সোমবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা
আইন-আদালত

ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণে জটিলতা কেন?

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণে জটিলতা কেন?

আমরা সবাই জানি, রাষ্ট্র বা সরকার দেশের উন্নয়ন কর্মকা- বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অবকাঠামো নির্মাণে দেশে প্রচলিত ভূমি অধিগ্রহণ আইন অনুসারে আপনার মালিকানাধীন বা দখলাধীন ভূমি সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে। অর্থাৎ সরকার জনস্বার্থে এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে যেমন শিল্প কারখানা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রেলপথ, সড়ক বা সেতুর প্রবেশপথ বা এ-জাতীয় অন্য কিছুর জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন পড়লে সরকার দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে যে কারও জমি অধিগ্রহণ করতে পারে। তবে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল আইন, ২০১৭ ধারা (১৩) অনুসারে ধর্মীয় উপাসনালয়, কবরস্থান ও শ্মশান অধিগ্রহণ করা যাবে না। তবে শর্ত আছে, এগুলোও অধিগ্রহণ করা যাবে যদি তা জনস্বার্থে একান্ত অপরিহার্য হয়। সে ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত ব্যক্তি বা সংস্থার অর্থে স্থানান্তর ও পুনর্নির্মাণ করে দিতে হবে। আপনার জমি অধিগ্রহণ হলে কী করবেন : আপনার অনেক কিছুই করার আছে। স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল আইন, ২০১৭-এর ধারা (৫) অনুযায়ী সরকারের পক্ষ থেকে ৪ ধারার নোটিস জারির পর আপনি ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের কাছে আপত্তি দাখিল করতে পারবেন। আপত্তি পাওয়ার পর সম্পত্তির পরিমাণ ৫০ বিঘার ঊর্ধ্বে হলে তাঁর মতামতসংবলিত প্রতিবেদনসহ নথি ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের জন্য পাঠাবেন। আর জমির পরিমাণ ৫০ বিঘার কম হলে আপনার মতামতসংবলিত প্রতিবেদনসহ নথি কমিশনারের কাছে পাঠাবেন। সরকার বা কমিশনার কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত জনপ্রয়োজন বা জনস্বার্থে গৃহীত হয়েছে বলে গণ্য হবে এবং এটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, এর বিরুদ্ধে কোথাও আপিল করা যাবে না। সব শেষে দেখা যাচ্ছে, ৩ ও ৪ ধারার নোটিস জারি করার পরই কেবল শেষবারের মতো ৭ ধারায় নোটিস জারি করা হয়। ৭ ধারায় নোটিস জারির পর আর কোনো অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে না। জমির মূল্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে কীভাবে আদায় করবেন : নোটিস জারির সময় সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির বাজারমূল্য নির্ধারণের সময় উক্ত স্থাবর সম্পত্তির পারিপার্শ্বিক এলাকার সমশ্রেণির ও সমান সুবিধাযুক্ত স্থাবর সম্পত্তির নোটিস জারির আগের ১২ মাসের গড় মূল্য হিসাব করা হবে। তবে যে বিষয়গুলো সরকারপক্ষ থেকে বিবেচনা করা হয় সেগুলো নিম্নরূপ- ১. জমির ওপর দ-ায়মান যে কোনো ফসল বা বৃক্ষের জন্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ক্ষতি। ২. অধিগ্রহণের কারণে স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিদ্যমান অন্য স্থাবর সম্পত্তি থেকে প্রস্তাবিত স্থাবর সম্পত্তি বিভাজনের ফলে সৃষ্ট ক্ষতি। ৩. অধিগ্রহণের কারণে স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অন্যান্য স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি বা উপার্জনের ওপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাবের ফলে সৃষ্ট ক্ষতি। ৪. অধিগ্রহণের কারণে স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে তার আবাসস্থল বা ব্যবসা কেন্দ্র স্থানান্তর করতে বাধ্য করা হলে উক্তরূপ স্থানান্তরের জন্য যুক্তিসংগত খরচাদি। ৫. সরকারি কোনো প্রয়োজনে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বাজারদরের ওপর অতিরিক্ত শতকরা ২০০ ভাগ ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হবে। (অর্থাৎ সম্পত্তির মূল্য ২ কোটি টাকা হলে আপনাকে আরও ৪ কোটি টাকা অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে)। ৬. বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে উক্ত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ হবে বাজারদরের ওপর অতিরিক্ত শতকরা ৩০০  ভাগ। (অর্থাৎ সম্পত্তির মূল্য ২ কোটি টাকা হলে আপনাকে আরও ৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে)। ৭. অন্যান্য কারণে সৃষ্ট ক্ষতির জন্য উক্ত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ হবে বাজারদরের ওপর অতিরিক্ত শতকরা ১০০ ভাগ। (অর্থাৎ সম্পত্তির মূল্য ২ কোটি টাকা হলে আপনাকে আরও ২ কোটি টাকা অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে)। ৮. উল্লিখিত ক্ষতিপূরণ প্রদান ছাড়া নির্ধারিত পদ্ধতিতে অধিগ্রহণের কারণে বাস্তচ্যুত পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বর্গাদারের আবাদ করা ফসলসহ কোনো স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ করা হলে ফসলের জন্য জেলা প্রশাসক যেমন ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করবেন, একই রকম ক্ষতিপূরণ বর্গাদারকে দিতে হবে। ক্ষতিপূরণ মঞ্জুরির প্রাক্কলিত অর্থ জমা দেওয়ার ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে জেলা প্রশাসক ক্ষতিপূরণের অর্থ বুঝিয়ে দেবেন। কোনো ব্যক্তি ক্ষতিপূরণের অর্থ নিতে অসম্মত হলে বা ক্ষতিপূরণ নেওয়ার দাবিদার পাওয়া না গেলে অথবা ক্ষতিপূরণ দাবিদারের মালিকানা নিয়ে কোনো আপত্তি দেখা দিলে ক্ষতিপূরণের অর্থ সরকারি কোষাগারে রাখা হবে। অধিগ্রহণের জন্য ক্ষতিপূরণ পরিশোধ হওয়ার ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে গেজেট জারির মাধ্যমে অধিগ্রহণ কার্যক্রম শেষ হবে।

রাষ্ট্র কর্তৃক ভূমি অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তি নিয়ে মামলা করা যাবে কিনা : অধিগ্রহণকৃত সম্পত্তি নিয়ে প্রদত্ত কোনো আদেশ বা কোনো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের মামলা বা আবেদন গ্রহণ করার এখতিয়ার রহিত করা হয়েছে। স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল আইন, ২০১৭-এর (৪৭) ধারায় অধিগ্রহণ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা না করার বিষয় উল্লেখ রয়েছে। এর পরও ৮ ধারায় নোটিস জারি সত্ত্বেও অসাধু চক্রের যোগসাজশে টাইটেল স্যুট দায়ের করা হচ্ছে। এতে ভূমির মালিকরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। সংবিধানের ৪২(২) অনুচ্ছেদেও ক্ষতিপূরণসহ বাধ্যতামূলক ভাবে স্থাবর সম্পত্তি গ্রহণের ক্ষেত্রে আদালতে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন বা মামলা না করার বিষয়ে বলা হয়েছে।

বর্তমানে ভূমি মন্ত্রণালয় অধিগ্রহণ সম্পর্কিত ভূমি নিয়ে কোনো প্রকার মামলা-মোকদ্দমা দায়ের করা নিয়ে পরিপত্র জারি করেছে।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

Email : seraj.pramanik@gmail

সর্বশেষ খবর