শনিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

জিহাদের বায়োফ্লক : মৎস্যশিল্পে সম্ভাবনাময় দ্বিতীয় বিপ্লব

শাইখ সিরাজ

জিহাদের বায়োফ্লক : মৎস্যশিল্পে সম্ভাবনাময় দ্বিতীয় বিপ্লব

কৃষি এখন আর আগের কৃষি নেই। ক্রমেই পাল্টে চলেছে। এখন ফসল উৎপাদনে যেমন হিসাব করা হয় প্রতি ইঞ্চি মাটি থেকে কত বেশি ফসল তোলা যায়, একইভাবে মাছ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও হিসাব করা হচ্ছে পুকুর কিংবা দিঘি নয়, প্রতি লিটার পানি থেকে কী পরিমাণ মাছ তোলা যায়। আর কৃষি উৎপাদন খাতে বিজ্ঞানের এ বৈপ্লবিক বিকাশ নিয়ে দেশ-বিদেশের অনেক অজানা তথ্য আমি চেষ্টা করেছি আপনাদের সামনে তুলে ধরতে। শুরুতে বিষয়টি ছিল ঘরের মধ্যে মাছ চাষ। এই তো কয়েক বছর আগে সায়েন্স ল্যাবরেটরি রিসার্কুলেটিং অ্যাকুয়াকালচার ‘রাস’ পদ্ধতি শুরু করল। পদ্ধতিটির আদ্যোপান্ত জানতে গিয়েছিলাম চীনের জানসান শহর থেকে আড়াই শ কিলোমিটার দূরের এক বিশাল ইনডোর ফিশ ফার্মে। সেখানে রীতিমতো শিল্পকারখানার আদলে গড়ে তোলা হয়েছে অল্প সময়ে, সামান্য পরিধির হাউসে বিপুল পরিমাণ মাছ উৎপাদনের ব্যবস্থা।

পৃথিবী আমাদের মুঠোয় চলে এসেছে। স্মার্টফোনে মুহূর্তে জেনে নিতে পারছি পৃথিবীর তাবৎ কিছু। পৃথিবীর এক প্রান্তে কোনো ঘটনা ঘটলে নিমিষেই পৌঁছে যাচ্ছে অন্য প্রান্তে। তথ্যই পাল্টে দিচ্ছে মানুষের চিন্তার জগৎ, কাজের পরিধি। সারা পৃথিবীর মানুষ এখন একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ফলে মাছ চাষের নতুন সব প্রযুক্তি সম্পর্কে মানুষ সহজেই জেনে যাচ্ছে। আর নিজের মতো করে প্রয়োগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইউটিউবেও মানুষ দেখছে ইন্দোনেশিয়াসহ পৃথিবীর অনেক স্থানেই অভাবনীয় ঘনত্বে মাছ উৎপাদন। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ঢাকার উত্তরার খানটেক এলাকায় আমিনুল ইসলাম তার বাসায় রাসের পাশাপাশি নতুন পদ্ধতি বায়োফ্লক শুরু করার কথা। সে সময় তিনি বলেছিলেন বায়োফ্লকের বিরাট সম্ভাবনার গল্প। তার সে গল্পে অনুপ্রাণিত হয়ে অসংখ্য তরুণ উদ্যোক্তা ঝাঁপিয়ে পড়ল মাছ চাষের নতুন এ পদ্ধতিটি নিয়ে। ভিতরে ভিতরে শুরু হয়ে গেল বিপ্লব। রাজশাহীর ইমদাদুল হক দেখালেন বায়োফ্লক প্রকল্পের সাহায্যে পোনা উৎপাদনের কৌশল। সেই সঙ্গে দর্শকদের জানালেন তার স্বপ্নের গল্প। মানুষের বিপুল আগ্রহের কারণে বায়োফ্লক পদ্ধতির মাছ চাষ ব্যবস্থাকে সম্প্রসারণের নতুন অভিযান হিসেবে এক এক করে উদ্যোক্তাদের গল্পগুলো তুলে আনতে লাগলাম। এবার ঘর থেকে উঠোনে। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে জহুরুল হক ও মুস্তাফিজুর রহমান উঠোনে শুরু করলেন বায়োফ্লকের বিরাট প্রকল্প। দিনে-রাতে একাধিকবার ওই প্রকল্পের আদ্যোপান্ত ধারণ করলাম। মৌসুমজুড়ে পর্যবেক্ষণ করলাম বায়োফ্লক পদ্ধতির লাভালাভ ও মাছ চাষের হিসাব। তারা জানিয়েছিলেন, এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে যে ফল পেয়েছেন তাতে তারা খুশি।

এরই মধ্যে বায়োফ্লক ছড়িয়ে গেছে সারা দেশে। আমার কাছে উৎসাহী ও উদ্যমী তরুণরা দল বেঁধে আসতে শুরু করল। আমি তাদের পাঠিয়েছি একেকটি সফল খামারে। দেখুক, জানুক, বুঝুক, তারপর কাজে নামুক। কুমিল্লার শিক্ষিত তরুণ রোমেল মজুমদার তার নিজস্ব বাণিজ্যিক কেন্দ্রে অন্যান্য ব্যবসার জায়গায় স্থাপন করলেন বিরাট বায়োফ্লক প্রকল্প। শুরু হলো নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পৌরসভার মেয়র নিজামউদ্দিন রাস ও বায়োফ্লকের মাঝামাঝি আরেকটি বিজ্ঞানসম্মত প্রকল্প গ্রহণ করলেন। বিশাল ওই প্রকল্পটি ‘বটম ক্লিন’ প্রযুক্তির। তরুণ উদ্যোক্তারা নাছোড়বান্দা হয়ে লেগে থাকল অভাবনীয় লাভের এ উদ্যোগে। কেউ শুরু করল কাগজে-কলমে গবেষণা। শুরু হলো সারা পৃথিবীর তথ্য-উপাত্ত ও কারিগরি সহায়তাবিষয়ক তৎপরতা। ময়মনসিংহের ভালুকার আশ্রাফুল ইসলাম বায়োফ্লক প্রকল্প স্থাপনের পাশাপাশি ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এর সঙ্গে যৌথভাবে যুক্ত হলো এ-বিষয়ক একটি প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল প্রকাশের কাজে। আশা করছি খুব শিগগিরই বায়োফ্লক বিষয়ে একটি কারিগরি সহায়িকা আগ্রহী উদ্যোক্তাদের হাতে তুলে দিতে পারব।

বায়োফ্লক নিয়ে বহুমুখী তৎপরতার এ পর্যায়ে এক বৃহৎ উদ্যোগের গল্প আপনাদের শোনাতে চাই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার কালিকচ্ছ মনিরবাগ এলাকায় এক তরুণ জিহাদ আহমেদ বায়োফ্লকে মাছ চাষের বিশাল উদ্যোগ নিয়েছেন। কৃষি উদ্যোক্তা জিহাদ আহমেদ ২০০৪ সাল থেকে মাছ চাষ ও পোলট্রি খামারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু পোলট্রি শিল্পের লোকসানে বিরাট ক্ষতির মুখে পড়ে যান তিনি। লোকসান কাটিয়ে উঠতে উদ্যোগ নেন বায়োফ্লক পদ্ধতির মাছ চাষের। তিনি জানান, বায়োফ্লক সম্পর্কে জানতে বুঝতে তিনি ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণ করে এসেছেন। জেনে বুঝেই বড় আকারে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু করেছেন। ২০১৮ সালে পরিত্যক্ত পোলট্রি শেডকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তোলেন বায়োফ্লক প্রকল্প; দূর থেকে দেখে বোঝারই উপায় নেই যে, এটি মাছ চাষের কারখানা। যদিও ঘরের মধ্যে অধিক ঘনত্বে মাছ উৎপাদনের কার্যক্রমটি এখন আর কারও কাছে নতুন কোনো গল্প নয়। বড় বড় শেডের নিচে অংশজুড়ে ভিন্ন ভিন্ন ট্যাংকে বিভিন্ন মাছ উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি দৃশ্যত এখনো বিস্ময়কর! উদ্যোক্তা জিহাদ আহমেদ জানিয়েছেন, শুরু করেছিলেন মাত্র ছয়টি ট্যাংকে ৬ লাখ লিটার পানিতে। শিং ও তেলাপিয়া মাছ ছিল প্রথম উৎপাদন। যখন দেখলেন এ থেকে সত্যি সত্যি লাভ সম্ভব, ৩০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে নির্মাণ করলেন ৩০ লাখ লিটার পানির বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের ক্ষেত্র। প্রথমেই লাভের অঙ্কে আত্মবিশ্বাস জন্মেছিল জিহাদের মনে। পোলট্রিতে লোকসান পোষাতে আবার বিনিয়োগমুখী হলেন। নতুন এ সম্ভাবনাকে পুঁজি করে একে একে বাড়ালেন মাছের পরিমাণ। এখন ৩৯টি ট্যাংকে সর্বমোট ৩০ লাখ লিটার পানিতে উৎপাদন করছেন তেলাপিয়া, কই, পাঙ্গাশ, পাবদা, শিং, মাগুরসহ বেশ কয়েক রকমের মাছ। দেশের বিভিন্ন স্থানেই এমন বৈপ্লবিক উদ্যোগ নিয়েছেন নতুন নতুন উদ্যোক্তারা। এ পর্যন্ত তুলে ধরা বায়োফ্লক প্রকল্পের মধ্যে এটিই বড় বলে মনে হচ্ছে। তবে মাছ উৎপাদনের এমন সাফল্য পেতে অবশ্যই জানা দরকার বায়োফ্লকের বিজ্ঞানসম্মত সঠিক উপায়। কারণ প্রতি প্রজাতির মাছ উৎপাদনের পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনার ধরন ভিন্ন; যা অনেকেই বোঝেন না বলে ঝুঁকির মধ্যে পড়েন।

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ উৎপাদনের অঙ্ক ও বাণিজ্যটি হচ্ছে অল্প জায়গায় অধিক মাছ। বিজ্ঞানের এ সূত্র মিলে গেলেই লাভ এখানে সুনিশ্চিত। এখন পর্যন্ত চারটি হারভেস্টে প্রতিবারই লাভ ঘরে তুলতে পেরেছেন জিহাদ। তিনি জানালেন, প্রথমবারেই তিনি ৯০ টন মাছ পেয়েছেন। যাবতীয় খরচের ৫০ লাখ বাদ দিয়েও লাভ থাকল ৪০ লাখের মতো। এ হিসাব চার মাসের। তার মানে বুঝে শুনে করতে পারলে এ এক দারুণ সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র।

এ কর্মযজ্ঞের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বায়োফ্লকের জন্য উপযুক্ত পোনা বাছাই করা। মানসম্মত পোনা না হলে শুরুতেই ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে; যা নিরূপণে জিহাদ গড়েছেন পোনা উৎপাদনের হ্যাচারিও। এ পর্যন্ত ২০ লাখ পোনা তিনি বিক্রি করেছেন, হাতে আছে আরও ২০ লাখ। এ শুধু মাছ উৎপাদনের খামার নয়, যেন একটি মিনি সমুদ্র। এমনটাই বলছিলেন প্রকল্পের প্রযুক্তি ও উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় নিযুক্ত টেকনিশিয়ান সালমান শাহ। তিনি বলেন, বায়োফ্লকে ব্যবহৃত পানির গুণগত ধরন সমুদ্রের মতোই। পানির স্যালাইনিটি, পিএইচ, টিডিএস কিংবা অ্যামোনিয়ার পরিমাণ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত। একেক প্রজাতির মাছের প্রয়োজনীয় উপাদানের উপস্থিতিও একেক রকমের।

দিনে দিনে বায়োফ্লকে আগ্রহী হয়ে উঠছেন অনেকেই। নতুন আগ্রহীরা ভিড় জমাচ্ছেন দেশের বিভিন্ন বায়োফ্লক খামারে। নতুনদের এ বিষয়ে শিক্ষা নেওয়ার ব্যপারে আরও সজাগ হতে হবে। অল্প জেনে বিনিয়োগে না আসাই উত্তম বলছেন জিহাদ। তিনি নিজে এখনো এ বিষয়ে নতুন তথ্য জানতে বা শিখতে ছুটে চলেন। কারণ মাছ চাষের এ অভিনব পদ্ধতির মধ্যেই তিনি স্বপ্ন বুনেছেন আগামীর। সে লক্ষ্যে আরও ৫০ লাখ লিটার পানির বায়োফ্লক গড়ার কাজে হাত দিয়েছেন।

মাছ উৎপাদনে আমাদের সাফল্য দৃষ্টান্তমূলক। পৃথিবীতে মাছ চাষের ক্ষেত্রে রেকর্ড ছাড়িয়ে শীর্ষস্থানে পৌঁছে যাওয়াটি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এরই মধ্যে পূরণ হয়ে গেছে দেশের চাহিদা। আর মাছ উৎপাদনে এ বিরাট সাফল্যের পেছনে একদিকে বছর বছর তরুণ উদ্যোক্তাদের শ্রম ও নিষ্ঠা যেমন রয়েছে, এখন তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তি। সবচেয়ে আশার কথা, তরুণ উদ্যোক্তাদের গ্রহণ করা এসব প্রযুক্তিকে এখন সাদরে গ্রহণ করছে সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানও। আপনারা দেখেছেন ইতোমধ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট পরীক্ষামূলক বায়োফ্লক প্রকল্প স্থাপন করেছে। সরকারিভাবে শুধু বায়োফ্লক পদ্ধতি নিয়েই পৃথক প্রকল্প গ্রহণের কথাও আমরা জেনেছি। আশা করা যায়, এ বিষয়ে আরও প্রয়োজনীয় গবেষণা ও সম্প্রসারণের আনুষ্ঠানিক বিকাশ ঘটবে; যাতে তরুণ উদ্যোক্তারা কোনোভাবেই লোকসানের শিকার না হয়। মাছ চাষের এ বিশাল সাফল্যজনক তৎপরতাগুলো সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ, মনিটরিংসহ বিজ্ঞানসম্মত সহায়তার জন্য সরকারেরও বাস্তবমুখী ও আধুনিক প্রস্তুতি গ্রহণ করার প্রয়োজন রয়েছে।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর