রবিবার, ১১ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

বাংলার পান

মন্টু ডানিয়েল

হাজার বছরের সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের এক অনিবার্য উপসর্গ পান। জন্মের শুভবার্তা থেকে মৃত্যুর শোকগাথার পরিণতি পর্যন্ত পানের তালিকা সর্বাগ্রে। গ্রাম প্রবচনে ‘পান-তামাক ভক্ষণ তবে হয় কর্মের লক্ষণ’। সুদূর অতীরের দ্রাবিড়-আর্য, পাল-সেন মোগল-পাঠান, শক-হুন, জমিদার, রাজা-বাদশাহ-সম্রাটদের দরবারে পানের বাহারি উপস্থাপন ও বৈচিত্র্যঘন অভ্যর্থনাগীতির গুণমান নিয়ে রানীমহল ও অন্দরমহলে ঘটা করে মহড়া হতো। গ্রাম্যসমাজ এখনো বলে থাকে ‘পান থেকে চুন খসলেই লঙ্কাকা- বাধিও না’। পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আইন-ই-আকবরী ও আকবরের জীবনী’ বইতে দেখা যায়, নবরতেœর দরবারে পান নিয়ে আবুল কাদের বদায়ুনী (ইতিহাসবিদ) ও বীরবল (হাস্যরসিক) দ্বয়ের মধ্যে গোল বাধলে স্বয়ং সম্রাট আকবরের হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। সেই মহাকদরি পান আজকে আচার অনুষ্ঠানের গন্ডি ছাড়িয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিময়তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশসহ ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকার বহু অঞ্চলেই পানের সরবরাহ যায়। বাঙালি, পাকিস্তানি, ভারতীয়, শ্রীলঙ্কান, নেপালি মানুষ বিশ্বের যেখানে বসবাস করে প্রিয় পানও সেখানেই তাদের সঙ্গী থাকে। প্রায় প্রতিদিন রপ্তানির সব রুটে পান বিদেশে যায় এবং মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জিত হয়।

বাংলাদেশের প্রায় সর্বাঞ্চলেই সীমিত আকারে পানের চাষ হয়। অঞ্চলভেদে পান চাষের বিভিন্ন নাম থাকলেও ‘পানের বরজ’ হিসেবেই পান চাষ বেশি পরিচিত। প্রচুর বাঁশ, বাঁশের শলা, পাটখড়ি, বন-ছোন প্রভৃতি লাগে। পানের ডগা বা লতা কেটে কিছু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাটিতে পুঁতে দিলে তা থেকেই পানের বরজের জন্ম হয়। ৮ ফুটের মতো উঁচু করে চাল ছাউনি, তার নিচে বাঁশের শলা/কাঠি খাড়া করে মাটিতে পুঁতে দিয়ে তার সঙ্গে পানের লতা বেঁধে দিতে হয়। নিয়মিত পরিচর্যায় পানের গাছ এক বছরে মাটি থেকে ৮ ফুটের ছাউনিঘেরা চালের ওপরে উঠে যায়। একেকটি গাছে ৮৫ থেকে ৯০টি করে পাতা হয়। যথাযথ যতœ নিলে সারা বছরই পান (পাতা) ভাঙা ও বিক্রি করা যায়। বরজ মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বছরব্যাপী পরিচর্যার খরচ খুচরা বিক্রিতেই মেটানো যায়। মৌসুম শেষে মাঘ-ফাল্গুন-চৈত্রে বরজের সব পান একসঙ্গে বিক্রি করলে যে টাকা পাওয়া যায় সেটাই থাকে লাভ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে খরচ বাদে বিঘাপ্রতি প্রায় ২.৫ লাখ টাকা লাভ থাকে। শুধু পান চাষ করে অনেক পরিবার সচ্ছলভাবে সংসার চালাচ্ছে। বাংলাদেশের পান সমিতিগুলোর তথ্য ও মাঠ পর্যায়ের ‘পান বরজ’-সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের সরকারি রেকর্ডপত্র থেকে জানা যায়, প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে পান চাষ হয় এবং ১.৫ কোটি মানুষের জীবিকা নির্বাহ চলে।

পানের বেশ কয়েকটি জাত/প্রকার আছে। ছাচি পান, মিঠা পান, দেশি পানের পাশাপাশি গাছপানও আছে। মহেশখালীর পাহাড়ি গাছ ও সিলেটের খাসিয়াপুঞ্জি এলাকায় ‘গাছপান’-এর চাষ হয়। ব্রাজিলের আমাজান রেইন ফরেস্ট থেকেই নাকি যুগ-কাল পার হয়ে পরিব্রাজকরা বাংলাদেশে পান নিয়ে এসেছেন। আজকের ‘পান বরজ’ গাছপানেরই যুগবিস্তার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর