রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

নারী শ্রমিক : প্রসঙ্গ কৃষি ক্ষেত্র

আশরোফা ইমদাদ

কারিমা আক্তার, পেশায় কৃষক। বসতভিটার সামনেই এক চিলতে জমি তার। স্বামী মারা যাওয়ার পর এ জমিতে তরমুজ আর শাকসবজি চাষ শুরু করেন তিনি। উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রি করে চলে কারিমা ও তার ছোট দুই সন্তানের সংসার। এ ছাড়া তিনি গ্রামের একটি ধানের খোলায় কুঁড়া শুকানোর কাজ করেন। সেখান থেকে যা আয় হয় তা মিলিয়ে তার সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চলে যায়। ধানের খোলায় কখনো বেশি পান, কখনো কম। যেদিন খোলার মালিক কোনো পুরুষ শ্রমিক পান সেদিন আর কারিমাকে বেশি টাকা দেন না। বলেন, পুরুষের তুলনায় কাজ কম হয়েছে। যা পান তাতেই সন্তুষ্ট থাকেন কারিমা। কিন্তু পুরুষের সমান কাজ করেও দিন শেষে মজুরিবৈষম্য তাকে যেন মিইয়ে দেয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি এখনো মূল চালিকাশক্তি। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় গ্রামীণ নারীরা কৃষিকাজ ও কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম নয়।

১৯৯৬-৯৯-এর শ্রমশক্তি জরিপে প্রথমবারের মতো কৃষি ক্ষেত্রে নারীদের জড়িতকরণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। গবাদি পশু পালন, হাঁস-মুরগির খামার, ধানের কুঁড়া শুকানো, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও খাদ্য সংরক্ষণের মতো কাজগুলোকে অর্থনৈতিক কার্যক্রম হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এসব কাজ বেশির ভাগ গ্রামে নারীর দ্বারা পরিচালিত হয়। ২০০৫-০৬-এর শ্রমশক্তি জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ১৫ বছরের বেশি জনসংখ্যার ৪৮.১ শতাংশ কৃষি ক্ষেত্রে নিযুক্ত ছিল। শ্রমশক্তির এ জরিপ অনুসারে পুরুষের মধ্যে ৪১.৮ আর নারীর মধ্যে ১৮.১ শতাংশ সরাসরি কৃষিতে কাজ করছিল। এতে দেখা গেছে, কৃষি কেবল কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বড় খাত ছিল না, এটি নারীর অংশগ্রহণ ও সামাজিক গতিশীলতার বৃহত্তম ক্ষেত্রও ছিল। বিগত দশকে কৃষি ক্ষেত্রে পুরুষের অংশগ্রহণ ১০ শতাংশের বেশি হ্রাস পেয়েছে। এ ব্যবধানটি নারী শ্রমিকের দ্বারা পূরণ হয়েছে। বর্তমানে ৭০ শতাংশের বেশি নারী শ্রমিক কৃষি ক্ষেত্রে নিযুক্ত আছে। কৃষি খাতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা গত দশকে ৪.৫ মিলিয়নের বেশি বেড়েছে। সার হিসেবে ছাই ছিটানোর ক্ষেত্রে, মাটির ওপরের স্তরে বিভিন্ন জৈব পদার্থের ব্যবহার, পাহাড়ের জুম চাষ ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়। ফসল উৎপাদনে নারীর অবদান ২৭ শতাংশ বলে অনুমান করা হয়। এর ফলে গত দুই দশকে সবজি উৎপাদন ৫ গুণ বেড়েছে।

নারীর অংশগ্রহণের হার কৃষিতে ১৩৬ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে, যখন সামগ্রিকভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের অংশগ্রহণ বেড়েছে ১৯৯৯ থেকে ২০১৬-১৭ পর্যন্ত ৫৫.৯৭ ভাগ। একই সময়ে পুরুষের অংশগ্রহণ ১৬ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। মজুরির হার, শিক্ষা, প্রশিক্ষণের সুযোগ ও বাজারে অ্যাক্সেস বিষয়গুলো কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণকে প্রভাবিত করে। কৃষিতে নারীর যুক্ততায় বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় বাধা কাজ করে। এ ছাড়া পিতা-মাতার নিরুৎসাহ, শ্বশুর-শাশুড়ি, সমাজ ইত্যাদি নারীর কাজের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

