বুধবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনায় কী করণীয়

আবু হেনা

করোনায় কী করণীয়

আবু হেনা

গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে করোনার ধ্বংসাত্মক লীলা শুরু হওয়ার পর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত ৯ লাখ ৭০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৩ কোটি ১৫ লাখ ২১ হাজার। উৎপত্তিস্থল চীনে ৮৫ হাজারের মতো মানুষ আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা ৪ হাজার ৮৩৫-এ সীমাবদ্ধ থাকলেও চীনের বাইরে এর প্রকোপ ১৩ গুণ বেশি। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ৩ লাখের বেশি লোক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। মৃতের সংখ্যা ৫ হাজার।

যুুক্তরাষ্ট্রের সংক্রামক রোগবিষয়ক শীর্ষ বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউসি বলেছেন, পৃথিবী থেকে করোনাভাইরাস একেবারে নির্মূল করা সম্ভব হবে না। তবে টিকা করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করবে। তিনি আরও বলেছেন, করোনাভাইরাস একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আমি মনে করি না, আমরা পৃথিবী থেকে এ ভাইরাস নির্মূল করতে পারব। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এবং টিকা পেলে আমরা এ ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারব।

এদিকে ৪০ হাজার স্বেচ্ছাসেবীর শরীরে করোনা ভ্যাকসিন ‘স্পুটনিক ভি’ প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাশিয়া। এ ভ্যাকসিন পুতিনের মেয়ের শরীরেও প্রয়োগ করা হয়েছে। নিরাপদ ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে গত ১১ আগস্ট বিশ্বের প্রথম ভ্যাকসিন হিসেবে ‘স্পুটনিক ভি’ অনুমোদনের ঘোষণা দেয় রাশিয়া। এ ভ্যাকসিন বিষয়ে রাশিয়ার টিমের সঙ্গে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সরাসরি আলোচনা চলছে। সংস্থার মতে, ‘যে কোনো সম্ভাব্য টিকার ভালো খবর। তবে একই রকম কঠোর মূল্যায়ন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আমরা টিকা নিয়ে যে নিরাপত্তা ও কার্যকারিতার কথা বলছি তা কেবল রাশিয়ার টিকা নিয়েই নয়, বর্তমানে উন্নয়ন পর্যায়ে থাকা সব টিকার জন্যই তা প্রযোজ্য।’

সংস্থার আরেক কর্মকর্তা হ্যান্স বলেছেন, ‘একবার টিকা অনুমোদন মানেই মহামারীর সমাপ্তি নয়। মহামারী সেদিনই শেষ হবে যখন সবাই দায়িত্বপূর্ণ আচরণ করতে শিখবে এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে কীভাবে চলতে হবে তা শিখে যাবে। এটি পুরোপুরি আমাদের ওপর নির্ভর করছে, সেই দিনটি কালও হতে পারে।’

এক কথায় করোনাভাইরাসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হলে প্রয়োজন একটি সুস্বাস্থ্যকর ‘জীবনযাত্রা পদ্ধতি’ (Healthy life style)। মানবজাতি হাজার হাজার বছর ধরে এ ধরণিতে বসবাস করছে। একসময় গুহায় বাস করত। আজ পর্বতের চূড়ায় আকাশচুম্বী অট্টালিকায় বিলাসবহুল-জীবন যাপন করে মানবকুল প্রকৃতির সঙ্গে তাদের দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। তার পরও তৃতীয় বিশে^র কোটি কোটি মানুষ আজও প্রকৃতির কোলে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমায়। শহরের বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ তাকে স্পর্শ করে না। বাংলাদেশের মতো দেশে করোনায় আক্রান্ত প্রায় সবাই ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য শহরাঞ্চলের বাসিন্দা। এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষ যাদের শতকরা ৮০ ভাগ গ্রামে বাস করে তারা আল্লাহর অসীম রহমতে আজও অনেকটাই অক্ষত আছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের প্রবাসীরা তুলনামূলকভাবে অক্ষত আছে। এর কারণ গ্রামেগঞ্জে এখনো বিভিন্ন ধর্মমতে নির্ধারিত জীবনধারা প্রচলিত রয়েছে।

বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিবেশে একজন মুসলমান গ্রামবাসী প্রত্যুষে আজানের ধ্বনি শুনে ঘুম থেকে উঠে গোসল অথবা অজু করে দুই রাকাত ফজরের নামাজ পড়ে, যা বাধ্যতামূলক। অজু করার জন্য তাকে প্রথমে মুখের ভিতরে পানি দিয়ে তিনবার কুলি করতে হবে, তারপর তিনবার পানি দিয়ে নাকের ভিতর পরিষ্কার করার পর তিনবার পানি দিয়ে চোখ পরিষ্কার করতে হবে। তারপর ভেজা হাত মাথায় বুলিয়ে মাথার পেছন, ঘাড় ও গলা এবং কান পরিষ্কার করতে হবে। তারপর পানি দিয়ে তিনবার দুই হাতের কনুই পর্যন্ত ধোয়ার পর দুই পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত উত্তমরূপে ধুতে হয়। নামাজের মতো এ অজুও বাধ্যতামূলক।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সকালবেলায় এ সুন্দর সুখকর পরিবেশে ঘুম থেকে উঠে দৈনন্দিন জীবন শুরু করলে আয়ু বাড়ে। এভাবে সকালের খাবার খেয়ে দিনপঞ্জি শুরু করে কৃষক লাঙ্গল-গরু নিয়ে মাঠে চলে যায় এবং অন্য পেশার মানুষ যার যার কাজে মনোনিবেশ করে। তারপর দুপুর প্রায় একটার দিকে কাজে বিরতি দিয়ে তারা অজু করে জোহরের নামাজ পড়ে। ফরজ (বাধ্যতামূলক) চার রাকাত এবং ছয় রাকাত সুন্নত ও নফল দিয়ে এ নামাজ ১২ রাকাত পড়া যায়। এরপর দুপুরের খাবার খেয়ে তারা একটু জিরিয়ে নেয়। ব্যস্ত সময়ে এ সুযোগ থাকে না। বিরতির পর আবার তাদের কাজে যেতে হয়। তারপর বিকাল প্রায় ৫টার সময় আসরের চার রাকাত ফরজ নামাজ। এরপর তারা গবাদি পশুদের খাবার পরিবেশন করে এবং গৃহস্থালির অন্যান্য কাজকর্ম সমাধা করে। এরপর সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের সঙ্গে মাগরিবের তিন রাকাত ফরজ নামাজ। এর প্রায় ঘণ্টাখানেক পরই এশার নামাজের আজান শোনা যায়। আবার অজু করে গ্রামবাসী এশার নামাজ পড়ে। ফরজ, ওয়াজিবসহ এ সময় ১৫ রাকাত নামাজ পড়া যায়। যদিও ফরজ ও ওয়াজিব পড়লেই চলে।

এটাই ইসলাম ধর্মাবলম্বী গ্রামবাসীর জীবনযাত্রার পদ্ধতি। ইসলামে ধর্মপালন ও শরীরচর্চা একই সঙ্গে গ্রথিত। প্রতিদিন পাঁচবার নিয়মনীতি মেনে চলে নামাজ আদায় করা ছাড়াও প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার জুমার নামাজ সমাজবদ্ধভাবে পড়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সামাজিক বন্ধন সম্প্রসারণের জন্য জুমার নামাজ ছাড়াও বছরে দুটি ঈদের নামাজ রয়েছে যা সারিবদ্ধ হয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে পড়ার নিয়ম। প্রতি বছর পুরো রমজান মাস রোজা রাখার বাধ্যতামূলক বিধানও স্বাস্থ্যবিধির অঙ্গ। দীর্ঘ সময় অনশন পালনের ফলে দেহ-মনে নতুন ছন্দ সৃষ্টি হয়। এ রমজানের শেষ ১০ দিনে ইতিকাফের নিয়ম রয়েছে। এ সময় ভিন্ন ভিন্ন পরিবারের বয়োবৃদ্ধ সদস্যরা নিজেদের সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন করে মসজিদে নির্জনবাসে যান। সেখানে সাধারণ সংসর্গ পরিত্যাগ করে তারা নিবিষ্টমনে একাগ্রচিত্তে আল্লাহর এবাদতে মনোনিবেশ করেন। এ নির্জনবাস বর্তমানে প্রচলিত ‘আইসোলেশন’-এর মতোই একটি ব্যবস্থা। অতএব ইসলামে নির্জনবাস নতুন কিছুই নয়। করোনাভাইরাসকে মোকাবিলার জন্য এ ধরনের ‘আইসোলেশন’ বা নির্জনবাস ইসলামী বিধানের পরিপন্থী নয়। এ জীবনযাত্রা পদ্ধতি পৃথিবীর সর্বত্র মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত আছে।

