সোমবার, ৫ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

বাংলাদেশের জন্য বম্বশেল

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

বাংলাদেশের জন্য বম্বশেল

এই সময়ে এরকম একটি খবর বাংলাদেশের মানুষের কাছে ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত, ভাবনার একদম বাইরে। সৌদি আরব সরকার বলেছে, তাদের দেশে অবস্থানকারী ৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দিতে হবে। বাংলাদেশ যদি এটি না করে তাহলে সৌদিতে কর্মরত ২০ লাখ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হবে। রীতিমতো বম্বশেল আর কী। সংবাদটি প্রকাশিত হয় ২৫ সেপ্টেম্বর। স্বয়ং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিডিয়ার কাছে সংবাদটি প্রকাশ করেন। সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক, রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশ যে সংকটে আছে এবং তা নিয়ে মিয়ানমার সরকারের অবস্থান- এই তিনটি ফ্যাক্টর বিবেচনায় নিলে সৌদি সরকার এমন কথা কী করে বলে তা আসলেই ভাবনায় আসে না। ৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ পাসপোর্ট দিলে মিয়ানমার বড় একটি তুরুপের তাস হাতে পাবে। এতদিন ধরে তাদের মিথ্যা প্রপাগান্ডা সত্যে পরিণত হবে। তারা আরও জোরালোভাবে বলতে পারবে রোহিঙ্গা আসলেই বাংলাদেশের নাগরিক। তাহলে রোহিঙ্গাদের আর কোনো দিন মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যাবে না। সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন অত্যন্ত ভালো। মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতির সমীকরণে বাংলাদেশ সব সময় সৌদি বলয়কে সমর্থন করে আসছে। প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার মুসলিম প্রধান দেশের আকুণ্ঠ সমর্থনের মূল্য কম নয়। ওআইসিতে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। তাহলে হঠাৎ করে সব জেনে বুঝে সৌদি আরবের এমন অবস্থানের কী কারণ থাকতে পারে। দুই দেশের আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের চাওয়া পাওয়ায়, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির নতুন যে সমীকরণ তৈরি হচ্ছে, সেখানে কোনো বিষয় আছে কিনা কী জানি। তবে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে বড় একটি ঘটনা ঘটেছে। সবারই ধারণা সৌদি আরবের ইশারায় সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ও বাহরাইন ইসরায়েলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন এবং স্বীকৃতি দিয়েছে। এ বিষয়ে দুই রাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরায়েলের চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পৌরহিত্যে হোয়াইট হাউসে ১৫ সেপ্টেম্বর। তার ১০ দিনের মাথায়ই বাংলাদেশের ওপর সৌদি আরবের, রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটা অন্যায্য দাবি উত্থাপন। শোনা যাচ্ছে, আরও কয়েকটি সৌদি বলয়ের আরব দেশ দ্রুত বাহরাইন ও সংযুক্ত আমিরাতকে অনুসরণ করবে। আফ্রিকার দেশ সুদান শিগগিরই ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিচ্ছে বলে খবর বেরিয়েছে। তাতে বোঝা যায়, সৌদি আরব এই বলয়ের বিস্তার মধ্যপ্রাচ্য ও আরব অঞ্চলের বাইরেও নিতে চাচ্ছে। কোয়ার্সিভ বা চাপ সৃষ্টির ক্ষেত্র তৈরি এবং সেটিকে অসিলা করে অন্য কিছু আদায় করে নেওয়ার কৌশল কূটনীতিতে অনেক আগে থেকেই প্রচলিত। মধ্যপ্রাচ্য ও আরব বিশ্বের রাজনীতিতে সৌদি কর্তৃত্ব বজায় রাখার ওপর রাজতন্ত্র টিকে থাকা না থাকার প্রশ্ন জড়িত। শিয়া-সুন্নি বিরোধ সেকেন্ডারি। লেবাননের সদ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি গত বছর সৌদি আরবে এলে তাকে একরকম বন্দী করে বলয়ে টানার প্রচেষ্টার দিকে নজর দিলে বোঝা যায় প্রাধান্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় সৌদি আরব কতখানি মরিয়া। মধ্যপ্রাচ্যে প্রাধান্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় ইরান আগের চেয়ে এখন অনেক এগিয়ে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে সেটি সৌদি রাজতন্ত্রের জন্য ভালো খবর নয়। সুতরাং অতিরিক্ত প্রতিরক্ষা দেওয়াল তৈরিতে সৌদি আরব এখন পরাশক্তি আমেরিকা ও ইসরায়েলকে ব্যবহার করবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বিভাজনের রেষারেষিতে মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সংঘাত, সংঘর্ষ ও ভ্রাতৃঘাতী রক্তক্ষরণ আরও তীব্রতর হতে থাকবে। সৌদি বলয়ের বিপরীতে এখন এক কাতারে অবস্থান নেওয়া ইরান-তুরস্ক তুলনামূলকভাবে অনেক আধুনিক ও স্বনির্ভর। বিভাজনের রূপরেখায় কাতার, ইরাক ও সিরিয়া সৌদি বলয়ের বিপরীতে। পশ্চিম দিকের দুই আরব দেশ আলজেরিয়া ও তিউনেশিয়া জনমতের চাপে ফিলিস্তিনদের বিরুদ্ধে যেতে পারবে না। সিরিয়া, ইরাক ও লেবাননে ইরানের শক্তিশালী সামরিক মিত্র রয়েছে। বৃহৎ শক্তির সমীকরণে আমেরিকার মতো পরাশক্তি সৌদি আরবের সঙ্গে থাকার বিপরীতে রাশিয়া এবং রাশিয়ার সবকিছুতে চীনের আকুণ্ঠ সমর্থন আজকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিতে একতরফা কিছু হওয়ার সম্ভাবনা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। ফলে ইয়েমেনের যুদ্ধে জড়িয়ে সৌদি আরব সুবিধা করতে পারছে না। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদকে উৎখাত করার প্রকল্প থেকে আমেরিকা সরে গেছে। নতুন পদক্ষেপ ইসরায়েলকে স্বীকৃতিদানের প্রকল্পে আমেরিকার প্রক্সি হয়ে সৌদি আরব আফ্রিকা-এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তার করতে চাইলে করতে পারে। কারণ, সৌদি-আরবসহ অন্যান্য কিংডম এশিয়া-আফ্রিকার মুসলিম প্রধান দেশগুলোর জন্য বিশাল শ্রমবাজার। এটা সৌদি আরবের জন্য অত্যন্ত শক্তিশালী ও কার্যকর একটা সফট পাওয়ার বা অস্ত্রবিহীন ধারালো অস্ত্র। বাংলাদেশের জন্যও এ কথাটি শতভাগ সত্য। ২২ লাখ বাংলাদেশি নাগরিক শুধু সৌদি আরবেই কাজ করে। তাই হঠাৎ করে ৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকে পাসপোর্ট না দিলে বাংলাদেশের ২২ লাখ শ্রমিককে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হবে এমন বম্বশেলসম হুমকি সংগত কারণেই আমাদের ভাবিয়ে তোলে। কিন্তু হেতু কী, চিন্তায়, বিশ্লেষণে অনেক কিছু এলেও বাহ্যিকভাবে কোনো কারণ তো দেখছি না। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেওয়ার দাবি তারা কী করে উঠাতে পারে। এমনিতেই গত তিন বছরের ঘটনাচক্রে এখন এটা স্পষ্ট আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে প্রচন্ড চাপ এবং বাধ্যবাধকতা তৈরি না হলে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না।

তাই প্রশ্ন আসে, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট প্রদানের দাবি কি ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার বলয় বৃদ্ধির পরোক্ষ প্রচেষ্টা নাকি রোহিঙ্গাদের নিয়ে সৌদি আরব নতুন কোনো চিন্তা করছে। মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার অনিশ্চয়তায় রোহিঙ্গারা কি বাংলাদেশকে ঘিরে বিকল্প চিন্তায় সৌদি আরবকে ব্যবহারের কথা ভাবছে। ২০১৭ সালেরও অনেক আগ থেকে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা সেখানে বসবাস করায় সৌদি সরকারের একটা আলাদা সহানুভূতি তাদের জন্য থাকতে পারে। রোহিঙ্গারা আজ ফিলিস্তিনিদের মতো উদ্বাস্তু জাতিতে পরিণত হয়েছে। এর জন্য অবশ্যই মিয়ানমার দায়ী। কিন্তু শুধু প্রতিবেশী হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে বলির পাঁঠা বানানোর চেষ্টা হলে তা তো গ্রহণযোগ্য হবে না। এই ১১-১২ লাখ উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশ আজ কত বড় নিরাপত্তা সংকটে আছে তা এখন সবাই জানে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে জাতিসংঘ, মুসলিম প্রধান দেশগুলো এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, সবাই মিয়ানমার সরকারের নিন্দা এবং নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সব পক্ষ থেকেই আর্থিক ও মানবিক সাহায্য-সহযোগিতা এসেছে এবং তার অনেকটাই এখনো অব্যাহত। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের ওপর প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টিতে সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ব্যর্থ হয়েছে। সেই ব্যর্থতার বহু কারণ হয়তো আছে। কিন্তু সৌদি আরব কর্তৃক সাম্প্রতিক বাংলাদেশের ওপর অন্যায্য চাপ সৃষ্টির পদক্ষেপ দেখে সন্দেহ জাগে তাহলে কি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আসলেই ব্যর্থ হয়েছে, নাকি নানা ছলাকলায় সমস্যাটিকে জিইয়ে রেখে নিজ নিজ পাওয়ার ব্লকের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করছে। তাতে বিগ পাওয়ার খেলোয়াড়রা কেউ মিয়ানমার, আর কেউ বাংলাদেশের পিঠের ওপর বসতে চাইছে। মিয়ানমারে মিলিটারিরা ক্ষমতায় একটানা ৫৮ বছর ধরে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মিলিটারি কর্তৃপক্ষ এতদিন যা ইচ্ছা করে আসছে। তাতে জাতিগত সংঘাত, সংঘর্ষ, রক্তক্ষরণ, মানবতার বিপর্যয়সহ দেশের স্বাধীন সত্তাকে বিসর্জন দিতে হলে সেটি তারা দেবে। সেরকম আচরণ মিয়ানমার সরকার করছে। বিপরীতে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এখানে জাতীয় স্বার্থ, নিরাপত্তা ও স্বাধীন সত্তাকে উপেক্ষা করে সরকারের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিপরীতমুখী ভূমিকার কারণে কক্সবাজারের ক্যাম্পের চেয়ে সবকিছু উন্নতমানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেও রোহিঙ্গাদের একাংশকে ভাসানচরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ সরকার কার্যকর করতে পারেনি। রোহিঙ্গারা নির্যাতন, উৎপীড়ন ও উৎখাতের শিকার সেই ১৯৭৮ সাল থেকে। ইচ্ছা করলে পশ্চিমা বিশ্ব এবং বিশেষ করে সৌদি আরব তো ৮-১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে পারে। সেই চিন্তা না করে ৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেওয়ার চাপ দিচ্ছে, যা বাংলাদেশের জনবসতি ঘনত্বের বিবেচনায় সম্পূর্ণ অবাস্তব প্রস্তাব। গবেষকদের তথ্য মতে, ২০১৭ সালের অনেক আগেই ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখ সৌদি আরবে এবং প্রায় আড়াই লাখ পাকিস্তানে আছে। পাকিস্তান ও সৌদি আরব থেকেই গড়ে উঠেছে সশস্ত্র সংগঠন আরসা, অর্থাৎ আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি। এ বিষয়ে গত পাক্ষিকের লেখায় রেফারেন্সসহ বর্ণনা আছে। সুতরাং সৌদি সরকার কর্তৃক ৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট প্রদানে প্রস্তাবের পেছনে যে কারণই থাকুক না কেন সেটি কোনো ভালো বার্তা দেয় না।

বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে কোনো রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেওয়া হবে না। একটি বন্ধু রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এরকম একটা বম্বশেলসম প্রস্তাব বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা প্রত্যাশা করিনি।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর