মুখার্জি প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি।

শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি তাঁর আস্থা, বিশ্বাস ও আনুগত্যে কখনো চির ধরেনি। ’৭৭-এর আগে প্রণব মুখার্জি অন্য আর দশজনের মতোই ছিলেন। ’৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধীর পতনের পর কত পরিচিত মুখ বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের দুই নেতা প্রণব মুখার্জি আর এ বি এ গণি খান চৌধুরী এক ইঞ্চিও সরেননি। যে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় ’৭৫-এ জরুরি অবস্থা জারির খসড়া তৈরি করেছিলেন সেই সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় ইন্দিরা গান্ধী ও সঞ্জয় বিরোধী প্রধান সিপাহশালার হয়েছিলেন। সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় ছয় ফুটের ওপরে সুদর্শন একজন পুরুষ হলেও ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের পতনের পর পাশে থাকতে পারেননি। ইন্দিরা গান্ধী সরকারের অনিয়ম তদন্তে শাহ কমিশন গঠন করা হলে প্রায় সবাই শ্রীমতী গান্ধীর বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু পাঁচ ফুট কয়েক ইঞ্চির মানুষটি হিমালয়ের মতো ইন্দিরাজির পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ’৭৭ থেকে ’৮০-র জানুয়ারি খুব বেশি সময় নয়। কষ্ট তাঁদের হয়েছে, কিন্তু ক্ষমতায় ফিরে আসতে খুব একটা বেশি সময় লাগেনি। হরিয়ানায় এক মিটিংয়ে যাওয়ার পথে ইন্দিরা গান্ধীকে গ্রেফতার করে তিহার জেলে পাঠানো হয়েছিল। সেখান থেকে বেরিয়ে অন্ধ্রের নরসিমা রাওয়ের ছেড়ে দেওয়া চিকম্যাঙ্গালোর আসনে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়ে সংসদে এসেছিলেন। কারণ ইন্দিরা গান্ধী ’৭৭-এর নির্বাচনে জনতা পার্টির একজন সাধারণ নেতা রাজ নারায়ণের কাছে হেরে গিয়েছিলেন। তখন সময়ই ছিল এমন সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের আহ্বানে সারা ভারত উত্তাল হয়ে উঠেছিল। কংগ্রেসের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। সব বিরোধী দল এক হয়ে গিয়েছিল। ৫৪৩ আসনের লোকসভায় সেবার ১৪৩ আসন পেয়েছিল কংগ্রেস। কর্ণাটক, অন্ধ্র, তামিলনাড়–তে কংগ্রেস ভালো করেছিল। কিন্তু উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যায় তেমন কিছুই করতে পারেনি। নরসিমা রাওয়ের ছেড়ে দেওয়া আসনে নির্বাচন করে সংসদে এসে বিরোধী দলের নেতা হয়েও ইন্দিরা গান্ধী সংসদে থাকতে পারেননি। সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে সদস্যপদ বাতিল করে লোকসভা থেকে তাঁকে বের করে দেওয়া হয়। তিনি যখন রাজনৈতিক সফর করতেন, তখন তাঁকে কোনো সরকারি অতিথিশালা বা সার্কিট হাউস ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি। এমনকি রেলস্টেশনের বিশ্রামাগারেও উঠতে দেওয়া হয়নি। যেটা সাধারণ প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের জন্য সব সময় অবারিত থাকে। কখনো কারও ওপর অতিরিক্ত জুলুম করলে স্রষ্টা যেমন নারাজ হন, দেশবাসীও খুব একটা খুশি হয় না। আমি নিজেই বিহারের পাটনায় শুনেছি, ‘হামলোগ তো ইন্দিরাকো সাজা দে দিয়া। ফের উনকি উপর ইতনি জুলুম কিউ?’ জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে সব দল মিলে জনতা পার্টির সৃষ্টি হয়েছিল। তাঁরা মিলেমিশে থাকতে পারেননি। মোরারজি দেশাই ছিলেন কট্টর নীতিমান। অন্যদিকে চরণ সিং, জগজীবন রামরা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য এমন কিছু নেই যা করেননি। এমনকি সঞ্জয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জাগজীবন রাম ও চরণ সিং উভয়েই দুর্বার চেষ্টা করেছেন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার। যে রাজ নারায়ণ ইন্দিরাজিকে হারিয়েছিলেন, সেই রাজ নারায়ণ একসময় সঞ্জয় গান্ধীর পরম বন্ধু ভাবশিষ্যে পরিণত হয়েছিলেন। তাই ঘরোয়া ঠেলাঠেলিতে জনতা সরকার বেশি দিন টেকেনি। ’৭৯-এর মাঝামাঝি চরণ সিং সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন ঘোষণার জন্য রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করেন। রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডি ’৮০ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে লোকসভার নির্বাচন ঘোষণা করেন।

এ সময় শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তাঁদের এক নেতার মাধ্যমে আমাকে দিল্লিতে ডেকে পাঠান। ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর মাত্র একবারই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সব যোগাযোগ হতো প্রণব মুখার্জির মাধ্যমে। হঠাৎ শ্রীমতী গান্ধী ডেকে পাঠানোয় কিছুটা বিস্মিত হই। দিল্লিতে তাঁর বাড়িতে গেলে তিনি নিজ হাতে বেড়ে খাওয়ান। তারপর বলেন, ‘বাঘা! শুনেছি জয়প্রকাশজি তোমাকে খুব বিশ্বাস এবং ¯েœহ করেন। তুমি গেলে সঙ্গে নিয়ে খাবার খান। নেপালের নির্বাসিত নেতা একসময়ের প্রধানমন্ত্রী বি পি কৈরালা ছাড়া আর কাউকে নাকি তোমার মতো অতটা গুরুত্ব দেননি। এবার নির্বাচনে যদি জে পি জনতা পার্টির হয়ে প্রচারণা না করেন তাহলে আমরা সরকার গঠন করতে পারব। তোমাকে তো তিনি খুব ভালোবাসেন আদরযতœ করেন। তুমি কি জেনে দিতে পারবে জে পি এবারের নির্বাচনে জনতা পার্টির হয়ে প্রচারে নামবেন কিনা?’ কাজটা আমার কাছে খুব কঠিন ছিল না। সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের সঙ্গে তখন চাম্বলের ডাকাতরাও কথা বলে। তাঁকে তখন ভারতের দ্বিতীয় গান্ধী বলা হতো। পরদিনই ছুটে গিয়েছিলাম পাটনায়। জয়প্রকাশ নারায়ণের বাড়ি কদমকুয়া ছিল আমার জন্য অবারিত। দুপুরের দিকে গিয়েছিলাম। পরম যতেœ খাবার খাইয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, হঠাৎ কেন পাটনায় গেছি। তিনি আমাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। তাঁর ভালোবাসার কারণ তিনি বাংলাদেশকে ভালোবাসতেন। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৩০ সালের দিকে পুরান ঢাকার ঠাঠারীবাজারে তিন বছর আত্মগোপন করে ছিলেন। আর বিয়ে করেছিলেন কলকাতার বাঙালি মহিলা প্রভাবতী দেবীকে। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মা কমলা নেহরুর সঙ্গে যাঁর খুবই সুসম্পর্ক ছিল। আমি জয়প্রকাশজিকে বলেছিলাম, ইন্দিরাজি দিল্লিতে ডেকে নিয়েছিলেন। সেখান থেকেই এসেছি। এ নির্বাচনে আপনি জনতা পার্টির হয়ে প্রচার-প্রচারণা করবেন কিনা তা জানতে চান। তাঁর বিশ্বাস আপনি প্রচারে না নামলে তিনি সরকার গঠন করতে পারবেন। আমার কথা শুনে জয়প্রকাশজি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, বুঝতে পারি ইন্দিরা ক্ষমতায় এলে তোমার সুবিধা। না, যে কারণে ইন্দিরাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়েছিলাম জনতা পার্টি ইন্দিরার চাইতেও খারাপ করেছে। আমার শরীর ভালো না। আর জনতা পার্টির নেতাদের কলহে আমি আর তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় যাব না; তুমি ইন্দিরাকে বলে দিও।’ আমি খুব খুশি হয়ে পরদিনই দিল্লি গিয়েছিলাম। ইন্দিরাজিকে বলতেই তিনি ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। তাঁকে অত আনন্দিত অত খুশি আগে কখনো দেখিনি। মাথায় কাঁধে হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি মারাত্মক কাজ করেছ। আচ্ছা টাইগার, আরেকটা কাজ করা যায় না?’ কী কাজ? ‘জয়প্রকাশজির কাছে প্রণবকে একবার নিয়ে যাওয়া যায় না?’ বলেছিলাম, ঠিক আছে। চেষ্টা করে দেখি।

