বৃহস্পতিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

শিক্ষা দিবস, শিক্ষার অধিকার ও সংকট

ড. মঞ্জুরে খোদা

শিক্ষা দিবস, শিক্ষার অধিকার ও সংকট

আইয়ুব খান ক্ষমতা নিয়েই শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর পাকিস্তান শিক্ষা বিভাগের সচিব এস এম শরীফকে শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ করে একটি কমিশন গঠন করেন। এ কমিশন ’৫৯ সালের ২৬ আগস্ট তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। আইয়ুব সরকার ’৬২ সালে এ রিপোর্টের সুপারিশ বাস্তবায়ন শুরু করেন।

শরীফ কমিশনের বিরুদ্ধে ’৬২ সালের ১০ আগস্ট ঢাকা কলেজের ছাত্ররা এক সমাবেশে মিলিত হন। সে সভায় ১৫ আগস্ট সারা দেশে ছাত্র ধর্মঘট ও ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ের সামনে অবস্থান ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এসব কর্মসূচি সফল করতে ১৫ আগস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টানা কর্মসূচি চলতে থাকে। ঢাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে।

আন্দোলন দমন করতে তৎকালীন শাসক ১৪৪ ধারা জারি করে ছাত্র ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। অন্যথায় আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমন করার হুমকি দেন। ছাত্ররা ১০ সেপ্টেম্বর কর্মসূচি প্রত্যাহার করে ১৭ সেপ্টেম্বর হরতালের ডাক দেয়। হরতাল চলাকালে ও ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশের গুলিতে নবকুমার স্কুলের ছাত্র বাবুল, বাস কন্ডাক্টর গোলাম মোস্তফা, গৃহকর্মী ওয়াজিউল্লা ও টঙ্গীর শ্রমিক সুন্দর আলী নিহত হন। অনেকে আহত ও গ্রেফতার হন। গণবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ’৬২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর পল্টন ময়দানে ছাত্রসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকে শিক্ষানীতি বাতিল, হত্যার বিচারসহ ছাত্রদের দাবি মানতে ‘চরমপত্র ঘোষণা’ করা হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে তৎকালীন সামরিক শাসক শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন স্থগিত করে। এর পরের বছর ’৬৩ সাল থেকে ছাত্ররা ১৭ সেপ্টেম্বরকে ‘শিক্ষা দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। তখন থেকে বাংলাদেশের সব ছাত্র সংগঠন এ দিবসটি পালন করে। আজ সেই মহান শিক্ষা দিবস।

শরীফ কমিশনের বিরুদ্ধে, শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সেদিনের সে আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র-জনতার এক প্রতিরোধ আন্দোলন। সেদিনের বিক্ষোভ মিছিলে প্রায় ৯০ ভাগ মেহনতি ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। বুড়িগঙ্গা নদীর ওপার থেকে নৌকার মাঝিরা পর্যন্ত বৈঠা হাতে মিছিল অংশ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে যে চারটি আন্দোলন ও কালপর্বকে নির্দিষ্ট করা হয় তার একটি ’৬২-এর এ শিক্ষা আন্দোলন। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচন- এ চার প্রধান সংগ্রাম ও ঘটনার পরিণতিই হচ্ছে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

শরীফ কমিশনের প্রতিবেদনে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষাসংক্রান্ত সামগ্রিক নির্দেশনা ছিল। শিক্ষার ব্যয়ভার, শিক্ষার মাধ্যম, পাঠক্রম-পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষা প্রশাসন, শিক্ষার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের বিস্তারিত উল্লেখ ছিল।

১। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাব্যয়ের শতকরা ৬০ ভাগ ছাত্রদের বেতনের মাধ্যমে আদায়, বাকি ৪০ ভাগ স্কুল কর্তৃপক্ষ ও সরকার ২০ শতাংশ করে বহন করবে। ২। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সর্বোৎকৃষ্ট মানের আলেম তৈরির কাজ করতে হবে। ৩। প্রাথমিক বিদ্যালয়ই হবে অধিকাংশ ছেলেমেয়ের জীবনের শেষ পর্যায়ের লেখাপড়া। ৪। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পরিচালনায় নিয়ন্ত্রণ করা হবে। স্বায়ত্তশাসন বলে কিছু থাকবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষকের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হবে। ৫। সস্তায় শিক্ষা লাভ করা যাবে না, এ কথা জনগণকে পরিষ্কার করে বলে দেওয়া হয়। ৬। শিক্ষা হবে ব্যয়বহুল বিশেষত বিজ্ঞান, প্রকৌশল, কৃষি ও কারিগরি বিদ্যা। শিক্ষা উন্নয়নের দায়-ব্যয় অভিভাবকদের বহন করতে হবে। সরকারের ওপর নির্ভরশীলতা গ্রহণযোগ্য হবে না। ৭। রিপোর্টে বলা হয়, ‘অবৈতনিক শিক্ষার ধারণা, বস্তুত অবাস্তব কল্পনা মাত্র। শিক্ষকদের বেতন, শিক্ষা উপকরণ, গৃহনির্মাণ করতে অভিভাবকদের কাছ থেকে আদায়ের কথা বলা হয়। ৮। পাঁচ বছর প্রাথমিক, তিন বছরে স্নাতক ডিগ্রি কোর্স ও দুই বছরের স্নাতকোত্তর কোর্সের প্রস্তাব করা হয়। উচ্চশিক্ষা পাসের নম্বর ধরা হয় শতকরা ৫০, দ্বিতীয় বিভাগ ৬০ এবং প্রথম বিভাগ ৭০ নম্বর। ৯। শিক্ষকদের ১৫ ঘণ্টা কাজের কথা বলা হয়। ১০। রিপোর্টে বর্ণমালা সংস্কারেরও প্রস্তাব ছিল। কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় শব্দের রূপান্তর ঘটিয়ে ইসলামীকরণ করা হয়। যেমন ‘কবি নজরুলের বিখ্যাত কবিতা ‘চল্ চল্ চল্’-এর ‘নব নবীনের গাহিয়া গান, সজীব করিব মহাশ্মশান’ চরণের সংশোধন করে লেখা হয় ‘সজীব করিব গোরস্থান’। জনপ্রিয় ছড়া ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি সারা দিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।’ এটি পরিবর্তন করে করা হলো- ‘ফজরে উঠিয়া আমি দিলে দিলে বলি সারা দিন যেন আমি নেক হয়ে চলি।’

তৎকালীন ছাত্রসমাজ এ কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে এ নীতিকে বাতিল করতেই বাধ্য করেনি, তারা একটি বিকল্প প্রস্তাবও হাজির করেছিল। ’৬৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন থেকে সব সংগঠনের পক্ষ থেকে শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় তৎকালীন শাসকের প্রতি ২২ দফার দাবি উত্থাপন করে।

১. স্কুল পর্যায়ে বৈজ্ঞানিক পাঠ্যসূচি প্রণয়ন, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক, কিন্ডারগার্টেন বাতিল, সারা দেশে এক ধরনের শিক্ষা চালু করা ২. প্রতিটি কলেজে উন্নত গবেষণাগার, লাইব্রেরি, ন্যায্যমূল্যে শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ ৩. উন্নত প্রকৌশল ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা গড়ে তোলা ৪. মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল গড়ে তোলা ৫. অধিক আসন সংখ্যাসহ কৃষি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা, গবেষণার মান বাড়ানো ৬. বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও বিভাগ খুলতে হবে ৭. শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা ৮. নারী শিক্ষার উন্নয়ন ৯. মাদ্রাসা শিক্ষাকে বিজ্ঞানভিত্তিক, আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করার প্রস্তাব দেওয়া হয়।

লেখক: গবেষক, সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন।

সর্বশেষ খবর