শনিবার, ১০ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুর ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মনিরপেক্ষতা

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম

বঙ্গবন্ধুর ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মনিরপেক্ষতা

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসাম্প্রদায়িক চরিত্র’- সব সংশয়, বিতর্ক ও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে, যদিও বা ছাত্রাবস্থায় তিনি রাজনীতি শুরু করেছিলেন প্রথমত মুসলিম ছাত্রলীগ এবং পরবর্তীতে মুসলিম লীগে যোগদানের মাধ্যমে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে বঙ্গবন্ধু তাঁর অন্য রাজনৈতিক সহকর্মীদের নিয়ে দাঙ্গা প্রতিরোধ ও আক্রান্ত মানুষকে রক্ষা, সাহায্য ও পুনর্বাসনে কীভাবে প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছিলেন তার বিবরণ তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে (পৃষ্ঠা ৬৩-৭১) বিশদভাবে উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীতে ’৫৪-এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিশাল বিজয়ের পরে যেদিন তিনি মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছিলেন সেদিনই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ইন্ধনে আদমজীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানো হলে বঙ্গবন্ধু সেখানেও ছুটে গিয়েছিলেন দাঙ্গা প্রতিরোধে। ষাট-সত্তরের দশকে বিভিন্ন সময় পুরান ঢাকায় বারবার হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সৃষ্টি করা হলে বঙ্গবন্ধু সব সময় আক্রান্ত এলাকায় উপস্থিত হয়ে মানুষের জানমাল রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। আর এসব করতে গিয়ে তিনি দাঙ্গাকারীদের দ্বারা আক্রান্তও হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে প্রণীত সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে গ্রহণ করা হয়। ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করায় স্বাধীনতার পরাজিত ধর্ম ব্যবসায়ী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী যারা বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধসহ সব আন্দোলন ও সংগ্রামকে ইসলাম ধর্মকে ‘বর্ম’ হিসেবে ব্যবহার করে বাধাগ্রস্ত করার হীন অপচেষ্টা চালিয়েছিল, তাদের অব্যাহত প্রচারণা ছিল- ধর্মনিরপেক্ষতার নামে শেখ মুজিব বাংলাদেশকে একটি ইসলাম ধর্মহীন হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাইছেন; শেখ মুজিব ভারত ও হিন্দুদের এজেন্ট; বাংলাদেশের মসজিদগুলো বন্ধ করে আজান দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাস্তব সত্য এটাও যে, ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর প্রচারণার কারণে সৌদি আরবসহ বেশ কিছু মুসলিম দেশ বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া থেকে বিরত ছিল। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু যেমন অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন ও চর্চা করতেন, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন, তেমনি ইসলাম ধর্মে ও মহান আল্লাহর ওপর তাঁর ছিল অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা। আবার ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ছিল অত্যন্ত শক্ত ও দৃঢ়। ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন- ‘জনসংখ্যার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের প্রিয় ধর্ম হলো ইসলাম। আওয়ামী লীগ এ মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, শাসনতন্ত্রে সুস্পষ্ট গ্যারান্টি থাকবে যে পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহয় সন্নিবেশিত ইসলামের নির্দেশাবলির পরিপন্থী কোনো আইন পাকিস্তানে প্রণয়ন বা বলবৎ করা চলবে না। শাসনতন্ত্রে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের পবিত্রতা রক্ষার গ্যারান্টি সন্নিবেশিত হবে। সর্বস্তরে ধর্মীয় শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য পর্যাপ্ত বিধিব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ যেমন ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, তাবলিগ জামাতের জন্য জায়গা প্রদান, মদ-জুয়া, ঘোড়দৌড় বন্ধ, ইসলামী সম্মেলন সংস্থার কর্মকান্ডে অংশগ্রহণই প্রমাণ করে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান বাঙালির ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধের প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধা।

বঙ্গবন্ধু ধর্মবিশ্বাস থেকে তিনি তাঁর বক্তব্য-বিবৃতিতে প্রায়শই ‘ইনশা আল্লাহ’ শব্দ ব্যবহার করতেন- আল্লাহকে স্মরণ করতেন। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে তাঁর বজ্রকঠিন ঘোষণা ছিল- ‘এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ।’ ৮ অক্টোবর ’৭০ সালে পাকিস্তান টেলিভিশন ও রেডিও পাকিস্তান কর্তৃক আয়োজিত ‘রাজনৈতিক সম্প্রচার’ শীর্ষক বক্তৃতামালায় বঙ্গবন্ধু বক্তব্য শেষ করেন এভাবে- ‘আওয়ামী লীগ দেশবাসীর যে সমর্থন ও আস্থার অধিকারী হয়েছে, তাতে আমরা বিশ্বাস করি যে, ইনশা আল্লাহ আমরা সাফল্যের সাথে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম হব’।

’৭০-এর নির্বাচনের আগে ১ ডিসেম্বর এক নির্বাচনী আবেদনে বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেন, ‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। ন্যায় ও সত্যের সংগ্রামে নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সহায় হবেন।’ ২৬ মার্চ ’৭২ আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত মহিলা ক্রীড়া সংস্থার অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ষড়যন্ত্রকারীরা যতই ষড়যন্ত্র করুক না কেন বাংলার স্বাধীনতা হরণ করার শক্তি তাদের নাই; ইনশা আল্লাহ আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন।’ ৯ মে ’৭২ রাজশাহী মাদ্রাসা ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। ইনশা আল্লাহ আবার দেখা হবে। আপনারা কাজ করুন। আপনারা প্রতিজ্ঞা করুন, আমার সোনার বাংলা গড়ে তুলব।’ ১০ মে ’৭২ পাবনার জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘মানুষকে সাহায্য করতে হবে। বিজয় নিশ্চিত বন্ধুরা। আবার দেখা হবে ইনশা আল্লাহ।’ ৭ জুন ’৭২ সোহ্্রাওয়ার্দী উদ্যানে শ্রমিকদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘শ্রমিক ভাইয়েরা, আল্লাহর ওয়াস্তে একটু উৎপাদন কর। আল্লাহর ওয়াস্তে মিল খেয়ে ফেলো না। আমি এবার তাহলে চলি। খোদা হাফেজ।’ ৩ জুলাই ’৭২ কুষ্টিয়ার জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ইনশা আল্লাহ যদি আপনারা তিন বছর কঠোর পরিশ্রম করেন, তাহলে বাংলার মানুষ আশা করি পেট ভরে ভাত খাবে। ...। আপনারা আমার সাথে দোয়া করেন সে সমস্ত লোক, আমার ভাইয়েরা শহীদ হয়েছে এই যুদ্ধে তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে আপনারা মোনাজাত করেন আমার সাথে। আল্লাহু আকবার।’ ৪ জুলাই ’৭২ কুমিল্লার জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আর সে সমস্ত ভাই, যে সমস্ত বোন, যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, তাদের আমরা মাগফেরাত কামনা করে আমার সঙ্গে মোনাজাত করুন। আল্লাহুম্মা আমিন...। বহুক্ষণ আপনারা কষ্ট করেছেন। ইনশা আল্লাহ বেঁচে থাকলে আপনাদের সাথে আবার দেখা হবে। দোয়া করবেন। আল্লাহ যেন ইমানের সঙ্গে রাখে, আর আপনাদের ভালোবাসা নিয়ে আমি মরতে পারি।’ ’৭২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর লন্ডন থেকে চিকিৎসা নিয়ে ফেরার পর সাংবাদিকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তবুও যাদের দোয়ায় আমি ফিরে এসেছি এবং আল্লাহ যেন তৌফিক দেয় তাদের সাথে যেন আমি মরতে পারি। তাদের পাশে পাশেই থাকতে পারি এবং তাদের ভালোবাসা নিয়ে আমি মরতে পারি।’ ৩ জানুয়ারি বরগুনার জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘জীবনে যা কোনোও মানুষ পায় না, তা আমি পেয়েছি। সে হলো আপনাদের ভালোবাসা। এই ভালোবাসা নিয়েই আল্লাহর কাছে আপনারা আমাকে দোয়া করবেন, আপনাদের এই ভালোবাসা নিয়ে আমি যেন মরতে পারি।’ ১২ ফেব্রুয়ারি ’৭৩ টাঙ্গাইলের নির্বাচনী জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তবে একটা কথা হলো এই- আপনারা আমাকে দোয়া করেন। আল্লাহ যেন আমাকে ইমানের সঙ্গে রাখেন।’ ১০ ডিসেম্বর ’৭৪ চট্টগ্রামে নৌবাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ইনশা আল্লাহ আমাদের সম্পদের যথাযোগ্য ব্যবহার করে সোনার বাংলা গড়ে তোলা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে। ...। ইনশা আল্লাহ বাংলার সম্পদ এখন থেকে বাংলারই থাকবে।’ জাতীয় দিবস উপলক্ষে ১৫ ডিসেম্বর ’৭৪ প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমরা যদি বাংলার সম্পদ বাংলার মাটিতে রাখতে পারি, সমাজতান্ত্রিক বিলি-বণ্টন ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে পারি এবং সকলে মিলে কঠোর পরিশ্রম করে কলকারখানায়, খেতে-ময়দানে উৎপাদন বাড়াতে পারি; তবে ইনশা আল্লাহ আমাদের ভাবী বংশধরদের শোষণমুক্ত সুখী ও সমৃদ্ধিশালী এক ভবিষ্যৎ আমরা উপহার দিতে পারব।’ ২৫ জানুয়ারি ’৭৫ জাতীয় সংসদে বাকশালের নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে বক্তব্য দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তাই, আল্লাহর নামে, চলুন, আমরা অগ্রসর হই। ‘বিস্মিল্লাহ’ বলে আল্লাহর নামে অগ্রসর হই। ইনশা আল্লাহ আমরা কামিয়াব হবই। খোদা আমাদের সহায় আছেন। ...। যদি সকলে মিলে আপনারা নতুন প্রাণে নতুন মন নিয়ে খোদাকে হাজির নাজির করে, নিজের আত্মসংশোধন করে, আত্মশুদ্ধি করে, ‘ইনশা আল্লাহ’ বলে কাজে অগ্রসর হন, তাহলে জানবেন, বাংলার জনগণ আপনাদের সাথে আছে। বাংলার জনগণ আপনাদের পাশে আছে; জনগণকে আপনারা যা বলবেন, তারা তাই করবে। আপনাদের অগ্রসর হতে হবে। ইনশা আল্লাহ আমরা কামিয়াব হবই।’ ৮ মার্চ ’৭৫ টাঙ্গাইলের কাগমারীতে মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তবু আসছি, কারণ বহুদিন আপনাদের সাথে দেখা হয় না। আপনারা আমাকে দোয়া করেন, আল্লাহ যেন ভালো রাখে।’

