বুধবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

মুক্তির গান-এর তারিক আলী

অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন

মুক্তির গান-এর তারিক আলী

অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন

কভিড-১৯ কেড়ে নিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের নিভৃতচারী কর্মবীর জিয়াউদ্দিন তারিক আলীকে। তিনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সভাপতি, রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ ও ছায়ানটের সদস্য। এ ছাড়া মূলধারার অনেক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সঙ্গে ছিল তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। সবচেয়ে যে পরিচয়টি আজ জীবন্ত হয়ে ধরা দিচ্ছে তা হলো ‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্রে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। চোখে সমস্যার কারণে অস্ত্রহাতে যুদ্ধে যেতে পারেননি। তাই বলে দমে যাননি। বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থার সদস্য হিসেবে কণ্ঠ দিয়ে অংশ নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। গান গেয়ে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। পাখিকে জয় বাংলা শেখানো, শরণার্থী শিবিরে ঘুরে বেড়ানোর সেই দৃশ্যপট বাঙালির হৃদয়ে আজও অমলিন। আশি-নব্বইয়ের দশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সামরিক জান্তা ও তাদের সৃষ্ট এবং উচ্ছিষ্ট ভোগকারী রাজনৈতিক অপশক্তির সুদূরপ্রসারী কর্মকান্ডে বাঙালির শৌর্যবীর্যের ইতিহাস ম্রিয়মাণ হয়। নতুন প্রজন্মের সামনে ঝাপসা হতে থাকে স্বাধীনতার ইতিহাস। ঠিক এ সময় মুক্তির গান চলচ্চিত্রটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা লিয়ার লেভিন ডকুমেন্টারি নির্মাণের উদ্দেশ্যে মুক্তাঞ্চলে ঘুরে ঘুরে কাজ করেছিলেন। লিয়ার লেভিনের কাছ থেকেই ফুটেজগুলো সংগ্রহ করেছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও ক্যাথেরিন মাসুদ। এ বিষয়ে জিয়াউদ্দিন তারিক আলী তারেক মাসুদকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছিলেন। দুঃখের বিষয়, তারেক মাসুদও অকালে প্রয়াত হন। ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় সাংবাদিক মিশুক মুনীরের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করেন। দেশি-বিদেশি অনেক পুরস্কারে ভূষিত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদকে জাতি স্মরণ করবে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। লিয়ার লেভিনের ফুটেজগুলোকে অবলম্বন করে চলচ্চিত্র নির্মাণে তারেক মাসুদ যথেষ্ট মেধা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। সেলুলয়েডের পর্দায় মুক্তির গান দেখে মানুষ যেন ফিরে গেছিল ’৭১-এর রণাঙ্গনে।

এ প্রসঙ্গে মুক্তির গানের একজন বিশিষ্ট দর্শক সম্পর্কে পাঠককে অবগত করছি। তিনি হলেন আমাদের বর্তমান নন্দিত প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা। এ ছবিটি পাবলিক লাইব্রেরিতে টিকিট কেটে দর্শক সারিতে বসে তিনি দেখেছেন। ১৯৯৫-এর ডিসেম্বরের কথা। আমার ব্যক্তিগত সংশ্লিষ্টতার কারণে সবিস্তার ঘটনাটা তুলে ধরছি। সম্ভবত ১৪ ডিসেম্বর। দুপুরের দিকে ৩২ নম্বর হয়ে যাচ্ছিলাম। নেত্রী আছেন জেনে ভিতরে ঢুকলাম। অফিসরুমে নেত্রীকে পেলাম। স্টাফদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথা বলছেন। সালাম দিয়ে বের হয়ে আসব। এ সময় তিনি ডাকলেন। বললেন, ‘তোদের ক্যাম্পাসে নাকি মুক্তির গান চলে। আমার জন্য টিকিট কাট। আমি দেখব।’ আমি না চাইতেই তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে কিছু টাকা দিলেন। সময় দিলেন বিকাল ৫টা। শর্ত জুড়ে দিলেন ক্যাম্পাসে কাউকে বলা যাবে না। বিশেষ করে ছাত্র নেতৃবৃন্দকে। এর অর্থ হলো তিনি নিরিবিলি পরিবেশে ছবিটা দেখতে চান। যাতে বেশি ভিড় না হয়। এ রকম একটি দায়িত্ব পেয়ে যেমন ধন্য হয়েছিলাম, পাশাপাশি শঙ্কাও কাজ করছিল- ঠিকভাবে দায়িত্বটা শেষ করতে পারব তো? ক্যাম্পাসে এলাম। তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র কমান্ড নেতা বর্তমান দেশ টিভির কর্মকর্তা সাদিকুর রহমান চৌধুরী পরাগকে নিয়ে পাবলিক লাইব্রেরিতে টিকিট কাটতে গেলাম। পুরো এক সারির টিকিট নিলাম। টিকিটে কোনো সিট নম্বর নেই। সুতরাং শো ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে একটি সারির দখল বুঝে নিতে হবে। চলাচলের সুবিধার জন্য পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনের দর্শক গ্যালারির মাঝামাঝি একটা ফাঁকা জায়গা আছে। শো ভাঙার পরপরই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে এক সারির দুই মাথায় দুজনকে বসিয়ে দিলাম। কে আসবে তারা জানত না। শুধু বললাম গুরুত্বপূর্ণ কেউ আসবেন। তোমাদের কাজ শুধু পাহারা দেওয়া। যাতে এখানে কেউ বসতে না পারে। দুজনার একজন শাখাওয়াত মুন। যিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপপ্রেস সেক্রেটারি। আর একজন নাদির জুনায়েদ সেনেকা, অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তারা তখন সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। সময়মতো শো শুরু হয়েছে। প্রতি ঘণ্টায় শো হচ্ছে। দর্শকপূর্ণ মিলনায়তন। নেত্রী তখনো আসেননি। মাঝখানে শুধু এক সারি ফাঁকা। প্রয়াত তারেক মাসুদসহ যাঁরা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে তাঁরাও জানতেন না কে আসবেন। বাইরে অনেক দর্শক টিকিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সিট খালি থাকায় টিকিট ছেড়ে দেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। আমি তাদের বলেছি আমার গেস্ট আছে। চলে আসবেন। ছবি শুরুর ১০ মিনিট পর নেত্রী এলেন। অন্ধকার মিলনায়তনে হলে প্রবেশ করলেন। দর্শক সারিতে বসে মুক্তির গান দেখলেন। প্রদর্শন শেষে লাইট জ্বলে উঠল। দর্শকরা দেখলেন তাদের সঙ্গে বসেই মুক্তির গান দেখেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধদিনের দৃশ্যপট দেখে অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি নেত্রী। আয়োজকদের অনুরোধ সত্ত্বেও আবেগাপ্লুত নেত্রী প্রথমে কোনো প্রতিক্রিয়া দিতে চাননি। কিন্তু দর্শকদের অনুরোধে তাঁকে কিছু কথা বলতে হয়েছিল। এ রকম এক ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরে আজও আমি গর্ব অনুভব করি।

জিয়াউদ্দিন তারিক আলীর প্রয়াণে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে এ লেখা শুরু করেছিলাম। সে প্রসঙ্গেই আসি। জিয়াউদ্দিন তারিক আলী দেশকে ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন মানুষকে। ভালোবাসা থেকে উৎসারিত দায়িত্ববোধ থেকেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের কঠিন কাজ হাতে নিয়েছিলেন। নিজেকে প্রচার করে নয় বরং নীরবে নিভৃতে নিজের মতো করে কাজ করে গেছেন।

লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

সর্বশেষ খবর