শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

আতাউস সামাদ : মানবিক সাংবাদিকের প্রতিকৃতি

খায়রুল আনোয়ার

আতাউস সামাদ : মানবিক সাংবাদিকের প্রতিকৃতি

আজ সাংবাদিক-কলামিস্ট আতাউস সামাদের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি সাংবাদিকতাকে নিছক চাকরি কিংবা পেশা হিসেবে নয়, একটি মিশন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। পেশার শুরু থেকে আমৃত্যু সে ব্রত পালন করে গেছেন। রিপোর্টার হিসেবে আতাউস সামাদ রাজনীতির মাঠ সরগরম করেছেন। রাজনীতির উত্থান-পতনের নেপথ্যের ঘটনা যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি বাংলাদেশের ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনের তিনি একজন সাক্ষী। শুধু রাজনীতি বা রাজনীতির মানুষ তার খবরের বিষয় ছিল না। অর্থনীতি, সমাজের চালচিত্র, প্রান্তিক মানুষের জীবনের দুঃখ-দুর্দশা, পণ্যের ন্যায্য দাম না পাওয়া কৃষকের হাহাকার- সবই তাঁর প্রতিবেদনে-কলামে স্থান পেয়েছে। এক কথায় বলতে হয়, বর্ণময় ছিল তাঁর সাংবাদিকতা জীবন। তবে আতাউস সামাদের সাংবাদিকতার মূল্যায়ন এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। পেশার পাশাপাশি সহকর্মীদের প্রতি তিনি যে কতটা মানবিক ও সহানুভূতিশীল ছিলেন, তা নিয়ে এ লেখা। তাঁর সঙ্গে আমার সরাসরি কাজ করার সুযোগ হয়েছিল টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভিতে। এক সংকটকালে তিনি এনটিভির হাল ধরেছিলেন। আমি তখন এনটিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক। ব্যক্তিগত স্মৃতি থেকে সেসব ঘটনার কিছু এখানে তুলে ধরার চেষ্টা। ২০০৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল সংস্থা (বিএসইসি) ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটে। আগুনে ভবনে অবস্থিত এনটিভি, আরটিভি ও দৈনিক আমার দেশ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায় দুটি চ্যানেলের। তিনটি মিডিয়ার অসংখ্য সাংবাদিক-কর্মী তাদের পেশা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েন। তবে এনটিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনায়েতুর রহমান কর্মীদের ওই দিনই আশ্বস্ত করেন যে, বেতন নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। বরং বেতন মাস শেষ হওয়ার আগেই ২৮ ফেব্রুয়ারি দেওয়া হবে। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের আশ্বাস অনুযায়ী কর্মীরা বেতন পেয়ে যান।

পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ, কর্মীদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ স্থাপন এবং পুনরায় সম্প্রচার চালু করার লক্ষ্যে সুন্দরবন হোটেলে এনটিভির অস্থায়ী অফিস খোলা হয়। তবে বড় সংকট দেখা দেয় অন্য ঘটনায়। অগ্নিকান্ডের আগেই ১/১১-এর শুরুতে মিথ্যা মামলায় এনটিভির চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক আলী গ্রেফতার হন। এনটিভির অস্থায়ী অফিস চালু হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে ভিন্ন মামলায় গ্রেফতার হন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনায়েতুর রহমান। চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের গ্রেফতারে এনটিভির চার শতাধিক সাংবাদিক-কর্মচারী হতাশ হয়ে পড়েন। কর্মীরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সুন্দরবন হোটেলে ভিড় জমান। তারা সিনিয়রদের কাছে জানতে চান, কে এখন এনটিভির হাল ধরবেন? আদৌ কি এনটিভি আবার সম্প্রচারে যেতে পারবে? সম্প্রচার সম্ভব হলেও তা কবে নাগাদ? সিনিয়রদের কাছে এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব জানা ছিল না। তারা সবাইকে চাঙ্গা রাখার জন্য বিভিন্ন আশার কথা শোনাতেন। তবে একজন পরিচালক এ সময় এগিয়ে এসেছিলেন। তিনি সিনিয়রদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন। কীভাবে পুনরায় এনটিভির সম্প্রচার শুরু করা সম্ভব, কত অর্থের দরকার হবে, তা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বশীলদের কাছে জানতে চান। আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত বিএসইসি ভবন থেকে আদৌ সম্প্রচার হবে কিনা, সে বিষয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেন। তারা নতুন জায়গা দেখার প্রস্তাব করেন। সম্প্রচার শুরু করার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন, তা কীভাবে পাওয়া যাবে, সে প্রশ্নও সামনে চলে আসে। যে কারণেই হোক এক পর্যায়ে উক্ত পরিচালক দৃশ্যপট থেকে সরে যান। কর্মীরা যেটুকু আশার আলো দেখেছিলেন, তা নিভে যায়।

