শুক্রবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

অন্নদাশঙ্কর রায় : প্রসঙ্গ কথা

সৌরেন চক্রবর্ত্তী

অন্নদাশঙ্কর রায় : প্রসঙ্গ কথা

অন্নদাশঙ্কর রায়ের নাম জানেন না এমন সচেতন বাঙালি খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক এবং একজন নামজাদা ব্যুরোক্র্যাট ছিলেন। ১৯০৪ সালে তিনি উড়িষ্যার ঢেঙ্কানলে জন্মগ্রহণ করেন। অসাধারণ মেধাবী অন্নদাশঙ্কর রায় ১৯২৭ সালে আইসিএস পরীক্ষায় ব্রিটিশ ভারতে প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। বিলাতে প্রশিক্ষণ শেষে ১৯২৯ সালে তিনি দেশে ফিরে এসে মুর্শিদাবাদ জেলায় অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ব্রিটিশ আমলে ৯ বছর পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং ৯ বছর পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁর পেশাগত জীবন অতিবাহিত হয়, অর্ধেক সিভিল প্রশাসনে, অর্ধেক জুডিশিয়ারিতে। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মার মুখে শুনতাম অন্নদাশঙ্কর রায় আমাদের নওগাঁ মহকুমার প্রশাসক ছিলেন। তিনি খুবই জনপ্রিয় প্রশাসক ও সাহিত্যানুরাগী ছিলেন। সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর গভীর মমত্ববোধ ছিল। শুধু তাই নয়, তাঁর স্ত্রী লীলা রায়ের পুত্রসন্তানের জন্ম এ নওগাঁতেই।

উল্লেখ্য, তিনি ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন কন্যা অ্যালিস ভার্জিনিয়া অনফোর্ডকে বিয়ে করে তাঁর নাম দেন লীলা রায়। লীলা রায় তাঁর বহু বই বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। এসডিও সাহেবের প্রথম সন্তানের জন্মের সংবাদে নওগাঁবাসী খুব খুশি হয়। বাবার মুখে তা জেনেছি। আমার বাবা তখন নওগাঁ কে ডি স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। নওগাঁ মহকুমায় কর্মকালীন বহু স্মৃতি, অনেক অভিজ্ঞতার কথা তাঁর বিভিন্ন লেখায় স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। নওগাঁর প্রতি বিশেষ টান অনুভব করা যায় তাঁর বিভিন্ন স্মৃতিকথায়। ১৯৮৪ সালে নওগাঁ জেলা সৃষ্টির পর ’৮৫ সালে আমি পরমশ্রদ্ধেয় অন্নদাশঙ্কর রায়কে একটি চিঠি লিখি। ’৮৬ সালে তিনি সে চিঠির উত্তর দেন।

তিনি লিখেন, ‘তোমার চিঠি যথাকালে পেয়েছি। নওগাঁ মহকুমায় আমি ঝউঙ ছিলুম ১৯৩১-৩৩ সালে। নওগাঁ এখন জেলা হয়েছে জেনে আনন্দিত হয়েছি। নওগাঁ থেকে দরকারি কাজে রাজশাহী সদরে যাওয়া কষ্টকর ছিল। বহু সময় নষ্ট হতো। এখন কষ্ট দূর হলো। রাজশাহীতে আমি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলুম ১৯৩৭ সালে।... শুনে খুশি হয়েছি। আমার শুভকামনা যেন। ইতি। শুভাকাক্সক্ষী। অন্নদাশঙ্কর রায়’। এ চিঠি পাওয়ার পর নওগাঁ, রাজশাহী, নাটোর অঞ্চলে তার সাহিত্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় অনেক হাত বদল হয়ে, কপি হয়ে মূল কপি সৌভাগ্যবশত ফিরে পাই এবং সযতেœ সংরক্ষণ করি।

তিনি ১৯৩৭ সালে রাজশাহী জেলার ম্যাজিস্ট্রেটে ছিলেন। এ বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু রাজশাহী জেলা প্রশাসকের দফতরে সংরক্ষিত অনারবোর্ডে অন্নদাশঙ্কর রায়ের নাম নেই! জানি না এর হেতু কী। এ প্রসঙ্গে আমার নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করতে চাই। ২০০৯ সালের মার্চে আমি রাঙামাটি জেলা প্রশাসক পদে যোগদান করি। ইতিহাস-ঐতিহ্য-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে আমার সামান্য ঝোঁক বরাবরই ছিল এবং আছে। স্থানীয় বর্ষীয়ান পাহাড়ি-বাঙালি মানুষের মুখে শুনতাম মিস্টার সুবিমল দত্ত ব্রিটিশ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ছিলেন এবং তিনি চট্টগ্রাম জেলার বাসিন্দা ছিলেন। কিন্তু জেলা প্রশাসকের দফতরে সংরক্ষিত অনারবোর্ডে তাঁর নাম উল্লেখ ছিল না। আমি জেলা গেজেটিয়ার ও অন্যান্য তথ্য-প্রমাণসহ সংশ্লিষ্টদের অবহিত করি যে তিনি ১৯৩৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের (মাদার ডিস্ট্রিক্ট রাঙামাটি) জেলা প্রশাসক ছিলেন। তখনই তাঁর নাম জেলা প্রশাসকের দফতরে অনারবোর্ডে লেখা হয়।

এ বিষয়ে আমি আমার সহকর্মীগণ এবং আমার কনিষ্ঠ পুত্র শৈব চক্রবর্ত্তীর সহায়তা পেয়েছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর মিস্টার সুবিমল দত্ত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের প্রথম হাইকমিশনার। তিনি চট্টগ্রাম জেলার কানুনগোপাড়ার ঐতিহ্যবাহী দত্ত পরিবারে ১৯০৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯২৮ সালে আইসিএসে যোগদান করেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি স্বাধীন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব, কমনওয়েলথ সচিব, রাষ্ট্রদূতসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, অন্নদাশঙ্কর রায় ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় ময়মনসিংহের জেলা ও দায়রা জজ ছিলেন।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্নদাশঙ্কর রায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর কী পরিমাণ শ্রদ্ধা ছিল তা মুক্তিযুদ্ধকালে লিখিত তাঁর কবিতাই প্রমাণ করে-

‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা

গৌরী মেঘনা বহমান,

ততকাল রবে কীর্তি তোমার

শেখ মুজিবুর রহমান।

দিকে দিকে আজ রক্তগঙ্গা

অশ্রু গঙ্গা বহমান,

তবু হবে জয়,

নাহি নাহি ভয়

জয় মুজিবুর রহমান।’

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি তিনবার বাংলাদেশে আসেন ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে, ’৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ও ’৭৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। প্রতিবারই বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর জনসভাসহ বিভিন্ন আলোচনায়ও অংশগ্রহণ করেছিলেন, যা তাঁর বিভিন্ন স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি বাংলাদেশকে ও তাঁর লোকজনকে চিরকাল ভালোবেসে এসেছি, এখনো ভালোবাসি ও চিরকাল ভালোবাসবো।’ কি মমতাবোধ ও ভালোবাসা বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের প্রতি! বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই এই মনীষীকে।

            লেখক : সাবেক সিনিয়র সচিব।

সর্বশেষ খবর