বুধবার, ৭ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

দুর্নীতি উচ্ছেদে করোনার অবদান

অধ্যাপক ডা. মো. সোহরাব আলী

দুর্নীতি উচ্ছেদে করোনার অবদান

করোনা আমাদের সামনে আরও ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সতর্ক করেছেন নভেম্বর-ডিসেম্বরে হয়তো কভিড-১৯-এর সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী সংক্রমণ ও মৃত্যু সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি সাংঘাতিক পরিস্থিতির দিকে এগোতে পারে। তিনি তাই মাস্কের ব্যবহারের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছেন। ভ্যাকসিনের আশায় আশায় আমাদের উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে, কবে পাব তাকে জানি না। বিশ্বমোড়লরা মনে হয় ভ্যাকসিন নিয়ে মজুদদারি- কালোবাজারির একটা মাস্টারপ্ল্যান এঁটে ফেলেছে। আমরা পেলেই বা আর কত পাব! বড়জোর ৫০ লাখ বা তার কিছু ওপরে। ১৭ কোটি মানুষের দেশে ভ্যাকসিনের এ সংখ্যা হয়তো ত্রাণসামগ্রী বিতরণে দুর্নীতির নির্লজ্জ পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে। যা হোক, করোনা শুধু যে আমাদের ক্ষতিই করেছে তা নয়। করোনা আমাদের অত্যন্ত আপন করে নিয়েছে। নগর-শহর-বন্দর-হাট-মাঠ-ঘাট সব জায়গায় আমাদের আশকারা পেয়ে দিল ভরে তার ট্রান্সমিশন তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে বাংলার আনাচে-কানাচে আস্তানা গেড়ে বসেছে। এখানেই হলো বাংলার সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় পরাজয়। করোনা আমাদের সমাজের নাড়িভুঁড়ি সব দেখে ফেলেছে, চিনে ফেলেছে। নোংরা আবর্জনা আমাদের কীভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে তার একটি রেপ্লিকা করোনার হাতে সংগৃহীত হয়েছে।

ফলে সমাজপতি বলুন, রাজনৈতিক নেতা তথা জনপ্রতিনিধি বলুন, ব্যবসায়ী বলুন, সরকারি আমলা বলুন অথবা আঁতেল বা জনদরদি সাংবাদিকদের কথা বলুন- সবার রোজনামচা করোনার কব্জাগত হয়ে গেছে। তাই তো সম্রাট আর রাজা-বাদশাহর দাপটে তটস্থ বাংলাদেশ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে। সম্রাট যদিও কাগজে কলমে কয়েদি তবু তাকে কেরানীগঞ্জে কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকতে হয় না। বিএসএমএমইউর সিসিইউ ওয়ার্ডের কেবিনে প্রায় নয় মাস কাটিয়ে দিচ্ছেন। সম্রাট বিধায় আসল সম্রাটের মর্যাদা পাওয়ার কথাই। কিন্তু প্রজাতন্ত্রের একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়িচালক আবদুল মালেক ওরফে বাদল যেভাবে সবার চোখের সামনে দীর্ঘদিন থেকে দোর্দ- প্রতাপে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল আর বিল গেটসের ড্রাইভার নিয়োগ পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিল- তাকে আইনের আওতায় আনাটা একমাত্র করোনার একক কৃতিত্ব। মারহাবা কভিড-১৯!

ওদিক দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাব রেজিস্ট্রি অফিসের কোটিপতি পিয়ন ইয়াসিন অফিসের সব সরকারি ফি আত্মসাৎ করে নতুন ইতিহাস গড়েছেন। সাতজন অস্ত্রধারী সিকিউরিটি কর্তৃক সারাক্ষণ আগলে রাখা জি কে শামীম বর্তমানে জেলে। সঙ্গে আছেন শামীমের দুষ্কর্মের সহায়তাকারী ও অর্থের ভাগীদার গণপূর্তের সাবেক প্রধান প্রকৌশলীসহ অনেকেই। নারী নেত্রী পাপিয়া ও তার স্বামীর যাবজ্জীবন কারাদ-ের আদেশ পাওয়ার চেষ্টা করছেন সরকারি উকিলরাই। পুরান ঢাকার রুপন ভ্রাতৃদ্বয়, মানব পাচারের দায়ে কুয়েত জেলখানায় আটক মাননীয় সংসদ সদস্য পাপুল আর কক্সবাজারের মাদক ব্যবসায়ী বিখ্যাত ডন ‘বদি ভাই’ আইনের আওতায় আছেন। এগুলো চাট্টিখানি কথা নয়! স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির মহানায়ক মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুকে তার গডফাদাররা আমেরিকায়  আপাতত থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন। মাঝখান থেকে উদীয়মান বিশ্বপ্রতারক সাহেদ করিম টকশোর বাহানা করতে গিয়ে ধরা খেয়ে গেলেন। আসলে তার কিছু রাজনৈতিক গডফাদার আর সহযোগী আমলারা ভুল পরামর্শ দিয়ে তাকে মিসগাইড করে ফেলায় মাঝপথে এসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর  কাছে ফেঁসে গেলেন। সাবরিনা তো শুধু ভাবেসাবে প্রতারক, আসলে কিছুই না। এখন জেলে পচতে বসেছেন। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির ক্ষেত্রে সর্বাধিক প্রচারিত ঘটনা হচ্ছে সাহেদের গ্রেফতার ও পঞ্চাশের অধিক মামলা-মোকদ্দমা। এ সবই করোনার আশীর্বাদ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ছাড়াও পিঁয়াজ সিন্ডিকেটসহ আরও অনেক মন্ত্রণালয়ের দুষ্কর্ম আস্তে আস্তে বের করে আনবে করোনা। যেখানেই হাত দেওয়া হচ্ছে সেখানেই অজগরের মতো গুটিয়ে থাকা দুষ্টলোকের আকামকুকাম বেরিয়ে আসছে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ছাড়াও সবরকম দুর্নীতি রোধে দুদককে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। কারও প্রতি শিথিলতা দেখানো যাবে না। প্রয়োজনে দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরও বেশি শক্তিশালী করতে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। একের পর এক প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়ম ও দুর্নীতির ঘটনা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ করছে। তাই এর সঙ্গে যদি সরকারি দলের লোকও কেউ জড়িত থাকে তাদের প্রতি আনুকূল্য দেখানো যাবে না। ভারতের CBI -এর মতো শক্ত ও স্বচ্ছ হতে হবে ACC অর্থাৎ দুদককে। সব শক্তিশালী সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলতে হবে। এতসব দুর্নীতির ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় বিরোধী পক্ষের লোকজন হয়তো খুব পুলকিত। কিন্তু সব কৃতিত্ব হবে সরকারেরই। কারণ এর আগে বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টির সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় কোনো দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে পারেনি। যদিও এসব প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির গোড়াপত্তন হয়েছিল জিয়া-এরশাদের মার্শল ল আমলেই। এখন সময় এসেছে তা নির্মূল করার এবং করোনাকালেই তা করতে হবে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে।

আমি বিশ্বাস করি বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর নিজস্ব মেধা-ক্ষমতা-যোগ্যতা-অভিজ্ঞতা আর সার্থক ভঙ্গিমা দিয়ে এসব কালিমা মুছে পরিষ্কার করে সোনার বাংলা গড়ে তুলবেন। তিনিই পারবেন। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)।

সর্বশেষ খবর