এ রকম এক জটিল পরিস্থিতিতে কারাগার থেকে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে আতাউস সামাদকে এনটিভির দায়িত্ব নেওয়ার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করেন। তিনি চার শতাধিক সাংবাদিক-কর্মচারীর বিষয়টি মানবিকভাবে বিবেচনায় নিয়ে এতে সম্মতি জানান। তিনি ওই বছরের অর্থাৎ ২০০৭ সালের এপ্রিলে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে এনটিভির দায়িত্ব নেন। এনটিভির চার শতাধিক কর্মী আবার আশায় বুক বাঁধেন। তার দক্ষ নেতৃত্বে এবং কর্মীদের আন্তরিকতা ও নিরলস পরিশ্রমের ফলে এনটিভি আবার বিএসইসি ভবন থেকে সম্প্রচারে ফিরে আসে।

কর্মীদের প্রতি আতাউস সামাদের মানবিক যে অনুভূতি সে প্রসঙ্গে এবার বলব। সম্প্রচার শুরু হওয়ার কয়েক মাস পর কর্মীদের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি বা ইনক্রিমেন্টের সময় চলে আসে। নিয়ম অনুযায়ী সেই সঙ্গে পদোন্নতির বিষয়টিও। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক কারাগারে। সম্প্রচার বন্ধ ছিল কয়েক মাস। এ সময় প্রতিষ্ঠানের আয় ছিল না বললেই চলে। বিজ্ঞাপনী সংস্থার কাছে অনেক বকেয়াও পড়ে আছে। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এ রকম পরিস্থিতিতে কীভাবে ইনক্রিমেন্ট দেওয়া সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। আতাউস সামাদ মালিকদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। যত দূর জানি তিনি তখন বলেছিলেন, ‘সাংবাদিক-কর্মচারীরা এক ধরনের শ্রমিক, তবে শিক্ষিত শ্রমিক। বছর শেষে তাদের বাড়ি ভাড়া বাড়ে। সন্তানদের স্কুল-কলেজের বেতনও বাড়ে। এ বিবেচনায় কর্মীদের ইনক্রিমেন্ট হওয়া দরকার।’ শেষ পর্যন্ত তিনি বিষয়টি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে সক্ষম হন। সেই সংকটের সময় তাঁর হাত দিয়ে যথেষ্ট ভালো ইনক্রিমেন্ট হয়েছিল। কর্মীরা বেশ খুশি হয়েছিলেন। পদোন্নতিও হয়েছিল।

ইনক্রিমেন্টের বাড়তি অর্থের ব্যবস্থা করার জন্য তিনি নিজে মার্কেটিং বিভাগকে সঙ্গে নিয়ে বকেয়া আদায় করতে বড় বড় বিজ্ঞাপনী সংস্থার কাছে ছুটে যান। তাঁর সম্মানে অনেক সংস্থা বকেয়া পরিশোধ করে দেয়।

আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। ঈদের বোনাসের আগে একজন পরিচালক যে ব্যাংকটিতে এনটিভির বেতন ও অন্যান্য লেনদেন হয়, সেই ব্যাংকে চিঠি দিয়ে লেনদেন স্থগিত করে দেন। এ খবর জানাজানি হলে কর্মীরা বোনাস পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েন। সামাদ ভাই আমিসহ কয়েকজন সিনিয়রকে জানালেন যে, তিনি তাঁর ভাগ্নের সঙ্গে দেখা করবেন। ভাগ্নে অ্যাডভোকেট আনিসুল হকের (বর্তমান আইনমন্ত্রী) কাছে তিনি এ সংকটের আশু সমাধান চান। আনিসুল হক তাঁকে আশ্বস্ত করে জানান যে, নিজে সমস্যার আইনগত সমাধান করে দেবেন। তবে এ প্রক্রিয়ায় কিছু সময়ের দরকার হবে বলে জানান। এদিকে ঈদের ছুটি ঘনিয়ে আসছে। কর্মীদের মধ্যে বোনাস নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ। আতাউস সামাদ বিজ্ঞাপনী সংস্থার কাছ থেকে চেক না নিয়ে নগদ অর্থ জোগাড় করে সিনিয়র ছাড়া বাকি কর্মীদের বোনাস দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি জানাই শ্রদ্ধা।

লেখক : সাবেক বার্তাপ্রধান এনটিভি।

সর্বশেষ খবর