একইভাবে ভিন্ন ভিন্ন জীবনযাত্রা পদ্ধতি পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হিন্দুধর্মে গঙ্গাজল দিয়ে ¯œান ও শুদ্ধিকরণ বহুল প্রচলিত। হিন্দুধর্মাবলম্বীরা প্রতিদিনই সকালে ¯œান করে শুদ্ধ মন ও চিত্তে পূজার্চনা করেন। বিভিন্ন পূজা-পার্বণের মাধ্যমে হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদের নিত্যদিনের জীবন নির্বাহ করেন। একইভাবে বৌদ্ধধর্মেও নির্ধারিত স্বাস্থ্যবিধিসম্মত ধর্মীয় বিধান রয়েছে।

এরই মধ্যে ভ্যাকসিন নিয়ে বিশ্বজুড়ে রাজনীতি শুরু হয়েছে। করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেতৃত্বে ১৫০টির বেশি দেশ ভ্যাকসিন গ্লোবাল অ্যাক্সেস ফেসিলিটি বা কোভ্যাকস তৈরি করেছে। আন্তর্জাতিক স্তরে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে ভ্যাকসিন তৈরি ও তা বিতরণ করতেই এ উদ্যোগ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এর সঙ্গে যুক্ত হবে না। অন্যদিকে গ্লোবাল নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকা চীনের উদ্দেশ্যও একই। ওয়াশিংটন বলেছে, ভ্যাকসিনের ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নজরদারি তারা মানবে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তা হ্যান্স ঠিকই বলেছেন, ‘একবার টিকা পাওয়া মানেই মহামারীর সমাপ্তি নয়, মহামারী সেদিনই শেষ হবে, যখন সবাই দায়িত্বপূর্ণ আচরণ করতে শিখবে এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে কীভাবে চলতে হবে তা শিখে যাবে। এটি পুরোপুরি আমাদের ওপর নির্ভর করছে, সেই দিনটি আসলে কালও হতে পারে।’

সেই প্রশ্ন- দিনটি আগামীকাল না হয়ে আজ নয় কেন? আজ আকাশচুম্বী অট্টালিকা মানুষকে প্রকৃতি থেকে অনেক দূরে নিয়ে গেছে। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ প্রকৃতির ওপর নির্ভর করেই বেঁচে আছে। অথচ আজ মানুষের প্রকৃতিনির্ভরতা নেই। অবশ্য তৃতীয় বিশে^ আজও কোটি কোটি মানুষ প্রকৃতির কোলে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।

৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের ৯৬ শতাংশ বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন মাত্র ৪ শতাংশ। উপরোক্ত তথ্যগুলো পর্যালোচনা করলে এটাই প্রতীয়মাণ হয় যে, গুরুতর অবস্থা ছাড়া প্রায় ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের চিকিৎসা এখন হাসপাতালের বাইরে পারিবারিক ও সামাজিক তত্ত্বাবধানে সম্পাদিত হচ্ছে। পারিবারিক পর্যায়ে ‘আইসোলেশন’ নিশ্চিত করতে পারলে এ রোগের চিকিৎসা এখন ঘরে অবস্থান করেই হতে পারে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর