মঙ্গলবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

হৃদরোগ প্রতিরোধই সর্বোত্তম উপায়

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

হৃদরোগ প্রতিরোধই সর্বোত্তম উপায়

আজ বিশ্ব হার্ট দিবস। ‘হৃদয় দিয়ে হৃদরোগ প্রতিরোধ’- বিশ্ব হার্ট দিবসের এ বছরের প্রতিপাদ্য। করোনাকালে এ স্লোগানের তাৎপর্যও অনেক। করোনা হলে রক্তনালিতে রক্ত জমাট বেঁধে মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। কভিড-১৯ সংক্রামক রোগটি আবির্ভাবের পর থেকেই আমরা এর ঝুঁকি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারছি। বিশেষ করে যাদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্থূলতা আর হৃদরোগের জটিলতা আছে, তাদের ক্ষেত্রে। হৃদরোগে আক্রান্তরাই যে শুধু এ ভাইরাসের ঝুঁকিতে পড়তে পারেন, ঠিক তা নয়। তবে একজন হৃদরোগী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার পরিণতি মারাত্মক হতে পারে। সুতরাং যারা হৃদরোগে আক্রান্ত বা এ রোগের উচ্চঝুঁকিতে আছেন তাদের করোনাভাইরাসের সময় অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। সবাই হৃদরোগের ঝুঁকিসমূহ জানুন, হার্টকে ভালোবাসুন এবং আপনার স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হোন।

বিজ্ঞানের অবিস্মরণীয় উন্নতির ফলে চিকিৎসা-বিজ্ঞানেরও অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। কলেরা, ডায়রিয়া, বসন্ত, যক্ষ্মা, হাম এবং বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি সহজেই চিকিৎসায় নিরাময় ও প্রতিরোধযোগ্য। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে নিরাপদ পানি, খাদ্য সরবরাহ, চিকিৎসা পদ্ধতি, কার্যকর টিকা কর্মসূচি, সর্বোপরি মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে সংক্রামক ব্যাধি কমে যাচ্ছে, মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। ফলে বার্ধক্যজনিত রোগ যেমন অস্টিওপরোসিস, অস্টিওআর্থ্রোসিস, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সার ইত্যাদি বাড়ছে। বর্তমান বিশ্বে হৃদরোগ ও স্ট্রোক সবচেয়ে বড় ঘাতক ব্যাধি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কারণ এর চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল। সাধারণ কিংবা মধ্যবিত্ত রোগীর পক্ষে এ ব্যয় বহন করা অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। মানবদেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হার্ট বা হৃৎপিন্ড। হৃদরোগের ঝুঁকির ব্যাপারটি নির্ভর করে আপনি কীভাবে জীবন-যাপন করছেন তার ওপর। অতিরিক্ত ধূমপান, শুয়ে বসে সময় কাটানো, শরীরচর্চাহীন জীবন ও চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণের কারণে চর্বি জমা হয়ে ধমনিগুলো সরু হতে থাকে। হৃৎপিন্ডের রক্তনালিতে রক্ত চলাচলের পথ বা ধমনির ভিতর রক্ত প্রবেশের পথ আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে হৃৎপিন্ডকে অক্সিজেন দিতে ব্যর্থ হলেই ঘটতে পারে হার্ট অ্যাটাকের মতো জটিল রোগ। হৃৎপিন্ড ও রক্তনালির রোগসমূহের মধ্যে এনজাইনা পেকটোরিস, অ্যাকিউট করোনারি সিনড্রোম, মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন, পেরিকারডাইটিস বা হৃৎপিন্ডের আবরণে প্রদাহ, এওরটিক ডিসেকশন বা ছিঁড়ে যাওয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

বিভিন্ন কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, যাকে বলা হয় রিস্ক ফ্যাক্টর। কিছু কিছু সহজেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য, আর কিছু অনিয়ন্ত্রণযোগ্য। অনিয়ন্ত্রণযোগ্য রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো হলো বয়স, লিঙ্গ ও বংশগত। নিয়ন্ত্রণযোগ্য রিস্ক ফ্যাক্টরের মধ্যে রয়েছে ধূমপান, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে কলেস্টেরলের আধিক্য, ডায়াবেটিস, মুটিয়ে যাওয়া, কায়িক পরিশ্রমের অভাব, চর্বিজাতীয় খাদ্য বেশি ও আঁশ জাতীয় খাদ্য কম খাওয়া, মানসিক চাপ, মদ্যপান, জন্মনিয়ন্ত্রক পিল খাওয়া ইত্যাদি।

কোনো ব্যক্তি হৃদরোগে আক্রান্ত হলো কিনা তা নানা উপায়ে জানা যেতে পারে। যেমন- ক. মাঝেমধ্যে বুকে সামান্য ব্যথা বা চাপ চাপ ভাব অনুভব করা। বিশেষ করে পরিশ্রম বা হাঁটাচলা, সিঁড়িতে ওঠানামা করলে এমনকি খাওয়ার সময়ও বুকের ব্যথা বা চাপ অনুভূত হয়, আবার বিশ্রাম নিলে কমে যায়। খ. বুকের মাঝে হঠাৎ খুব বেশি ব্যথা অনুভূত হওয়া, যা বাঁ হাতের দিকে এমনকি গলা বা চোয়ালেও ছড়িয়ে যায়। হঠাৎ কাশি বা তীব্রতর শ্বাসকষ্ট, অস্বস্তিবোধ, দুর্বলতা বা ক্লান্তিবোধ। গ. বুকের ব্যথার সঙ্গে বমি বমি ভাব এমনকি বমি হওয়া, শরীরে অতিরিক্ত ঘাম, হঠাৎ মাথা ঘোরা এমনকি অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, বুক ধড়ফড় করা এবং হৃদক্রিয়ার ছন্দ বেড়ে যাওয়া। ঘ. কোনোরকম ব্যথা ছাড়াও হঠাৎ শ্বাসকষ্ট অনুভূত হওয়া এবং বিছানায় চিত হয়ে শুতে গেলে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়া। ঙ. ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে বুকে তীব্র ব্যথা অনুভূত নাও হতে পারে। তবে শরীর থেকে প্রচুর ঘাম ঝরা, মাথা ঘোরা ও ক্ষণিকের জন্য চেতনাহীন হয়ে পড়াটাই এই রোগীদের হার্ট অ্যাটাকের পূর্বলক্ষণ। চ. হঠাৎ পেটে ব্যথা বা গ্যাস হওয়া, বমি, বদহজম জাতীয় লক্ষণ দেখা দেওয়া, যাকে অনেকেই সাধারণ গ্যাস্ট্রিক মনে করে অবহেলা করেন।

হার্ট অ্যাটাক হলে কী করবেন? ক. ওপরের যে কোনো লক্ষণ অনুভূত হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। বিশেষ করে যারা আগে থেকেই কোনো না কোনো হৃদরোগে ভুগছেন। এমনকি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে অতিমাত্রায় কলেস্টেরল রোগীদের বেলায়ও এসব লক্ষণ অনুভূত হলে অবহেলা করা উচিত নয়। খ. বুকে মারাত্মক ব্যথা হলে যদি কোনো নিকটস্থ হাসপাতাল বা ক্লিনিক থাকে, তবে সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুুলেন্স পাঠানোর অনুরোধ করুন। গ. আপনি একা থাকলে সাহায্যের জন্য প্রতিবেশীকে ডাকুন এবং পাশের হাসপাতালে নিয়ে যেতে অনুরোধ করুন। নিজে গাড়ি চালিয়ে না যাওয়াই ভালো। তবে নিছক প্রয়োজন হলে শেষ আশ্রয় হিসেবে গাড়ি চালিয়ে চলে যাবেন। ঘ. যদি আগেই আপনার হৃদরোগ সম্পর্কে জানা থাকে, তবে বুকে ব্যথা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাইট্রোগ্লিসারিন স্প্রে অথবা ট্যাবলেট জিবের নিচে নিতে পারেন। ৩০০ মিগ্রার একটি অ্যাসপিরিন বড়ি কিছু খাওয়ার পর খেয়ে নিতে পারেন। হৃদরোগের চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল। একবার আক্রান্ত হলে সারা জীবন এই মারাত্মক ব্যাধি পুষতে হয় এবং অনেক ওষুধ খেতে হয়। তাই এ রোগ প্রতিরোধ করাই উত্তম। নিরাময়যোগ্য রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা নিলেই অনেক ক্ষেত্রে হৃদরোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। ক. ধূমপান অবশ্যই বর্জনীয়। এমনকি ধূমপায়ীর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকুন। তামাকপাতা, জর্দা, গুল ইত্যাদি পরিহার করতে হবে। খ. খাওয়া-দাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ও নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। একবার লক্ষ্য অনুযায়ী ওজনে পৌঁছালে সীমিত আহার করা উচিত এবং ব্যায়াম অব্যাহত রাখতে হবে। ওষুধ খেয়ে ওজন কমানো বিপজ্জনক। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওজন কমানোর ওষুধ না খাওয়াই ভালো। গ. কম চর্বি ও কলেস্টেরল যুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। যেমন খাসি বা গরুর মাংস, কলিজা, মগজ, গিলা, গুর্দা, ডিম কম খেতে হবে। কম তেলে রান্না করা খাবার এবং ননি তোলা দুধ, অসম্পৃক্ত চর্বি যেমন সয়াবিন, ক্যানোলা, ভুট্টার তেল অথবা সূর্যমুখীর তেল খাওয়া যাবে। বেশি আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ করা ভালো। আটার রুটি ও সুজি জাতীয় খাবার পরিমাণমতো খাওয়া ভালো। ঘ. তরকারিতে প্রয়োজনীয় লবণের বাইরে অতিরিক্ত লবণ পরিহার করতে হবে। ঙ. অতিরিক্ত মদ্যপান পরিহার করতে হবে। চ. যাদের ডায়াবেটিস আছে, তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ছ. নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে গিয়ে রক্তচাপ পরীক্ষা করানো উচিত। যত আগে উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে, তত আগে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং জটিল রোগ বা প্রতিক্রিয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। জ. সকাল-সন্ধ্যা হাঁটাচলা, সম্ভব হলে দৌড়ানো, হালকা ব্যায়াম, লিফটে না চড়ে সিঁড়ি ব্যবহার ইত্যাদি। কায়িক শ্রম ও নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। সম্ভব হলে অল্প দূরত্বে গাড়ি বা রিকশা ব্যবহার না করে হেঁটে গেলে ভালো। ঝ. সামাজিক জীবনযাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রায়ই চর্বি জাতীয় যেমন পোলাও, বিরিয়ানি, মিষ্টি ইত্যাদি খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। ঞ. মানসিক ও শারীরিক চাপ পরিহার করতে হবে : নিয়মিত বিশ্রাম, সময়মতো ঘুমানো, শরীরকে অতিরিক্ত ক্লান্তি থেকে বিশ্রাম দিতে হবে। নিজের শখের কাজ করা, নিজধর্মের চর্চা ইত্যাদির মাধ্যমে মানসিক শান্তি পাওয়া যায় এবং মন প্রফুল্ল থাকে। ট. শিক্ষা ও সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। এসব রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সংবাদপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

আগে ধারণা করা হতো করোনাভাইরাস মূলত ফুসফুসের ক্ষতি করে বেশি। এ কারণে কভিড-১৯ রোগীদের শ্বাসকষ্ট হয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জানা গেছে, ফুসফুস শুধু নয়, দেহের প্রতিটি অঙ্গে এ ভাইরাস ধ্বংসলীলা চালাতে পারে। বিশেষ করে হৃদযন্ত্র ও ধমনিতন্ত্রেও ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব কভিড-১৯ রোগী ভেনটিলেটর সাপোর্টে থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের প্রতি পাঁচজনের একজনের মৃত্যুর কারণ ছিল হৃদযন্ত্র-সংক্রান্ত জটিলতা। সুতরাং হৃদরোগের প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের ব্যাপারে বেশি যত্নবান হতে হবে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। তবে সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে যদি হৃদরোগের ঝুঁকিগুলো জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তাহলেই হৃদরোগ এবং এর ঝুঁকিপূর্ণ অকালমৃত্যু এড়ানো সম্ভব। মনে রাখতে হবে, শুধু নিজে নয়, পরিবারের অন্য সদস্যদেরও এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

লেখক : প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক

ও ইউজিসি অধ্যাপক।

সর্বশেষ খবর