বিভিন্ন সূত্রমতে নারী শ্রমিকরা সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি পুরুষের সমান কাজ করে এবং কৃষিতে ২১ ধরনের কাজের মধ্যে ১৭ ধরনের কাজের সঙ্গে নারী জড়িত। তার পরও তাদের কাজের স্বীকৃতি নেই। আসলে নারী তার অবদান সম্পর্কে সচেতন নয়; সচেতন নয় তার কাজের স্বীকৃতি বিষয়েও। যদিও তারা যথাযথ প্রক্রিয়া, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, কম মজুরিসহ অন্য আরও বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের মুখোমুখি হয়।

নারী কৃষকের জমির ওপর মালিকানা না থাকায় তারা কৃষকের জন্য সরকারের দেওয়া সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নারী কৃষক যদি এ সুবিধা পেত তবে কৃষিতে তার অবদান আরও বাড়ত। নারী কৃষক মূলত প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ, সম্প্রসারণ সুবিধা ও সেচ ব্যবস্থাপনা থেকে বঞ্চিত হয়। কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে ব্যর্থতার কারণে তারা পিছিয়ে পড়ছে। তারা তাদের পণ্য বিক্রিতে সমস্যার মুখোমুখি হয়।

যদিও কৃষি ক্ষেত্রে নারীর অবদান প্রচুর তবু তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। পারিবারিক কাজ ছাড়াও ৭৭ ভাগ গ্রামীণ নারী তার পুরুষ সহকর্মীর পাশাপাশি সন্ধ্যা পর্যন্ত কৃষিকাজ করে। সারা দেশে ১৪ মিলিয়নের বেশি কৃষক কার্ড বিতরণ করা হয়েছে, এতে নারীর অংশ খুবই নগণ্য। কৃষক হিসেবে স্বীকৃতির অভাবে তারা সরকার-প্রদত্ত কৃষিবীমা কভারেজ ও অন্যান্য সুবিধাও সেভাবে পায় না। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের উন্নয়নের পথে নারীর মর্যাদা এখনো ন্যায্য ও সংগত নয়। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির গবেষণা অনুসারে বাংলাদেশের নারী প্রতিদিন কৃষিসহ গৃহস্থালি কাজে গড়ে ১৬ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে। আর্থিক ক্ষেত্রে এ অবদানটি ৬০১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমতুল্য। এ পরিমাণ অর্থ দেশের জিডিপিতে যুক্ত করা গেলে জিডিপির আকার বেড়ে যেত। পুরুষের দ্বারা সম্পাদিত প্রায় ৯৮ শতাংশ কাজ জিডিপিতে যুক্ত করা হয়, কিন্তু নারীর ক্ষেত্রে মাত্র ৪৭ শতাংশ। তাদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি, পরিবারকল্যাণ, সামাজিক ও আইনি অধিকার, রাষ্ট্রীয় সুবিধাসমূহ সরবরাহ করা প্রয়োজন। নারী কৃষকের প্রয়োজন অনুসারে কৃষির সব নীতিমালা প্রণয়ন ও পরিকল্পনার ক্ষেত্রে নারী কৃষক ও উদ্যোক্তাদের সরাসরি জড়িত হওয়া নিশ্চিত করা দরকার।

নারীকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা, তার পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত-করণের জন্য সরকার ‘জয়িতা ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেছে। বর্তমান সরকার জয়িতা ফাউন্ডেশন পর্যায়ক্রমে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সম্প্রসারিত করে দেশব্যাপী একটি নারীবান্ধব আলাদা বিপণন নেটওয়ার্ক গড়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে নারীর সামগ্রিক ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে লিঙ্গসমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ সরকারের লক্ষ্য। দেশের প্রতিটি বাজারে নারীবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন নারী শ্রমিক যেন তার উৎপাদিত পণ্য ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারে তা এখন সময়ের দাবি। আর এ লক্ষ্যেই কাজ করছে সরকার।

লেখক : সমাজ বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর