মঙ্গলবার, ৬ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

অপেক্ষা

হোসেন আবদুল মান্নান

মাত্র এক মাস সময়ের মধ্যে তার এমন বদলে যাওয়াটা চোখে পড়ার মতোই। বাসার সবাই বলছে ফন্সি আগের মতো নেই। তার আনন্দ-উচ্ছ্বাস, আবেগাপ্লুত হওয়ার আগেকার ভাষা একেবারে বদলে গেছে। তার চোখে-মুখে, হাঁটাচলায় নিরানন্দ, বিষণœতার ছাপ। দিনভর শুয়ে থেকে করুণ দৃষ্টিতে তাকায়। কখনো দীর্ঘশ্বাস, কখনো সজল নেত্রে আমার বা অন্য কারও মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। যেন সব সময় ম্রিয়মাণ হয়ে থাকে। দিনের বেশির ভাগ সময় ঘরের মূল দরজাসংলগ্ন নিঃশব্দে হাত-পা মেলে পড়ে থাকে। যেন কারও জন্য অধীর আগ্রহে অন্তহীন অপেক্ষার প্রহর গুনে যাচ্ছে। আর সে হয়তো মনে মনে ভাবে, ‘সবাই যে আছে। আসে-যায়। অথচ আমার প্রকৃত মালিক, আমার আসল প্রভু ফিরে আসে না কেন? যিনি আমাকে এক মাস বয়স থেকে নিজের সন্তানের মতো আদরে-সোহাগে কোলে নিয়ে প্রতিদিন নিজ হাতে আমার স্নানাহারের সংস্থান করেছেন। এমনকি মুখের ভিতরে খাবার তুলে দিয়ে আমাকে তিন বছর বয়সী করেছেন। সবাইকে রেখে তিনি কোথায়?

করোনায় জেবুর আকস্মিক জীবনাবসানের পর থেকে ফন্সির মধ্যে আমরা এমন বিস্ময়কর আমূল পরিবর্তন দেখছি। ইদানীং বাসার কলিং বেল তাকে পাগলের মতো করে ফেলে, এক লাফে দরজায় গিয়ে চিৎকার করতে থাকে। বলতে থাকে তাড়াতাড়ি দরজাটি খুলে দাও। একটু বিলম্ব হলে সে অস্থির ও অশান্ত হয়ে ওঠে। এই বুঝি তার প্রভু আসছেন। কিন্তু খোলা দরজায় দাঁড়ানো অন্য কারও মুখমন্ডল দেখে সে মলিন বদন হয়ে ভিতরে ফিরে আসে। আবার নির্জীব, নিষ্ক্রিয় হয়ে ফ্লোরে মাথা ঠেকিয়ে পড়ে থাকে। তবে পঞ্চইন্দ্রিয় সক্রিয় রেখে মিটি মিটি করে তাকায়। শিশুদের নিষ্পাপ গাঢ় সাদা কালো চোখের মতো তার চোখ দুটো থেকে সব সময় যেন উজ্জ্বল আলো বিচ্ছুরিত হয়।

আজকাল তার অতি পরিচিত আপনজন বাসায় প্রবেশ করলে সে খুশি হয় ঠিকই কিন্তু আগের মতো প্রবল উচ্ছলতায় পদযুগলে মুখ ঠেকানো আদর ও কৃতজ্ঞতা স্বীকারের ভঙ্গিমা প্রকাশ করে না। সে যে পথ আগলে ধরে এবং বসতে বাধ্য করে সারা গায়ে মুখ লাগিয়ে নানা কুশল জানতে চাওয়ার লম্বা সময় দিত এখন তা করছে না। কারণ, বাসার অন্য সদস্যরা তার হারিয়ে যাওয়া প্রভুর মতো তাকে ভালোবাসে না; এটুকু ইতিমধ্যে সে বুঝতে পেরেছে। কাজেই সেও বোধকরি, তার সব ভালোবাসা প্রতিদিন বিন্দু বিন্দু করে জমিয়ে রাখছে আসল প্রভু জেবুর জন্য। তার দৃঢ় বিশ্বাস, প্রভু একদিন বাসায় ফিরে আসবেই। আর সেও এমনি করে পথ চেয়ে আমৃত্যু অপেক্ষমাণ থেকে যাবে।

জেনেছি, ফন্সিরা আট-নয় বছর পর্যন্ত বাঁচে। এখন তার বয়স তিন বছর। সে হিসেবে সর্বোচ্চ আর ছয় বছর বেঁচে থাকবে সে। ২০১৮ সালে পাহাড় দর্শনে গিয়ে রাঙামাটির সাজেক ভ্যালি থেকে এক মাস বয়সী ফন্সিকে কোলে করে নিয়ে আসে আমার মেয়ে ডা. যারীন। ওর জন্মস্থান ভারতের মিজোরাম প্রদেশে। দেখতে সুদর্শন সে। মিংড ব্রিড প্রজাতির সদস্য এটি। তবে কিছুদিন যেতেই মেয়ের আগ্রহে খানিকটা ভাটা পড়লে তার ভরণপোষণের সার্বিক দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয় আমার চিরসহিষ্ণু জেবু।

ফন্সিরা বেশ বিরল প্রজাতির। ওদের অন্য রকম আভিজাত্য। নিজেরা স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে খাবার খাবে না। মুখে তুলে দিতে হয়। জেবু নিত্যই এ কাজটি করে আনন্দ পেত। বলত, ‘দেখ ওর চাউনিটা কি অপূর্ব, কি মায়াবী দৃষ্টি! ওকে কেয়ার না করে উপায় থাকে? তা ছাড়া ও খুব লক্ষ্মী। এখন তো ও আমাদের পরিবারের অন্যতম এক সদস্য। মনে রেখ, ফন্সিকে আমরা কোনো দিনই দূরে রাখব না।’ কিন্তু এ কেমন নির্মম নিয়তি! ফন্সিকে নিজের ঘরে রেখে জেবুই নিরুদ্দেশ! চলে গেল দূর অজানায়, কোন সুদূরে আকাশ পাড়ে?