’৭৯-এর গোড়ার দিকে ইন্দিরা গান্ধী হাতির পিঠে চড়ে বিহারের চাম্পারণে গিয়েছিলেন। যেমনটা ভারতের পিতা মহাত্মা গান্ধী গিয়েছিলেন। তাঁকে ব্রিটিশ সরকার সেখান থেকে গ্রেফতার করে বিহার জেলে রেখেছিল। পরদিন কোর্টে নিলে এক টাকা জরিমানা করা হয়। মহাত্মাজি বলেছিলেন, ‘আমার কাছে টাকা নেই, আমি জরিমানা দিতে পারব না।’ বিচারক বলেছিলেন, ‘ঠিক আছে, আপনাকে দিতে হবে না। জরিমানার টাকা আমিই দেব।’ এভাবেই শেষ হয়েছিল সে ঘটনা। ক্ষমতা হারাবার পর সেই চাম্পারণে গিয়েছিলেন তাদের দুঃখ-দুর্দশা দেখতে শ্রীমতী গান্ধী। লোক হয়েছিল বেশুমার। ইন্দিরাজি অনেক কথার মাঝে বলেছিলেন, ‘গলতি হো গিয়া, মাফি মাংতা হু, মাফ কি জিয়ে।’ মনে হয় সব মানুষ তাঁকে মাফ করেছিল। এরপর পাটনার গান্ধী ময়দানে জনসভা। আমি অত বড় মাঠ বা ময়দান দেখিনি। পাঁচ কিলোমিটারের বেশি লম্বা ও দুই-আড়াই কিলোমিটার পাশ। সেই গান্ধী ময়দান ইন্দিরা গান্ধীর সভায় ভরে গিয়েছিল। আশপাশের রাস্তাঘাট, দালানকোঠা কোনো কিছু বাকি ছিল না। ৩ হাজারের ওপর মাইক্রোফোনের চোঙ্গা লাগানো হয়েছিল। সভা শেষে ইন্দিরা গান্ধী গিয়েছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণের বাড়ি কদমকুয়ায়। ২ ঘণ্টা গেটে বসে ছিলেন। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী কর্পুরী ঠাকুর এক এসপি বসিয়ে রেখেছিলেন। কর্পুরী ঠাকুরের অনুমতি ছাড়া কাকপক্ষীও জয়প্রকাশ নারায়ণের বাড়ি ঢুকতে পারত না। তাই দেখা হয়নি। সে কারণে ইন্দিরা কংগ্রেসের কোনো নেতাই জয়প্রকাশ নারায়ণের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন না। সপ্তাহখানেক পর আবার পাটনায় গিয়ে ইন্দিরাজির কথা এবং প্রণব মুখার্জির দেখা নিয়ে কথা বলেছিলাম। জয়প্রকাশজি বলেছিলেন, ‘প্রণব এলে তো ভালোই হয়। তুমি ওকে নিয়ে এসো। আমার সঙ্গে খেয়ে-দেয়ে আলাপ করে যাবে।’ সেইমতো প্রণবদাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। কোনো অসুবিধা হয়নি। তখনো প্রণবদা অত পরিচিত মুখ ছিলেন না। ছোটখাটো মানুষ। তাঁকে নিয়ে চলতে কোনো অসুবিধা হতো না। প্রণবদাকে দিয়ে আমি বেরিয়ে এসেছিলাম। খাবারদাবার খেয়ে আলাপ-আলোচনা করে সার্কিট হাউসে ফিরেই আমাকে ডেকেছিলেন। আমাকে জাপটে ধরে কেমন যে করেছিলেন লিখে বোঝানো যাবে না। বারবার বলছিলেন, ‘বাঘা! তুমি জে পিকে কী জাদু করেছ তোমাকে এত ভালোবাসে? আমাদের আলোচনা তো কয়েক মিনিটেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। বাকি আলোচনা শুধু তোমাকে নিয়ে।’ বলেছিলাম, জানি না। ছলনা করতে শিখিনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু এবং হুজুর মওলানা ভাসানীর সঙ্গে চলেছি। তাঁদের দুজনের ছিলাম দূতের মতো। তাঁরাও জয়প্রকাশজির মতো ভালোবাসতেন, বিশ্বাস করতেন। কারণ আমি কখনো কিছু বানিয়ে বলিনি।

ইন্দিরাজির কথাই সত্য হয়েছিল। ’৮০-এর জানুয়ারির নির্বাচনে কংগ্রেস সব থেকে বেশি সিট পেয়েছিল। ’৭৭-এর নির্বাচনে কংগ্রেস পেয়েছিল ১৪৩ আসন আর ’৮০ সালে কংগ্রেস পায় ৫৪৩ আসনের মধ্যে ৩৮৩ আসন। প্রণব মুখার্জি হন বাণিজ্যমন্ত্রী।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

 

সর্বশেষ খবর