শনিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

শুকরিয়া আদায় করতে হবে

এম এ মান্নান

শুকরিয়া আদায় করতে হবে

রাখে আল্লাহ মারে কে- এমন একটি প্রবচন আমাদের দেশে বেশ প্রচলিত।

করোনাকালে এ সত্যটি আরও বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে জনমনে। জন্ম ও মৃত্যু আল্লাহর ইচ্ছাধীন। আল্লাহ মানুষকে হেদায়াতের জন্য বালামুসিবত দেন আবার তিনিই মানুষকে সে বিপদ থেকে রক্ষা করেন। দুনিয়াজুড়ে মনুষ্যত্বের অবক্ষয় যখন আমাদের বিবেকবোধকে জর্জরিত করছিল, তখনই মানুষকে শিক্ষা দিতে আল্লাহ করোনাভাইরাস নামের মহামারী ছড়িয়ে দিয়েছেন। করোনাভাইরাস মানবজাতির জন্য সাক্ষাৎ বিপদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এবং ইতোমধ্যে কয়েক লাখ মানুষ প্রাণও হারিয়েছে। আনুমানিক হিসাবে পৃথিবীর কয়েক কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এ ঘাতক ভাইরাসে। দুনিয়াজুড়ে মানুষের জীবন ও জীবিকায় তা যে স্থবিরতা সৃষ্টি করেছে আর্থিক বিচারে সে ক্ষয়ক্ষতি গত দুটি বিশ্বযুদ্ধের চেয়ে বেশি।

মহামারী কেন হয়- এর সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উত্তর দিয়েছেন রসুল (সা.) নিজেই। তিনি বলেছেন, ‘যখন কোনো প্রজন্ম অশ্লীলতা ও আল্লাহদ্রোহিতায় সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন তাদের মাঝে দুর্ভিক্ষ এবং নতুন নতুন রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ে। এমন এমন রোগবালাই তাদের আক্রমণ করে বসে যা ইতিপূর্বে পৃথিবীর বুকে আর কখনো দেখা যায়নি।’ ইবনে মাজাহ।

রসুল (সা.) আরও বলেছেন, ‘পৃথিবীবাসীর জন্য মহামারী শাস্তি। তবে বিশ্বাসী বান্দাদের জন্য এটি রহমত।’ বুখারি। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসরা বলেছেন, মহামারীর মধ্যেও আল্লাহ মোমিন বান্দাকে হেফাজত করেন। তখন মোমিন বান্দার বিশ্বাস আরও শক্ত হয়। আর যেসব মোমিন বান্দা দুর্বল ইমানের অধিকারী হয়, মহামারীর সময় তারা তওবাহ করে আল্লাহর রহমতের কোলে আশ্রয় নেয়। এ কারণে মহামারীকে মোমিনের জন্য রহমত বলা হয়েছে। করোনাভাইরাসে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে এমন আশঙ্কার কথা বলা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে যেখানে ২ লাখের বেশি করোনায় প্রাণ হারিয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারতে মৃতের সংখ্যা ৮০ হাজার ছাড়িয়েছে, সেখানে এমন আশঙ্কা জাগতিক বিচারে অসম্ভব ছিল না। দেশে এ পর্যন্ত করোনায় শনাক্তের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৩ লাখ। বাস্তবে এ সংখ্যা বহুগুণ। কারণ সিংহভাগ করোনা আক্রান্তই শনাক্তকরণের ঝামেলা এড়িয়ে চলেছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যাপারে অসতর্ক হওয়া সত্ত্বেও মৃতের সংখ্যা ৫ হাজারের নিচে। করোনাভাইরাসের লক্ষণ নিয়ে যারা মারা গেছেন তার সংখ্যা ২ হাজারের কাছাকাছি। মহাজ্ঞানী আল্লাহ দয়ালু ও ক্ষমাশীল। তিনি তাঁর প্রিয় বান্দার সমূলে ধ্বংস চান না। বিশেষ করে গরিব ও অসহায়দের প্রতি তিনি সহনশীল। যে কারণে বাংলাদেশের জন্য আল্লাহর রহমতের দুয়ার খোলা ছিল। সবারই জানা উচিত রহমত করার মালিক একমাত্র আল্লাহ। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জেনে রেখ! যদি সব সৃষ্টি একত্র হয়ে তোমার কোনো উপকার করতে চায়, তবু তারা আল্লাহর নির্ধারিত পরিমাণ ছাড়া কখনই তোমার উপকার করতে পারবে না। আর যদি সব সৃষ্টি একত্র হয়ে তোমার কোনো ক্ষতি করতে চায়, তবু তারা আল্লাহর নির্ধারিত পরিমাণ ছাড়া কখনই তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। কলম তুলে নেওয়া হয়েছে এবং দফতরসমূহ শুকিয়ে গেছে।’ তিরমিজি।

আলোচ্য হাদিসে রসুলুল্লাহ (সা.) মোমিনদের আল্লাহর সান্নিধ্য ও নৈকট্যলাভে উৎসাহিত করেছেন। যেন তারা ইমান, ইখলাস (সততা), ইবাদত ও আনুগত্যের মাধ্যমে আল্লাহর ভালোবাসা, সান্নিধ্য ও রহমতের দৃষ্টিলাভে সক্ষম হয়। পার্থিব জীবনে তারা কখনো আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত না হয়। বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবে আল্লাহভীরু। যারা হজ করেছেন তারা জানেন হজের সময় বাংলাদেশের হাজিরা পবিত্র কারাগৃহে ও মদিনায় ইবাদত-বন্দেগিতে যতটা সময় কাটান অন্য কোনো দেশের হাজিরা তার অর্ধেক সময়ও ব্যয় করেন না। আগেই বলেছি, বাংলাদেশেও করোনা আবির্ভূত হয়েছে সাক্ষাৎ অভিশাপ হিসেবে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জিডিপি প্রবৃদ্ধির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় দ্রুত অগ্রযাত্রার যে স্বপ্ন সৃষ্টি করেছিল, তার অনেকটাই কেড়ে নিয়েছে করোনাভাইরাস। আল্লাহ মানুষকে যেমন মুসিবত দেন, তেমন তা থেকে রক্ষার পথও তৈরি করেন। করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানুষের টিকে থাকা ও জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে ভ্যাকসিন উদ্ভাবন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিভিন্ন সংস্থার ২৭টি ভ্যাকসিন পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পর্যায়ে আছে। এর মধ্যে রাশিয়া প্রথম ভ্যাকসিন প্রয়োগের ঘোষণা দেওয়ায় বিশ্বজুড়ে হইচই পড়ে গেছে। এর বাইরে ভ্যাকসিন তৈরির কাজে এগিয়ে আছে ব্রিটেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়ার ভ্যাকসিন ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পেয়েছে। অন্যগুলো অনুমোদন পাওয়ার অপেক্ষায়। ভারতেও অক্সফোর্ডের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রস্তুতি চলছে। অক্সফোর্ড ও চীনা ভ্যাকসিন বাংলাদেশকে সহজ শর্তে সরবরাহের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করব, ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য সরকার উদ্ভাবক সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি যাতে মাথা চাড়া দিয়ে না ওঠে সে ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা হবে। কেনার ক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে স্বচ্ছতা।

করোনায় বাংলাদেশে ভয়াবহ বিপর্যয়ের যে আশঙ্কা করা হয়েছিল তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। এজন্য আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করতে হবে। যে কারণে আল্লাহ বান্দার প্রতি নাখোশ হন, সে ত্রুটিগুলো দূর করতে হবে।

লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর