রবিবার, ৪ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

শিক্ষা বনাম জীবনের নিরাপত্তা

জহিরুল হক শামীম

শিক্ষা বনাম জীবনের নিরাপত্তা

কভিড-১৯ বিশ্ববাসীর সামনে নানা বাস্তবতা হাজির করেছে। এর অন্যতম ‘জীবন আগে না শিক্ষা আগে?’ এ প্রশ্নের উত্তর আপাতদৃষ্টিতে বিশ্বের কোনো দেশের হাতেই নেই। আর এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী তর্ক-বিতর্ক, গবেষণা-পর্যালোচনা চলাকালে গেল ২ সেপ্টেম্ব থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ। তবে শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়িয়েছে।

যদিও অনেকেই বলছেন, জীবনযাত্রায় প্রায় সবকিছুই যখন স্বাভাবিক। ১ সেপ্টেম্বর থেকে গণপরিবহনও চলছে আগের নিয়মে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও চলছে পুরোদমে। থেমে নেই শিল্পকারখানায় উৎপাদনও। তাহলে স্কুল-কলেজ কেন বন্ধ থাকবে? এমনিতেই সাড়ে পাঁচ মাসের বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রথম শ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কয়েক কোটি ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রথমেই হোঁচট খেয়েছে এসএসসি ও সমমানের ফলপ্রার্থীরা। করোনার কারণে নির্ধারিত সময়ের প্রায় এক মাস পর তাদের ফল প্রকাশ করা হয়। এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল ১ এপ্রিল থেকে। করোনার প্রভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পরীক্ষা ইতোমধ্যে পাঁচ মাস পিছিয়ে গেছে। কবে, কীভাবে পরীক্ষা হবে সে সিদ্ধান্ত এখনো জানা যায়নি। এইচএসসি পরীক্ষার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন করোনাকালে পরীক্ষা নেওয়া হবে না। সামগ্রিক বিষয় বিবেচনা করে এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়, করোনায় শিক্ষাসহ সব খাতই বিপর্যস্ত। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরিস্থিতি বিবেচনায় বিশ্বের সব দেশেই ক্রমান্বয়ে স্কুল-কলেজ খোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু বয়স্কদের ক্ষেত্রে যেসব বিবেচনা কার্যকর সেসব কি একইভাবে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? বয়স্করাই যেখানে নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে ১০ টাকার একটি মাস্ক পরেন না, সাবানে হাত ধোন না, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখেন না; সে ক্ষেত্রে শিশুদের কাছ থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রত্যাশা করা কি বাস্তবসম্মত? শিশুরা তো প্রথম দিন স্কুলে এসেই তার বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলবে, বাঃ তোর মাস্কটা তো খুব সুন্দর। আমি একটু পরে দেখি?

আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব সেখানে স্কুল খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ১ লাখ শিক্ষার্থী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্স এ উদ্বেগজনক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সরকারি হিসাবেও তাই বলা হয়েছে। রিপোর্টে আরও বলা হয়, জুলাইয়ের ওই দুই সপ্তাহে করোনায় আক্রান্ত হয়ে কমপক্ষে ২৫ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। শিশুদের মধ্যে করোনাভাইরাস প্রকোপ কম বলে যে দাবি এত দিন করা হচ্ছিল, আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিক্সের এ সমীক্ষা রিপোর্ট তা নস্যাৎ করে দিয়েছে। তার পরও ২১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক সিটির পাবলিক স্কুলগুলো খুলে দেওয়া হচ্ছে বলে রিপোর্ট বেরিয়েছে। আর ক্লাস নেওয়া হবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল ভবনের পরিবর্তে খেলার মাঠে, পাশের রাস্তায় বা পার্কে। ব্রিটেনে এরই মধ্যে ৪০ শতাংশ স্কুল খুলে গেলেও আশানুরূপ ছাত্রছাত্রী উপস্থিত হচ্ছে না। সরকারি সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছেন অভিভাবকরা। করোনাভাইরাসের প্রথম ঢেউই এখনো সামলে উঠতে পারেনি ইউএসএ, ব্রাজিল, ভারত। এরই মধ্যে দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানতে চলেছে ইউরোপে। প্রথম ধাক্কার পর এ অঞ্চলের দেশগুলো যখন লকডাউনসহ বহু বিধিনিষেধ তুলে নিতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই আবার তাদের লকডাউনে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। ২১ সেপ্টেম্বর পুনরায় লকডাউনে যাচ্ছে মাদ্রিদ। জার্মানিতেও আবার বাড়ছে সংক্রমণ। এদিকে করোনা নিয়ন্ত্রণে আসার আগে সবকিছু সচল করলে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে বলে সতর্ক করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রিয়েসুস। সংস্থাটির মতে, করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না এনেই পুনরায় সবকিছু সচল করা হলে তা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ ১ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘ভ্যাকসিন পেলে আমরা করোনা প্রতিরোধ করতে পারব। কিন্তু যত দিন ভ্যাকসিন না মিলছে তত দিন স্বাস্থ্যবিধি মানার বিকল্প নেই। ভ্যাকসিনের আশায় স্বাস্থ্যবিধি থেকে সরে আসা যাবে না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সংক্রমণ রুখতে হবে। নয় তো করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকবে।’

স্বাস্থ্য বিশেজ্ঞদের মতে, স্কুল-কলেজ খোলার ক্ষেত্রে সরকারের ধীরে চলা নীতিই অনুসরণ করা শ্রেয়। কেননা, প্রাপ্তবয়স্করাই যেখানে স্বাস্থ্যবিধি মানছে না, সে ক্ষেত্রে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে- এ প্রত্যাশা বাস্তবসম্মত নয়। তা ছাড়া মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর এ সাত মাস যদি আমরা অপেক্ষা করতে পারি তাহলে বাকি তিন মাসও অপেক্ষা করা শ্রেয়। স্কুল খোলার কারণে একজন শিক্ষার্থী যদি আক্রান্ত হয় এর দায়ভার কে নেবে? তখন কিন্তু সবাই সরকারের পিন্ডি চটকাবে। ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে আমাদের সবকিছুই যখন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, বিপর্যস্ত হয়েছিল শিক্ষা খাতও; জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার তখন অটোপ্রমোশন দিয়েছিল। তাতে শিক্ষাব্যবস্থা যেমন ধ্বংস হয়ে যায়নি, তেমনি মূর্খ হয়ে যায়নি বাঙালি জাতি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ২৭ আগস্ট গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের ৩১ উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়নের লক্ষ্যে পাওয়ার প্লান্ট উদ্বোধনের সময় নোয়াখালীর এক শিক্ষার্থীর প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে প্রমোশনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। বর্তমানে করোনাযুদ্ধে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বই লন্ডভন্ড। এ অবস্থায় অটোপ্রমোশনের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে বইকি। ’৭১-এর পর যদি বাংলাদেশ উঠে দাঁড়াতে পারে তাহলে ২০২০-এর করোনা বিপর্যয়ের পরও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উঠে দাঁড়াতে পারবে।

                লেখক : সাংবাদিক।

ইমেইল :[email protected]

সর্বশেষ খবর