বঙ্গবন্ধু নিজের ধর্ম পালন সম্পর্কে লিখেছেন- ‘আমি তখন নামাজ পড়তাম এবং কোরআন তেলাওয়াত করতাম রোজ। কোরআন শরিফের বাংলা তরজমাও কয়েক খ- ছিল আমার কাছে। ঢাকা জেলে শামসুল হক সাহেবের কাছ থেকে নিয়ে মাওলানা মোহাম্মদ আলীর ইংরেজী তরজমাও পড়েছি।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ১৮০)।’ ৪ নভেম্বর ’৭২ গণপরিষদে সংবিধানের ওপর বক্তব্য শেষে বঙ্গবন্ধু প্রস্তাব করেন, ‘অধিবেশনের সব কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পূর্বে যেন মাওলানা তর্কবাগীশ সাহেব মোনাজাত করেন।’ মাননীয় স্পিকার তাঁর প্রস্তাব গ্রহণ করে মোনাজাতের মাধ্যমে সেদিন অধিবেশন শেষ করেন।

রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করে অসৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার হীন প্রচেষ্টা এবং ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর বিভিন্ন প্রচারণার জবাবে বঙ্গবন্ধু ২৮ অক্টোবর ’৭০-এ রেডিও থেকে প্রচারিত বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘ছয় দফা বা আমাদের অর্থনৈতিক কর্মসূচি ইসলামকে বিপন্ন করে তুলেছে বলে যে মিথ্যা প্রচার চালানো হচ্ছে সেই মিথ্যা প্রচারণা থেকে বিরত থাকার জন্য আমি শেষবারের মতো আহ্বান জানাচ্ছি। অঞ্চলে অঞ্চলে এবং মানুষে মানুষে সুবিচারের নিশ্চয়তাপ্রত্যাশী কোন কিছুই ইসলামের পরিপন্থী হতে পারে না। আমরা এই শাসনতান্ত্রিক নীতির প্রতি অবিচল ওয়াদাবদ্ধ যে, কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশিত ইসলামে নীতির পরিপন্থী কোনো আইনই এ দেশে পাস হতে পারে না, চাপিয়ে দেওয়া হবে না।’ ’৭০-এ সাধারণ নির্বাচনের আগে বেতার ভাষণে বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেছিলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে আমরা ইসলামে বিশ্বাসী নই। এ কথার জবাবে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য- লেবেল-সর্বস্ব ইসলামে আমরা বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে, যে ইসলাম জগদ্বাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। ইসলামের প্রবক্তা সেজে পাকিস্তানের মাটিতে বরাবর যাঁরা অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ, বঞ্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছে, আমাদের সংগ্রাম সেই মোনাফেকদেরই বিরুদ্ধে। যে দেশের শতকরা ৯৫ জনই মুসলমান সে দেশে ইসলামবিরোধী আইন পাশের কথা ভাবতে পারেন কেবল তাঁরাই ইসলামকে যাঁরা ব্যবহার করেন দুনিয়াটা ফায়দা করে তোলার কাজে।’

ধর্মের অপব্যবহার নিয়ে বঙ্গবন্ধুর উপলব্ধি- ‘মানুষ যদি সত্যিকারভাবে ধর্মভাব নিয়ে চলতো তাহলে আর মানুষে মানুষে এবং রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে এইভাবে যুগ যুগ ধরে সংগ্রাম হতো না। কিন্তু মানুষ নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য ধর্মের অর্থ যার যেভাবে ইচ্ছা সেইভাবে চালাতে চেষ্টা করেছে। সেই জন্য একই ধর্মের মধ্যে নানা মতের সৃষ্টি হয়েছে। ধরুন রসূলে করিম (দ.) ইসলাম ধর্মকে যেভাবে রূপ দিয়েছিলেন সেইভাবে যদি ধর্ম চলতো তাহলে আজ আর মানুষে মানুষে এ বিরোধ হতো না। কিন্তু সেই ইসলাম ধর্মের মধ্যে কত বিভেদ সৃষ্টি করা হয়েছে। সুন্নি, শিয়া, কাদিয়ানি, ইসমাইলি, আগাখানি, আবার মোহম্মদি, ওহাবি, কতরকমের বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে এই ধর্মের মধ্যে। এর অর্থ কী? আমরা দেখতে পেয়েছি শুধু হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ধর্মের লোকেরাই একে অন্যের সঙ্গে দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে নাই। শিয়া সুন্নি দাঙ্গার কথা আপনারা জানেন, হাজার হাজার মুসলমান মুসলমানকে হত্যা করেছে। আপনারা এও জানেন, কাদিয়ানি-শিয়া-সুন্নিদের সাথে পাঞ্জাবে যে হত্যাকান্ড হয়ে গেছে তার নজির বোধহয় ইতিহাসে বিরল। এর কারণ কী? আজ ধর্ম কোথায়? আর যারা আমাদের ধর্মের গুরু তাদের অবস্থা কী? একবার চিন্তা করলে বুঝতে পারবেন, আমাদের দেশে এককালে এই সকল তথাকথিত ধর্মগুরু বা পীর সাহেবরা ইংরেজি পড়া হারাম বলে আমাদের জাতির কী ভয়ানক ক্ষতি করেছে। সৈয়দ আহমদ যখন ইংরেজি পড়ার জন্য আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি করলেন তখন তাঁকে এই সকল পীর সাহেবরা ফতোয়া দিলো ‘কাফের’ বলে। জিন্নাহ সাহেব যখন পাকিস্তানের আন্দোলন শুরু করলেন তখন এই সমস্ত পীর সাহেবরা কায়েদে আজমের বিরুদ্ধে কী জঘন্য ভাষায় আক্রমণ করেছিল। হাজার হাজার প্যামফ্লেট কংগ্রেসের টাকা দিয়া ছাপাইয়া দেশ বিদেশে বিলি করেছিল। ইসলামের নামে তারা কোরআন ও হাদিস দিয়া প্রমাণ করে দিতে চেষ্টা করতো যে পাকিস্তান দাবি করা, আর কোরআনের খেলাফ কাজ করা একই কথা।’ (আমার দেখা নয়াচীন, পৃষ্ঠা ১০৮-১০৯)।’ ২১ ফেব্রুয়ারি ’৫৬ পাকিস্তান গণপরিষদের এক অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান রাষ্ট্রকে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র করার প্রচেষ্টা সম্পর্কে বলেছিলেন, Let Pakistan be a pure and simple Pakistan of the People. Do not try to hoodwink the people of Pakistan in the name of Islam,... Islam is for the good of the humanity: As a Mussalman, I believe in my religion and it is my duty to obey it. Allah will punish me for my faults. In there anywhere that the government will punish me if I do not say parayers five times a day? Is there in the Holy Quran, Can you show me? I think there is nowhere mentioned that the Government will punish me and put me in jail if I do not say my prayers. It is my new charecter and my own personal matter.

এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে, ’৫৪-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে শর্ষিনার পীরসহ দেশের বেশ কিছুসংখ্যক পীর এবং আলেম ধর্মসভা ডেকে ফতোয়া দিয়েছিলেন, ‘শেখ মুজিবকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না, ধর্ম শেষ হয়ে যাবে।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ২৫৬)।

১০ জানুয়ারি ’৭২ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো-কোটি মানুষের সামনে বলেছিলেন, ‘সকলে জেনে রাখুন-বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ। ...। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ইসলামের নামে এ দেশের মুসলমানদের হত্যা করেছে। ইসলামের অবমাননা আমি চাই না। আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোন ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশে কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকুক।’

১০ এপ্রিল ’৭২ গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর উত্থাপিত প্রস্তাব- ‘...। এক্ষণে এই পরিষদ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার সেই সব মূর্ত আদর্শ, যথা জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা যা শহীদান ও বীরদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তার ভিত্তিতে দেশের জন্য একটি উপযুক্ত সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে’- সর্বসম্মতক্রমে গৃহীত হয়।

ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নানা সমালোচনা ও বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে গণপরিষদসহ বিভিন্ন ভাষণে বঙ্গবন্ধু এ বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। ৪ নভেম্বর ’৭২ গণপরিষদে সংবিধান-বিলের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না। ...। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে-তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারো নাই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে-কারো বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে-তাদের কেউ বাধাদান করতে পারবে না। খ্রিষ্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে-কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বৎসর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেইমানী, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার-এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব-ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি।’

৯ মে ’৭২ রাজশাহী মাদ্রাসা ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আর সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ...। কিন্তু ইসলামের নামে আর বাংলাদেশের মানুষকে লুট করে খেতে দেয়া হবে না। পশ্চিমারা ২৩ বছর ইসলামিক ট্যাবলেট দেখিয়ে আমাদেরকে লুটেছে। আপনারা জানেন? খবর রাখেন? এই বাংলা থেকে ২৩ বছরে ৩ হাজার কোটি টাকা পশ্চিমারা আমার কৃষকের কাছ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গেছে।’

২৬ জুন ’৭২ মাইজদি কোর্টের জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমরা ধর্মনিরপেক্ষাতায় বিশ্বাস করি। তার অর্থ ধর্মবিরোধী নয়। ...। এক ধর্ম অন্য ধর্মের ওপর অত্যাচার করবে না। ধর্মের নামে জুয়াচুরি, পকেটমার, লুটতরাজ, ব্যবসা আর পশ্চিম পাকিস্তানের পয়সা খাইয়া রাজনীতি করা চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি চলবে না। ধর্মের নামে লুট করা চলবে না। তবে আমি মুসলমান, আমি মুসলমান হিসেবে আমার ধর্ম-কর্ম পালন করবো। হিন্দু হিন্দুধর্ম পালন করবে। কেউ ধর্ম-কর্মে বাধা দিবার পারবে না। ঠিক? মানেন? আমার ধর্ম আমার কাছে। তোমার ধর্ম তোমার কাছে। আমার কুরআনের আয়াতে আছে তোমার ধর্ম তোমার কাছে। আমার ধর্ম আমার কাছে, এইটাই হলো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।’

৩ জুলাই ’৭২ কুষ্টিয়ার জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘...। কিন্তু ঐ ধর্মের নামে রাজাকার, ধর্মের নামে আলবদর, ধর্মের নামে আলসামস্্ আর ধর্মের নামে ব্যবসা করতে বাংলাদেশের জনসাধারণ দেবে না, আমিও দিতে পারবো না। কারণ এই ধর্মের নামে পশ্চিমারা আমার মা-বোনকে হত্যা করেছে। আমার দেশকে লুট করেছে। আমার সংসার খতম করেছে, আমার মানুষকে গৃহহারা করেছে। সেই জন্য এ রাষ্ট্র চলবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র যেমন চলে।’

১৮ জানুয়ারি ’৭৪ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে, যারা সাম্প্রদায়িক-তারা হীন, তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালোবাসে সে কোনো দিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। আপনারা যাঁরা এখানে মুসলমান আছেন তাঁরা জানেন যে, খোদা যিনি আছেন তিনি রাব্বুল আল-আমীন-রাব্বুল মুসলেমিন নন। হিন্দু হোক, খ্রিষ্টান হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ হোক-সমস্ত মানুষ তাঁর কাছে সমান। ...। যারা এই বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা করতে চায় তাদের সম্পর্কে সাবধান হয়ে যেও। আওয়ামী লীগের কর্মীরা, তোমরা কোনো দিন সাম্প্রদায়িকতাকে পছন্দ করো নাই। তোমরা জীবনভর তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছ। তোমাদের জীবন থাকতে হবে-যেন বাংলার মাটিতে আর কেউ সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করতে না পারে।’

বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর প্রথমে সামরিক ফরমানবলে, পরবর্তীতে তথাকথিত পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতাসহ অন্যান্য মূলনীতির ওপর আঘাত আনা হয়। দেশকে পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীসমূহ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত রাজাকার-আলবদরদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে পুনর্বাসন এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প সৃষ্টির ঘৃণ্য প্রচেষ্টা শুরু হয়। সুপ্রিম কোর্ট পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ও অকার্যকর ঘোষণা করায় এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ধারাবাহিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকায় বাংলাদেশ এখন আবারও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে এগিয়ে চলেছে।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে দেশের কোটি কোটি মানুষের কণ্ঠে ধ্বনি-প্রতিধ্বনিত হোক ২৬ মার্চ ’৭৫ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় ও গভীর প্রত্যয়- ‘ইনশা আল্লাহ, বাংলাদেশ এসেছে, বাংলাদেশ থাকবে।’

লেখক : বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, হাই কোর্ট বিভাগ এবং সাবেক চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১, বাংলাদেশ।

 

সর্বশেষ খবর