রবিবার, ১১ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

খাদ্য নিরাপত্তায় বড় বাধা ইঁদুর

ড. এস এম আতিকুল্লাহ

খাদ্য নিরাপত্তায় বড় বাধা ইঁদুর

বলা হয় পরিবেশে সব উদ্ভিদ ও প্রাণী পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে একটি জটিল এবং জুতসই খাদ্যশৃঙ্খল তৈরি করে। ইঁদুর নামক প্রাণীটি তার ব্যতিক্রম। এটি প্রাণিকুল তথা মানুষের জন্য দেওয়ার চেয়ে ক্ষতি করে অনেক গুণ বেশি। এটি পরিবেশবান্ধব প্রাণী নয় বরং দুষ্টু, বদমাশ। আমার এক কৃষিবিজ্ঞানী বন্ধু বর্তমানে একজন প্রথম সারির আমলা। এরশাদের সামরিক শাসন আমলে জনৈক সামরিক কর্মকর্তা তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, বলুন তো কৃষির প্রধান সমস্যা কী? উত্তরে বললেন, স্যার, কৃষির প্রধান সমস্যা ইঁদুর। বলেন কি? তিনি হতবাক হলেন! স্যার, ইঁদুর যে পরিমাণ ধান নষ্ট করে তা দিয়ে দেশের খাদ্য ঘাটতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। মৌখিক পরীক্ষা শেষে বন্ধুর এ রসাত্মক প্রশ্নোত্তর শুনে সবাই হেসেছিল। বিষয়টি বাস্তব এবং প্রশ্নবোধক। জানা যায়, কৃষ্ণ সাগরের উপকূলবর্তী এলাকায় চতুর্দশ শতকের আলোচিত মহামারী ‘প্লেগ ডেথ’ জাহাজের মাধ্যমে ইঁদুর ইউরোপসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়। এ প্রাণী মানবস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। ৬০টি রোগজীবাণুর বাহক। এর মলমূত্র ও লোম খাদ্যদ্রব্যে মিশে টাইফয়েড, জন্ডিসসহ নানা রোগের জীবাণু ছড়ায়। মানুষের জন্য এটি একটি ভয়ঙ্কর ও শঙ্কাযুক্ত তথ্য। ইতিমধ্যে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা কৃষিতে এটির ক্ষতির দিক নিয়ে সতর্ক করেছেন। কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক সংসদে বলেছেন, ২০১৮ অর্থবছরে ইঁদুর ১ লাখ মেট্রিক টন ফসল বিনষ্ট করেছে। তিনি আরও বলেন, ধানের শতকরা ৫-৭, গমের ৪-১২ ভাগ, গোল আলুর ৫-৭, আনারসের ৬-৯ ও সেচনালার পানি ৭-১২ ভাগ ইঁদুরের কারণে দূষিত হয়। বাংলাদেশে ৫০-৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাদ্য নষ্ট করে ইঁদুর। একটি ইঁদুর প্রতিদিন তার দেহের ওজনের ১০ ভাগ খাদ্য গ্রহণ করে এবং সমপরিমাণ কেটে বিনষ্ট করে।

কৃষি ফসলের ক্ষতির পাশাপাশি সম্ভাবনাময় রুপালি মাছ এবং গ্রামে গ্রামে প্রতিষ্ঠিত পোলট্রি খামারেরও বেশ ক্ষতি করে। ইঁদুর বছরে গড়ে একটি খামারে ১৮ হাজার টাকার ক্ষতি করে। বিশেষ করে মাছ চাষের উত্তম সময় মে-আগস্টে ঘেরের চারদিকে গর্ত করে এবং তা পর্যায়ক্রমে বড় হয়ে নদী-খাল বা অন্য কোনো জলাধারের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করে। এতে ঘেরের পানি কমে যায়, পাড় ভেঙে যায়। আবার পুরনো পুকুরের মাছ চাষ বিঘিœত হয়। প্রান্তিক কৃষক যাদের একমাত্র সম্বল একটি ছোট ঘের ও পুকুর, তারা বেশি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন।

সম্প্রসারিত পোলট্রি খামারে কালো ইঁদুরের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। খামারের মেঝে, দেয়াল, কাঠের চালি ও পাটাতনের ক্ষতি করে। সুযোগ পেলে ডিম ও ছোট বাচ্চারও বিশেষ ক্ষতি করে। আর গাঁও-গ্রামের বৌ-ঝিদের নিত্যদিন ইঁদুরের গর্ত মেরামত নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়।

অন্যদিকে বসতবাড়িতে এদের বিচরণ অবাধ। আসবাবপত্রসহ ঘরের মেঝে, দেয়াল, বাঁশের ডোলা, পালি, কুলা, বীজধান, বই-পুস্তক-দলিল সবই নষ্ট করে। এর মল খুবই গন্ধযুক্ত, আশটে ও পরিবেশ বিনষ্টকারী। পাশাপাশি বসতবাড়ির ফলবাগানের ফলফলারি যেমন নারকেল, সুপারি, লিচু, পেয়ারার ব্যাপক ক্ষতি করে। ছোট ছোট গাছ, চারা, বাড়ন্ত উদ্ভিদ সহজেই নষ্ট করে কৃষকের কর্মপ্রচেষ্টার শুরুতেই ব্যাপক বিনাশ সাধন করে। এমনকি শহরেও এর ব্যাপক ক্ষতি পরিলক্ষিত হয়।

গ্রামের হাটবাজারের একটি পেশার কারিগরের বুলি হলো- ‘ইঁদুর মরে, ছারপোকা মরে, লাগলেই মরে, ইঁদুুর মরে, ইঁদুুর মরে।’ এরা ইঁদুর নিধনের টোপ হাটে বিক্রি করে। টোটকা চিকিৎসা তো আছেই। কারণ ইঁদুর নামক দুষ্ট প্রাণীটি কৃষককে সব সময় কষ্ট দেয়। সুতরাং এ পেশার মানুষের জ্ঞান-দক্ষতা কাজে লাগানো যায়। এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় গবেষণার কাজ হাতে নিতে পারে। কারণ ফসলের ক্ষেত্রে কিছু অভিজ্ঞতা থাকলেও প্রাগ্রসর মৎস্য ও পশুসম্পদের বিভাগের তথ্যের সীমাবদ্ধতা তো চোখেই পড়ে। এটির অধীনে স্কুল-কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের সম্পৃক্ত করা দরকার। স্থানীয় হাটবাজার ও ফসল সংরক্ষণাগার বিশেষ করে দোকান ও শস্যের মোকামগুলোর ব্যবস্থাপকদের ইঁদুর নিধন অভিযানে সম্পৃক্ত করা দরকার। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের পরিকল্পনায় ইঁদুর নিধন যন্ত্র তৈরির প্রকল্প হাতে নেওয়া যেতে পারে।

শহর ও গ্রামের প্রতিটি ঘর ও খামারে ইঁদুরের উপদ্রব আছে, অত্যাচারের কমতি নেই। খামারিদের ভেগান্তির শেষ নেই। ধানসহ ফল-ফসল ইঁদুরের পেটে ও মাটির গর্তে। ফার্মের ডিম নষ্ট। ইঁদুর সম্পর্কিত শেখ সাদির একটি উপমা, ‘কোনো দেশের শাসনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে যদি কুকুর হয় তার প্রধান মন্ত্রদাতা আর ইঁদুর হয় দেশের খাজাঞ্চি, তবে দেশের অবস্থা কী কল্পনা করে নাও।’ সুতরাং ইঁদুুরের কাছে বাংলাদেশের বিশাল শস্যভা-ার জমা রাখা ঠিক নয়। ইঁদুর নিধন একটি দীর্ঘমেয়াদি সংবেদনশীল বিষয়। বিগত ১৯৮৩-২০২০ সাল পর্যন্ত ৩৮ বছর ধরে ইঁদুর নিধন অভিযান চলছে। আজ ৭ অক্টোবর ‘জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান দিবস’ পালন হচ্ছে করোনার নিয়ম মেনে। এ দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- ‘সমন্বিত ইঁদুর নিধন- সুফল পাবে জনগণ’। দেখা যায়, সমন্বিত ইঁদুর নিধন বেশ কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব। সুতরাং প্রতিটি বাড়ি এ খবর পৌঁছে দিয়ে চলুন সবাই মিলে আমাদের পরিবেশ ও আগামী দিনের খাদ্য সুরক্ষা করি! দেখামাত্রই ইঁদুর ধরুন এবং মারুন!

লেখক : কনসালট্যান্ট (ভূমি ও কৃষি) [email protected]

সর্বশেষ খবর