ফন্সির থাকা বা খাওয়ার অসুবিধা হতে পারে ভেবে ঢাকার বাইরে যাওয়ার সময় জেবু কোনো দিন তাকে কারও জিম্মায় রেখে যায়নি। সব সময় সে তার দীর্ঘ সফরসঙ্গী হয়েছে। চট্টগ্রামে চাকরির সময়ও দেখেছি জেবু গাড়ি থেকে নামার আগেই ফন্সির দীর্ঘ একলম্ফ অবতরণ। আবার যাত্রাকালে সবার আগেই সে গাড়ির ডান দিকে তার সিটের নিচে নির্ধারিত স্থান নিয়ে বসে আছে। ফন্সিকে কখনো বাঁ দিকে আমার আসনের বরাবর আসতে দেখিনি। গাড়ি চলছে, রাস্তাজুড়ে তার এদিক-ওদিক তাকানো। যেন সবকিছু তার ঘ্রাণের আয়ত্তে থাকা চেনা ভুবন। জানা যায়, মানুষের চেয়ে ৫ হাজার গুণ বেশি ঘ্রাণশক্তি নিয়ে এদের জন্ম হয়। সম্প্রতি জেবুর মৃত্যুর পর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে জেবুর তৈরি করা বাড়ির প্রতিটি কক্ষে তন্নতন্ন করে তাকে খুঁজে ফিরেছে। ফন্সি তাকে পায়নি। যদিও অদূরেই পারিবারিক কবরস্থানে জেবু চিরনিদ্রায় শায়িত। গ্রামের বাড়িতেও ফন্সির একচ্ছত্র আধিপত্য। যতক্ষণ সেখানে অবস্থান করবে বাড়ির সবকিছু যেন তার একক তত্ত্বাবধানে নিয়ন্ত্রিত। তখন স্থানীয় অন্যসব সারমেয়র অস্তিত্ব প্রায় বিপন্ন। তার শারীরিক অবয়ব ক্ষুদ্র ও ক্ষীণ তবে গর্জনে-তর্জনে, হুঙ্কারে এবং বীরত্ব প্রদর্শনে বেশ পটু ও পারদর্শী।

আজকাল তার গোসল বা খাবারের কোনো রুটিন নেই। যে যার মতো মন টানলে তার দিকে তাকায়। ফন্সিও তার জন্মগত তথা সহজাত বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বিদ্যমান পরিস্থিতি অনায়াসে অনুধাবন করতে পারে। তার কোনো অভিযোগ-অনুযোগ নেই। এখন সে খাবার প্লেটে রেখে দিলেও খায়। এমনকি ঢিল ছুড়ে দিলেও খেতে হয়। সব মান-অভিমান, বংশের ঐতিহ্য, আভিজাত্য ভুলে গিয়ে সে তার পূর্বাপর দৈনন্দিন দায়িত্ব একাগ্রচিত্তে পালন করে যাচ্ছে। বাসায় কে এলো, কে গেল এসব তার শতভাগ নজরদারিতে আছে। একই সঙ্গে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় কেউ হাতে কিছু নিয়ে যাচ্ছে কিনা এটাই তার মূল পর্যবেক্ষণ। তবে কিছু নিয়ে প্রবেশ করলে এতে তার কোনো আপত্তি বা অতিথির নিজেরও কোনো বিপত্তি নেই। সমস্যা শুধু নিষ্ক্রান্ত হওয়ার কালে। শূন্য হাতে যেতে হবে। অন্যথায় তার সঙ্গে বোঝাপড়া আছে।

সেদিন দ্বিতীয়বার গ্রামের বাড়ি গিয়েও একই কাজ করে ফন্সি। গাড়ি থেকে নেমে সোজা ঘরে ঢুকে আগের মতো প্রতিটি রুমে হানা দেয় এবং হন্যে হয়ে জেবুকে খুঁজতে থাকে। এবার সত্যি সত্যিই সে হতাশ ও হতোদ্যম হয়ে পড়ে। যেন আশাহত। তার ধারণা ছিল, এত দিন পরে এসে প্রভুকে এখানে নিশ্চয় পেয়ে যাবে। কিন্তু হায়! কোথায় হারিয়ে গেল তার মালিক? আর এ হারানো যে অনন্তকালের অন্তর্ধান, তা কি সে কখনো বুঝে উঠতে পারবে?

বিশ্ববিধাতা কি তাকে এমন বোধ, ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন? তার জন্য আমাদের মুখের ভাষাই কি যথেষ্ট?

জেবুর অকালপ্রয়াণে আমাদের মতো ফন্সিও যেন নির্বাক, ভাষাহীন, শোকাভিভূত। তবু তাকে তার আয়ুষ্কাল অবধি বাঁচিয়ে রাখাই এখন আমাদের সবার কর্তব্য।

               লেখক : গল্পকার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর