শনিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

মাল্টায় ভাগ্য পাল্টায়, এক চাষেই কোটি টাকা

শাইখ সিরাজ

মাল্টায় ভাগ্য পাল্টায়, এক চাষেই কোটি টাকা

আমাদের দেশে করোনার সংক্রমণ যখন শীর্ষে, অর্থাৎ মে-জুনে বেশ কয়েকটি পত্রিকায় মাল্টা নিয়ে খবর চোখে পড়ল। মাল্টা, কমলা, লেবু ইত্যাদি সাইট্রাস জাতীয় ফল। মাল্টায় যেহেতু ভিটামিন-সির প্রাচুর্য আছে, এর চাহিদাও ছিল বেশি। অন্যদিকে সারা পৃথিবীই তখন লকডাউনে। আমদানি-রপ্তানিতেও কিছুটা শ্লথভাব চলে এসেছিল। এ সুযোগে সিন্ডিকেটকারীরা মাল্টার দাম অস্বাভাবিক রকম বাড়িয়ে দেয়। গত রোজার শুরুতে পাইকারি বাজারে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে মাল্টা। রোজার মধ্যেই করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় মাল্টার চাহিদা তখন কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। সে সুযোগে অসাধু সিন্ডিকেট কারসাজি করে মাল্টার দাম বাড়িয়েছে। খুচরা বাজারে মাল্টা ১৮০ টাকা কেজিতেও বিক্রি হয়েছে। গত কয়েক বছরে সারা দেশেই মাল্টার ব্যাপক চাষ বেড়েছে। আমাদের দেশে চাষকৃত মাল্টার স্বাদ কোনো অংশেই আমদানিকৃত মাল্টার চেয়ে কম নয়। বরং মিষ্টতা ১০-১৫ শতাংশ বেশি। করোনার অভিঘাত পৃথিবীর মানুষকে শিখিয়েছে খাদ্য কেবল জিবের আস্বাদন নয়, নয় মন ভরানো। খাদ্য পুষ্টির আধার। সুষম পুষ্টি খাদ্য থেকে শরীরে না গেলে যে কোনো রোগেই ভেঙে পড়তে পারে শরীর। সামান্য ভাইরাসকে পরাহত করতেও বাড়াতে হয় শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, যা আসে খাবারের পুষ্টি থেকেই। তাই সব ধরনের পুষ্টিই খাদ্য থেকে নিতে হবে। অন্যান্য খাদ্যের পাশাপাশি প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে ফলমূল। আমাদের দেশের মানুষও ব্যতিক্রম নয়। বেশ কয়েকজন ফল বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, গত কয়েক বছরের তুলনায় এই সময়ে বাজারে ফলের চাহিদা ছিল অনেক গুণ বেশি। যেখানে একটা বড় অংশ দখল করেছে আমাদের কৃষকের উৎপাদিত দেশি মাল্টাসহ অন্যান্য ফল। দেশি মাল্টা খুচরা বাজারে ১২০ থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। সারা দেশে মাল্টা চাষ ছড়িয়ে পড়ার নেপথ্য ভূমিকায় ছিল পিরোজপুরের রেবতি সিকদারের ছোট্ট মাল্টাবাগানটি। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, পিরোজপুরের ডাকাতিয়া গ্রামে রেবতি সিকদারের ছোট্ট মাল্টাবাগানটির কথা! আমি কখনো সে দৃশ্য ভুলব না। বাংলাদেশের মাটিতে গাছভর্তি মাল্টা। শুধু রূপে নয়, বারি-১ মাল্টা গুণেও বিস্ময়কর। মনে পড়ে এক পড়ন্ত বিকালে হাজির হই রেবতি সিকদারের বাড়ি। ঢুকতেই দেখি তিনি উঠোনে চেয়ার-টেবিল পেতে এক প্লেটে হলুদ মাল্টা কেটে সাজিয়ে রেখেছেন। আরেক প্লেটে চানাচুর, সঙ্গে অন্যান্য স্ন্যাকস জাতীয় খাবার। রেবতি সিকদার বললেন, ‘আগে মাল্টা খান, পরে বাগান দেখবেন।’ তখন সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে আর কিছুক্ষণ পরই ডুবে যাবে। ভিডিও ধারণের কাজ আলো থাকতে থাকতে করতে হবে। আবার প্লেটে রাখা কমলা রঙের মাল্টা দেখে আমার মনে হয়েছিল হয়তো আমাকে বিস্মিত করার জন্য বাজার থেকে মাল্টা কিনে এনে রেখেছেন। পিরোজপুরের মাটিতে এমন মাল্টার চাষ সম্ভব তখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না। কমলা, মাল্টা ইত্যাদির চাষ হয় সিলেটে বা পাহাড়ি অঞ্চলে। তাই অবিশ্বাসের চোখ নিয়ে বললাম, আগে বাগান দেখব, পরে মাল্টা খাব। বাগান দেখে চোখ জুড়াল। গাছভর্তি কমলা রঙের মাল্টা ঝুলে আছে। কোনো কোনো গাছে সবুজ। কাজ শেষে রেবতি সিকদারের কাছে জানতে চাইলাম, আমি কি একটা মাল্টা গাছ থেকে ছিঁড়তে পারি? রেবতি বললেন, ‘একটা না, এক শটা ছিঁড়েন।’ আমি একটা বাগানের গাছ থেকে একটা মাল্টা নিয়ে এসে উঠোনে বসলাম। মাল্টাটা নিজ হাতে কেটে মুখে দিলাম। এমন মিষ্টি মাল্টা! মুখে দিয়ে এর স্বাদ আর গন্ধে মুগ্ধ। এরপর বললাম, আপনার আগের মাল্টাটা আনেন তো দেখি। নাঃ বাজার থেকে আনা নয়। দুটির স্বাদ একই। রেবতি সিকদারের মাল্টার স্বাদ মিষ্টতায় হারিয়ে দিল বাইরে থেকে আমদানি হয়ে আসা মাল্টাকে। টেলিভিশনে এই পর্ব প্রচারের পর ফোন, এসএমএস, ইমেইলের পর ইমেইল- মাল্টা চাষ করতে আগ্রহী তরুণের ভিড়। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল মাল্টা। শুধু যে দেশের তরুণরাই মাল্টা চাষ নিয়ে স্বপ্ন বুনতে শুরু করল তা নয়। প্রবাসীরাও ফোন করে, ইমেইলে মাল্টা চাষে আগ্রহ প্রকাশ করতে থাকলেন। তাদেরই একজন দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার ইসমাইল। ২০১৬ সালের কথা। কোরিয়া থেকে কৃষির স্বপ্ন নিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। ১২ কাঠা জমিতে মাল্টাবাগান করে দেখছেন অনেক বড় স্বপ্ন। মুজিবনগরের মাটিতে ফলানো তার বাগানের মাল্টাও মিষ্টি। ইসমাইলের উদ্যম আগ্রহ আর স্বপ্ন দেখেই বুঝেছিলাম কৃষির প্রতি তার অন্যরকমের ভালোবাসা। আজ আপনাদের ইসমাইলের গল্পই শোনাব। তার আগে আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই মাল্টা চাষ করে সফল আর এক কীর্তিমান চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার সাখাওয়াৎ হোসেনের কথা। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, সাখাওয়াৎ নতুন বিস্ময় জাগিয়েছিল মাথাভাঙা নদীর তীর ঘেঁষে ৪০ বিঘার বিরাট মাল্টাবাগান করে। বছর তিনেক আগে সাখাওয়াতের মাল্টাবাগান দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তখন পর্যন্ত সেটিই ছিল দেশের সবচেয়ে বড় মাল্টাবাগান। এরপর মাল্টা চাষ নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে দেশের তরুণ কৃষকের মধ্যে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে দেখেছি আর সব কৃষি ফসলের পাশে টুকরো টুকরো মাল্টাবাগান।

বলছিলাম মুজিবনগরের ইসমাইলের কথা। মেহেরপুর জেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে মোনাখালী গ্রাম। এ গ্রাম পার হয়ে রসিকপুর সড়কের দিকে এগোলেই চোখে পড়ে ইসমাইলের মাল্টাবাগান। গাছভর্তি মাল্টা। ২০১৬ সালের অক্টোবরে ইসমাইলের চিঠি পেয়ে হাাজির হই তার বাগানে। ১২ কাঠা জমিতে ৪৮টি মাল্টা গাছের প্রতিটিতে ঝুঁকে ছিল মাল্টা। ব্যাগিং করায় কোনো কোনোটির রং কমলা হয়ে উঠেছিল। মাল্টার ভারে গাছগুলো সব নুয়ে পড়েছিল। ইসমাইল বলেছিলেন তার গল্প- ভালো থাকার স্বপ্ন নিয়ে গিয়েছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ায়। সেখানে সাড়ে পাঁচ বছরের প্রবাসজীবন তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। সব সময় টেনেছে দেশের মাটি। দক্ষিণ কোরিয়ায় থাকার সময় ইউটিউবে দেখতেন ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এর পর্বগুলো। রেবতি সিকদার হয়ে উঠলেন তার অনুপ্রেরণা। দেশে ফিরে মাল্টা চাষ শুরু করেন। মাল্টা চাষ তুলনামূলক সহজ ও লাভজনক। চাষের প্রথম বছরেই মূল বিনিয়োগ, সব মিলে ২০ হাজার টাকা। এর পর থেকে মাঝেমধ্যে সার প্রয়োগ ও পরিচর্যা করলেই হয়। দ্বিতীয় বছরেই গাছে গাছে ফল এলো। ১২ কাঠার বাগান থেকে যে পরিমাণ ফল এসেছিল তা বিক্রি করে পেলেন প্রায় ২০ হাজার টাকা। পরের বছর ৭০ হাজার। তার পরের বছর লাখ ছাড়াল। সেবার ইসমাইলের প্রতিবেদনটি টেলিভিশনে প্রচারের পর মাল্টা ঘিরে নতুন বাণিজ্যের সন্ধান পেলেন তিনি। মাল্টার চেয়ে মাল্টার চারা বিক্রি করে লাভ করেছেন ঢের। মাল্টা পাল্টে দিয়েছে তার সব হিসাব-নিকাশ। ২০২০ সালে এসে সেই ১২ কাঠার বাগান এখন পৌঁছেছে ১৯ বিঘায়। ফলে ফলে সাজানো একেকটি গাছ। মন জুড়ানো দৃশ্য। কয়েকটি মাল্টাতেই ১ কেজি; যার বাজারমূল্য ৮০ থেকে ১২০ টাকা প্রতি কেজি। ইসমাইল বলছেন, এই বারি-১ বা পয়সা জাতের মাল্টা গাছ রোপণের তিন থেকে চার বছরের মাথায় কমপক্ষে ১ মণ ফল দেয়। পাঠক! হিসাবটি আপনারাও করতে পারেন। ৪ হাজার গাছে গড়ে ১ মণ করে মাল্টা। তার মানে ৪ হাজার মণ। ১০০ টাকা কেজি ধরলেও কত আসে? হ্যাঁ, দেড় কোটি টাকার বাণিজ্য!

শুধু মাল্টা নয়, মাল্টার মতো অন্যান্য উচ্চ ফলনশীল ফলের বাণিজ্যিক হিসাবও ধরা দিয়েছে ইসমাইলের কাছে। রোপণ করেছেন ভিয়েতনামি খাটো জাতের নারকেল গাছ। আছে কমলার চাষ। ইসমাইল এখন গোটা এলাকার কাছে কৃষি সাফল্যের এক নায়কে পরিণত হয়েছেন। তিনি এখন নতুন উদ্যোক্তাদের এক অনুপ্রেরণা।

তবে এ কথা সত্য, অর্থকরি ও উচ্চমূল্যের ফল-ফসলের উৎপাদনের ক্ষেত্রে কৃষকের স্বপ্ন যত দ্রুত এগোচ্ছে, তত দ্রুত তারা সহায়তা ও সহযোগিতা পাচ্ছেন না। অনেকেই অনেক ফসলের অনেক রকমের সমস্যা ও জিজ্ঞাসা নিয়ে ঘুরছেন, কিন্তু সমাধান পান না। কৃষকের তথ্য পাওয়ার বিষয়টি আরও সহজ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন কৃষকের সে বিষয়ে জ্ঞান সমৃদ্ধ করা। নতুন কৃষি উদ্যোক্তারা যে গতিতে নতুন নতুন কৃষিচর্চার দিকে ধাবিত হচ্ছেন, তাদের সমস্যা নিরূপণ ও নিরসনে সে গতি নেই। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ উচ্চমূল্যের ফল-ফসল চাষে উদ্যোগী তরুণদের সহজ যুগোপযোগী তথ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারলে তরুণরা আরও বেশি কৃষিতে যুক্ত হবে।

যা হোক, ২০১৬ সালে যখন ইসমাইলের বাগানে গিয়েছিলাম তখন সারা জেলায় মাল্টাবাগান ছিল সব মিলে মাত্র ৫-৬ বিঘার মতো। আর ২০২০ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৫০ বিঘায়। একেই বলে সম্প্রসারণ। একেই বলে সফলতা। এর পেছনে ইসমাইলের মতো উদ্যোক্তার অনেক বড় অনুপ্রেরণা রয়ে গেছে। তার সে সময়ের উদ্যমেরই ফল এটি।

কৃষি বদলে গেছে। আমি সব সময় বলেছি, এই বদলে যাওয়া কৃষির হাল ধরছে একশ্রেণির উদ্যমী ও আত্মবিশ্বাসী তরুণ। যারা শুধু ভাগ্য পরিবর্তনের গল্প শোনাচ্ছে না, কৃষি অর্থনীতির নতুন সম্ভাবনার আলো দেখাচ্ছে। মুজিবনগরের ইসমাইল তাদেরই একজন। আমি বিশ্বাস করি, তার এবারের সাফল্যও চোখ খুলে দেবে দেশের অসংখ্য নতুন উদ্যোক্তার। এ করোনা পরিস্থিতি আমাদের নতুন করে জানিয়েছে, এ মুহূর্তে কৃষি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য একটি খাত; যার ওপর ভরসা করেই স্বপ্ন দেখা যায়। পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাসী থাকা যায়। ইসমাইলের উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি। সারা দেশে সৃষ্টি হোক এমন সাফল্যের অসংখ্য গল্প।

মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

 

সর্বশেষ খবর