রবিবার, ১১ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

দেশের অর্থনীতিতে কোটিপতি বাড়ছে

অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের

দেশের অর্থনীতিতে কোটিপতি বাড়ছে

লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৪৭ সালের আগস্টে প্রথম ভারত উপমহাদেশে ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে এবং জন্ম নেয় দুটো রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরই এ অঞ্চলের নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করে আসছেন তারা পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা শোষিত এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। ফলে পাকিস্তানের উভয় অংশের নেতৃবৃন্দ ও জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস ও সন্দেহ দানা বেঁধে উঠতে শুরু করে। উপরন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর আচরণ, বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি বিরোধী বক্তব্যসহ নানাবিধ কর্মকান্ডের কারণে পাকিস্তানের পূর্বাংশের জনগণের মধ্যে মুসলিম জাতীয়তাবাদের চেয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রাধান্য পেতে থাকে।

বস্তুত পাকিস্তানের ২৩ বছরের (১৯৪৭-৭০) শোষণ ও বঞ্চনার ফলে পাকিস্তানের শতকরা ৬৩ ভাগ শিল্প, ৭৯ ভাগ বীমা ও ৮০ ভাগ ব্যাংক সম্পদ মাত্র ২২টি পরিবারের হাতে (যার মধ্যে ২১টি পশ্চিম পাকিস্তানে) কেন্দ্রীভূত হয়। ফলে বাঙালি ব্যবসায়ী শিল্পোদ্যোক্তা ও জনগণ স্বতন্ত্র চিন্তা-ভাবনা শুরু করে। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পরপরই শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বায়ত্তশাসন অতীব জরুরি। শুধু ঘোষণা দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি, বরং বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ’৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন; যা স্বাধিকার আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। শেখ মুজিব ছয় দফাকে ‘বাঙালির বাঁচার দাবি’ হিসেবে উল্লেখ করে সারা দেশে ঝটিকা সফর শুরু করেন। ফলে ছয় দফা অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং বাঙালি জাতি ছয় দফাকে তাদের ‘মুক্তিসনদ’ হিসেবে চিহ্নিত করে। এ সত্য, ছয় দফা আন্দোলনের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়। ’৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচনী প্রচারণার সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সৃষ্ট বৈষম্য ছয় দফা বাস্তবায়নের মাধ্যমে নিরসন করা সম্ভব।’ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ছয় দফাকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এবং নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে। নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে শাসনক্ষমতা হস্তান্তরে নানা টালবাহানা করে। ফলে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনটি ধাপে ধাপে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। এহেন পরিস্থিতিতে ’৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। এবং আন্দোলনের এক পর্যায়ে ’৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সামরিক বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালির স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু করতে বাধ্য করে। অবশেষে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধ ও ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময় বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। তাই এ রাষ্ট্রটির জন্মের আনন্দের সঙ্গে রয়েছে অশ্রু-বেদনা ও আর্তনাদের সংমিশ্রণ।

বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছর (১৯৭১-৭৫) এ দেশ শাসন করেছেন। অল্প সময়ের মধ্যে অধিকাংশ দেশের স্বীকৃতি আদায়, অর্থনৈতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভসহ যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি দেশকে পুনর্গঠন করে যখন সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন ঠিক তখনই তাঁকে সপরিবার হত্যা করা হয়। থমকে দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু-ঘোষিত সব কর্মসূচি। সামরিক কিংবা ছদ্মবেশী গণতান্ত্রিক সরকারসমূহ সমাজতন্ত্র ও সাম্যের নীতি বাদ দিয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক পুঁজির মালিকানা ও বিকাশকে উৎসাহিত ও পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে। অনিয়ম, দুর্নীতি ও পুঁজি  লুণ্ঠন সমাজব্যবস্থার একটি স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়। তবে আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যদি বাঙালি জাতির জীবনে ১৫ আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনাটি না ঘটত তবে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা অর্জনের ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত দারিদ্র্যমুক্ত সমাজভিত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাসহ বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে পৌঁছে দিতে সক্ষম হতেন।

পঁচাত্তর-পরবর্তী দেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি রূপান্তর প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশে কোটিপতি বা ধনিক শ্রেণির সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। এর মধ্যে আবার অনেকের বিচরণ আলো-আঁধারী পরিবেশে। টাকা গোনা সম্ভব হয় না বলে এরা ওজন বা স্কেল দিয়ে টাকার পরিমাপ করে। রাতারাতি এরা বিদেশে বড় শহরে প্রাসাদ কিনে বেগমপাড়া কিংবা সেকেন্ড হোম গড়ে তোলে। এরা বিচ্ছিন্ন কেউ নয়, এরা এ সমাজেরই চৌর্যতন্ত্র (ক্রনি ক্যাপিটালিজম) কিংবা রাজনৈতিক অর্থনীতিতে ক্রমান্বয়ে বেড়ে ওঠা সুবিধাভোগী একটি শ্রেণি। দেশের অধিকাংশ মানুষ ভুক্তভোগী দর্শক মাত্র। রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক এরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। মাঝেমধ্যে একটু নড়াচড়া হলেও কোনো এক অদৃশ্য শক্তি পরক্ষণে তা  ধামাচাপা দিয়ে দেয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা টিকে থাকার জন্য এদের কদরও কম নয়।

স্বাধীনতা-উত্তর ৪৯ বছরে অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের যা অর্জন তা প্রশংসাযোগ্য। তবে অর্থনৈতিক বৈষম্য কেন বাড়ছে তা আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। মার্কিন গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’ ২০১৮ সালের ওয়ান্ড আলট্রন ওয়েলথ রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১২-১৭- ছয় বছরে কোটিপতি সংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সব ধনী দেশকে পেছনে ফেলে শীর্ষে অবস্থান করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী কোটিপতির সংখ্যা ৪৭ (১৯৭২ সালে) ২৩ হাজার ২১২ (২০১২ সালে), প্রায় ৫০ হাজার (২০১৪ সালে), ৭৫ হাজার ৫৬৯  (২০১৮ সালে) এবং ৮৩ হাজার ৮৩৯ (২০১৯ সালে) এক বছরের ব্যবধান (২০১৮ থেকে ২০১৯ সালে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ৮ হাজার ২৭৬। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এ সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৯ সালে দেশে আমানতকারীদের হিসাবে আমানত ছিল ১২ লাখ ১৪ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা। ওই আমানতের মধ্যে কোটিপতির দখলে ছিল ৫ লাখ ৫৬ হাজার ৯৯৬ কোটি টাকা; যা মোট আমানতের শতকরা ৪৩.৩৯ ভাগ। অর্থাৎ ৮৩ হাজার ৮৩৯ জন কোটিপতির কাছে দেশের ৪৩.৩৯ ভাগ সম্পদ ও অর্থ পুঁজিভুক্ত হয়ে আছে। বাংলাদেশের আয় ও সম্পদের বৈষম্য বেড়ে বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে গেছে। অন্যদিকে এই সময়ে কোটিপতিদের মাধ্যমে বিদেশি ব্যাংকে অর্থ পাচারের ঘটনা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে আসছে। সুইজারল্যান্ড ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী বিগত ১০ বছরে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ বেড়েছে শতকরা ১৫৬ ভাগ এবং ডিসেম্বর, ২০১৯-এ ওই ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানতের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৪২৭ কোটি টাকা (১ সুইস ফ্রাঙ্ক=৮৭ টাকা হিসাবে)। এখানে বলে নেওয়া ভালো, বাংলাদেশি যারা বর্তমানে কানাডার নাগরিক তাদের জামানত অর্থ সুইস ব্যাংক প্রকাশ করে না। এতেই বোঝা যায়, পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। গ্লোবাল ফাইন্যানশিয়াল ইনটিগ্রেটির সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বিগত ১১ বছরে (২০০৬-১৬) বাংলাদেশ থেকে ৫.৯ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে,  রাজনৈতিক ও আইনি কাঠামোর দুর্বলতার কারণে প্রতি বছর বিপুল অর্থ পাচার হচ্ছে; যার বেশির ভাগই অপ্রদর্শিত বা দুর্নীতির অর্থ কিংবা আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের মাধ্যমে হয়ে থাকে।

বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে বাংলাদেশের উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় সঞ্চয়প্রবণতাও বেড়েছে। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও গুণগত মান না বাড়ায় সমাজের একটি শ্রেণির কাছেই বেশির ভাগ সম্পদ ও অর্থ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল ওই শ্রেণির মানুষই শুধু ভোগ করেছে। এ মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে কোটিপতির তালিকা আছে সেহেতু তাদের আয়ের উৎস অনুসন্ধান করা উচিত। অন্যথায় ভবিষ্যতে কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধিসহ আয়বৈষম্য আরও মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে তা মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন ধরনের বেইল আউট কর্মসূচির পাশাপাশি পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনা এবং এর প্রবাহ বন্ধে কার্যকর ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে।

অনেক আশা নিয়ে এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। স্বপ্ন ছিল ২৩ বছরের পাকিস্তানি শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন ও অর্থনৈতিক বৈষ্যম্যের অবসান হবে। প্রতিটি মানুষ অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানসহ সুখে-শান্তিতে বসবাস করলে দেশটি হবে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বলীয়ান সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সমৃদ্ধ। কিন্তু সে স্বপ্নগুলোর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন আজও সম্ভব হয়নি। যেতে হবে অনেক দূর। বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-ঘোষিত শান্তির মডেল ও রূপরেখা অনুযায়ী আমরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করলেই আগামী প্রজন্মের জন্য একটি বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক উন্নত ও সমৃদ্ধ সমাজব্যবস্থা রেখে যেতে সক্ষম হব। এতে দেশের অর্থনীতিতে কোটিপতির আধিক্য যেমন ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে তেমনি বঙ্গবন্ধুসহ অগণিত মুক্তিযোদ্ধা ও ৩০ লাখ শহীদের আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে।

লেখক : সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), বাংলাদেশ।

সর্বশেষ খবর