মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুর ভিশন মিশনারিদের মিশন

অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম

বঙ্গবন্ধুর ভিশন মিশনারিদের মিশন

বিষয়টা গণমাধ্যমে বেশ কিছুদিন ধরে সবাই দেখছেন, বাংলাদেশে এত সুন্দর জায়গায় এত খোলামেলা প্রাকৃতিক পরিবেশে, কঠিন নিয়মের মধ্যে থেকে একটি হাসপাতাল আজকে এ পর্যায়ে কীভাবে এলো? বলছিলাম হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের কথা। মিশনারিরা তাদের একটা মিশন নিয়ে এখানে মিডওয়াইফ তৈরি করতেন, তাদের একটা দারুণ মিশন ছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তারা যখন এর দায়িত্বে ছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া, সাহায্য করা, চিকিৎসকদের বিভিন্ন কাজে তারা ভূমিকা রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তারা বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিতে চান, বঙ্গবন্ধু রেড ক্রিসেন্টের অধীনে এর দায়িত্ব প্রদান করেন। সেই থেকে রেড ক্রিসেন্ট এটি পরিচালনা করে আসছে।

রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন চেয়ারম্যান এবং নির্বাচনের মাধ্যমে বোর্ড তৈরি হয়। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সব সময়ই অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অথবা মেজর জেনারেলরাই  চেয়ারম্যান পদ পেতেন এবং সমাজের যারা নিবেদিতপ্রাণ কর্মকর্তা হিসেবে বোর্ডে আসতেন। ডাক্তারদের নিয়োগ ও পরীক্ষা নিয়ে বিশাল একটি কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হতো।

১৯৯১-এর পর ক্রমেই রাজনৈতিক -ভাবে এটি দখলের প্রক্রিয়া শুরু। সে ধারাবাহিকতায় যখন যিনি ক্ষমতা পেয়েছেন তখনই কর্মচারী নিয়োগ হয়েছে। ফলে আজ আকাশচুম্বী বেতন নিয়ে বহু কর্মচারী হাসপাতালে বিরাজ করছেন।

২০০০ সাল থেকে কলেজ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হলেও ২০০১-এ কলেজ শুরু হয় এবং সুনামের সঙ্গে কলেজ তার ভর্তি প্রক্রিয়া ঠিক রেখে ছাত্রদের ভালোভাবে শিক্ষা দান করে বাংলাদেশে বেসরকারি কলেজের মধ্যে একটি স্থান দখল করেছিল। বেসরকারি কলেজের মধ্যে এটিই একমাত্র কলেজ যেখানে ছাত্ররা নিজেদের রোগীদের নিজেরাই দেখে হাতে কলমে শিক্ষা নিতে পারতেন। হাসপাতালের সঙ্গেই একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট। এখানে দেশের শ্রেষ্ঠতম নার্স তৈরি হতো। ক্রমেই সব যেন ইতিহাস হয়ে গেল। ক্রমেই চিকিৎসাব্যবস্থাসহ নার্সিং সার্ভিসের সুনাম কমে আসতে থাকল। একটা সময় ছিল যখন ঢাকা শহরের সব অভিজাত এলাকার বাসিন্দা, বিমান, তিতাস, বাটা- সবাই এ হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। যদিও এর মধ্যে অন্য বেসরকারি ভালো হাসপাতাল তৈরি হওয়ায় অনেকেই চুক্তি বাতিল করলেন। কলেজ ভালো চললেও হাসপাতাল তার অতিরিক্ত কর্মচারীর ব্যয় বহন করতে পারছিল না। ইতোমধ্যে বর্তমান চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান মজুমদার তার নিজস্ব উদ্যোগে বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্থ সংগ্রহ করে হাসপাতালের উন্নয়নকাজ করেছেন। তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন, কিন্তু কোনোভাবেই হাসপাতালের কর্মচারীদের বিশাল বেতনের বোঝা বহন করতে পারছিলেন না। এর সঙ্গে কিছু দুর্নীতিও ছিল শোনা যাচ্ছিল। মাঝখানে একবার দুই সপ্তাহের মতো কর্মচারীরা হাসপাতালকে লকডাউন করে দেন এবং তার ফলে আরও খারাপ অবস্থার তৈরি হয়।

রেড ক্রিসেন্টের বোর্ড ও চিকিৎসকদের সমন্বয়ের অভাব দেখা দেয়। ক্রমেই বেতন বকেয়া হতে হতে আজ এ অবস্থা!

কভিড-১৯ হাসপাতাল করার মতো কোনোভাবেই এর অবস্থা ছিল না। কারণ এটি একটি চারদিক থেকে খোলামেলা হাসপাতাল। তার পরও কর্তৃপক্ষ বেতনের কথা চিন্তা করে সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। যার ফলে সার্জারি, মেডিসিন, গাইনি, ডায়ালাইসিস, শিশুসহ সব বিভাগ বন্ধ হয়ে যায়। সাত মাস এর চিকিৎসাব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। হঠাৎ বকেয়া পরিশোধ না করে সরকার চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেয়।

আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে হলে হাসপাতাল জীবাণুমুক্ত করতে হবে; সর্বোপরি কর্মচারীরা আগের বেতনসহ প্রায় পাঁচ মাস বেতন না পাওয়ায় যে অবস্থা হয়ে আছে কীভাবে এর উত্তরণ হবে? সমাধান অবশ্যই করতে হবে এত সুন্দর একটা হাসপাতাল  এবং এমন একটি কলেজ যেখানে ছাত্ররা নিজস্ব প্রাঙ্গণে একটি মনোরম পরিবেশে লেখাপড়া করছে। সে রকম একটি প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত হতে থাকবে, তা মেনে নেওয়া যায় না। আমি দীর্ঘ ২৬ বছর এখানে কাজ করেছি। এটিকে আমি সন্তানতুল্য মনে করি। অবসর নেওয়ার পরও আমি বিনা বেতনে দুই বছর কাজ করেছি। কিন্তু চক্র থেকে হাসপাতালকে রক্ষা করতে পারিনি।

শক্তিশালী একটি কাঠামো এবং চিকিৎসকদের সমন্বয়ে হাসপাতাল উন্নয়নমুখী একটি কমিটি করতে হবে। পাশাপাশি অন্য হাসপাতাল কীভাবে কাজ করছে তার একটি ধারণা নিয়ে চিকিৎসক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, ছাত্র-শিক্ষক সবাইকে নিজেদের এ কাজে নিয়োজিত করতে হবে। দ্রুত হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে শুরু করে নার্সিং সার্ভিসের উন্নয়নে ব্যবস্থা নিতে হবে।

বঙ্গবন্ধুর এ ভিশন ও মিশনারিদের মিশনকে অবশ্যই সঠিক পথে এগিয়ে নিতে সবাইকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারের সুদৃষ্টিও আমাদের সবার প্রত্যাশা।

লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান (প্রসূতি ও স্ত্রী রোগ বিভাগ)

হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল সাবেক সভাপতি, ওজিএসবি।

সর্বশেষ খবর