সোমবার, ১২ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

জয়তু শেখ হাসিনা

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

জয়তু শেখ হাসিনা

আমাদের জনপ্রিয় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাহেব জানালেন, এই সোমবারই ধর্ষকদের সর্বোচ্চ সাজা ফাঁসির বিধান করার প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করা হবে এবং এটি হচ্ছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ।

খবরটি নিশ্চিতভাবে উত্তপ্ত মরুভূমিতে এক পশলা বৃষ্টির মতো। ধর্ষকদের চরম শাস্তির জন্য যখন গোটা দেশ ফুঁসে উঠেছে সেই সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত কবিগুরুর দুটো লাইন মনে করিয়ে দিচ্ছে, ‘বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি’। কবিগুরু অবশ্য কথাগুলো লিখেছিলেন স্রষ্টার উদ্দেশে। কিন্তু মনে হচ্ছে যে মুহূর্তে সারা দেশে চলছে অস্থিরতা, ঠিক তখনই স্রষ্টা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে এই শান্তির বারি বর্ষণ করলেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে কত জনদরদি এবং জনগণের ন্যায্য দাবির প্রতি কতটা সংবেদনশীল তা নিরঙ্কুশভাবে প্রমাণ করলেন। ধর্ষকদের ফাঁসির দাবি আজ সন্দেহাতীতভাবে গণদাবি। এটি আমারও দাবি। যে হারে ২৫-৩০ বছর ধরে ধর্ষণসহ নানাবিধ নারী-শিশু নির্যাতন চলছে তখন ফাঁসি বা তার চেয়ে কঠিন, যথা নপুংসককরণের বিকল্প নেই। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বলছে, যেসব দেশে সাজা কঠিন সেসব দেশে অপরাধ কম। তার বড় উদাহরণ সৌদি আরব, ইরান, আফগানিস্তানসহ বহু দেশ।

অপরাধ বিজ্ঞান অনুযায়ী শাস্তির উদ্দেশ্য প্রতিশোধ নয় বরং দন্ডিতসহ অন্যদের অপরাধ থেকে নিবৃত্তকরণ।

বর্তমানে নারী শিশু দমন আইনের ৯(১) ধারায় শুধু ধর্ষণের সাজা যাবজ্জীবন কারাদন্ড। তবে ধর্ষিতার মৃত্যু হলে সর্বোচ্চ ফাঁসির বিধান রয়েছে ৯(২) ধারায়। শুধু ধর্ষণের জন্য যাবজ্জীবন কারাভোগের বিধান যে বহুলাংশে ব্যর্থ হয়েছে ঘটনা প্রবাহই তা প্রমাণ করছে, যার জন্যই ফাঁসির দাবি। আপিল বিভাগ এই মর্মে রায় দিয়েছে যে বাধ্যতামূলক ফাঁসির আদেশ রয়েছে অর্থাৎ যে আইনে একমাত্র সাজা মৃত্যুদন্ড সে আইন বৈধ নয়, তবে মৃত্যুদন্ডের পাশাপাশি অন্য কোনো বিকল্প শাস্তির বিধান থাকলে তা বৈধ। যার কারণে ধর্ষিতার মৃত্যুর অপরাধে এবং খুনের অপরাধে সর্বোচ্চ মৃত্যুদন্ডের বিধান বৈধ কেননা সেসব অপরাধে মৃত্যুদন্ডের পাশাপাশি বিকল্প যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিধান রয়েছে, অর্থাৎ আদালত এই দুই বিকল্প সাজার যে কোনোটিই প্রদান করতে পারে।  

মৃত্যুদন্ড নিঃসন্দেহে একটি নির্দয় সাজা। কিন্তু যদি অধিকতর নিষ্ঠুরতা বন্ধের জন্য এই নির্দয় সাজার প্রয়োজন হয়, তাহলে নিশ্চয়ই এই সাজাই কাম্য, যার জন্য আমি যে তিনটি যুদ্ধাপরাধ মামলার আপিল শুনেছিলাম তার প্রত্যেকটিতেই মৃত্যুদন্ড দিয়েছি, এমনকি সাঈদীকে যদিও অন্য তিন মাননীয় বিচারপতি দিয়েছিলেন যাবজ্জীবন।

অনেকেই নীতিগতভাবে মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে, তা হতেই পারে। আমি নিজেও যত্রতত্র মৃত্যুদন্ডের বিরোধী। কিন্তু সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে কিছু কিছু অপরাধে মৃত্যুদন্ডের বিকল্প নেই বলে বহু দেশই যারা অতীতে মৃত্যুদন্ড রোধ করে আইন করেছিলেন তাদের অনেকেই অপরাধ বেড়ে যাওয়ার কারণে মৃত্যুদন্ড ফিরিয়ে এনেছেন। এটা সত্য যে বর্তমানে, বিশেষ করে ইউরোপব্যাপী, মৃত্যুদন্ড বিলোপের দাবি উঠেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউরোপীয় মানবাধিকার কমিশন, আমেরিকান মানবাধিকার কমিশন এবং জাতিসংঘেও বহু প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে মৃত্যুদন্ড বিলোপের। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রমুখ সংস্থা এ দাবিতে সোচ্চার। এটাও সত্য যে, পৃথিবীর বহু দেশ হয় মৃত্যুদন্ড রহিত করেছে অথবা এর প্রয়োগ স্থগিত করেছে। কিন্তু তারপর বিশ্ব জনমত যাচাইয়ে দেখা গেছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বিশেষভাবে ভয়ঙ্কর অপরাধের ক্ষেত্রে মৃত্যুদন্ডের পক্ষে এবং কয়েকটি দেশ যারা মৃত্যুদন্ডের প্রয়োগ স্থগিত রেখেছিল তারা আবার এর প্রয়োগ শুরু করেছে অপরাধ বেড়ে যাওয়ায়। অনেক দেশে মৃত্যুদন্ড বিলোপের পরেও এখনো জাতিসংঘের তিন ভাগের এক ভাগ দেশে মৃত্যুদন্ড চলমান, যার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ২৮টি অঙ্গরাজ্য। গত ৮ অক্টোবর জনপ্রিয় দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে দেশের অতি পরিচিত একজন আইনজ্ঞের উদ্ধৃতি দিয়ে কয়েকটি তথ্য দেওয়া হয়েছে যেগুলো বেঠিক। লেখা হয়েছে সেই বহুল পরিচিত আইনজ্ঞ বলেছেন (১) ভারতে ২০ বছরে একটি মৃত্যুদন্ডও হয়নি (২) মৃত্যুদন্ড কার্যকরের ব্যাপারে বাংলাদেশ বিশ্বে ২নং অবস্থানে। আমার মনে হয় খবর সংগ্রহের সময় একটি ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল কারণ তার মতো একজন অতি পরিচিত এবং অভিজ্ঞ আইনজ্ঞ এমন ভুল তথ্য দিতে পারেন বলে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। প্রথমত, ভারতের ব্যাপারে যে তথ্যটি ভুল তা জানার জন্য বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই, গত ২০ মার্চের দিকে তাকালেই দেখা যাবে সেদিন ভোর ৫টা ৩০ মিনিটে তিহার জেলে দিল্লির নারকীয় ‘নির্ভয়া’ ধর্ষণ/হত্যা মামলায় চার দন্ডপ্রাপ্তকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে। তাছাড়া একই বছর ইয়াকুব নামক এক কুখ্যাত সন্ত্রাসীর ফাঁসি কার্যকর হয়। ভারতে ২০১৮ সালেই ধর্ষণসহ খুনের জন্য ৫৮ জনের ফাঁসি হয়। বাংলাদেশ ফাঁসিতে দ্বিতীয় অবস্থানে বলে যা তাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে তাও ঠিক নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদন্ড হয় চীনে। যার পরিসংখ্যান বহির্বিশ্ব পর্যন্ত পৌঁছে না। এরপরও আরও অনেক দেশ যেমন সিঙ্গাপুর, জাপান, সৌদি আরব, ইরান, মিসর, ইরাক যাদের ফাঁসির তালিকা বাংলাদেশের বেশ উপরে। বাংলাদেশের বিচারিক আদালত যত ফাঁসির দন্ড দিয়ে থাকে সেগুলো আপিল বিভাগ পর্যন্ত আসতে আসতে অনেক কমে যায়। বিচারিক আদালত ফাঁসির আদেশ দিলে আপিল না করলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার ওপর হাই কোর্টে শুনানি হয়। ফাঁসির তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের ২৮টি অঙ্গরাজ্যও কম যায় না।

মানুষ যে বিশেষভাবে রোমহর্ষক অপরাধে ফাঁসির পক্ষে তার প্রমাণ শুধু বর্তমানে উচ্চারিত দাবি থেকেই পাওয়া যায় না আরও প্রমাণ মিলেছিল যখন বিচারিক ট্রাইব্যুনাল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি না দিয়ে যাবজ্জীবন দেওয়ায় কয়েক লাখ মানুষ শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চে মিলিত হয়েছিল, যাদের দাবির মুখে পার্লামেন্ট আইন পরিবর্তন করেছিলেন। অবর্বরোচিত অপরাধে ফাঁসির দন্ড অবশ্যই কাম্য হতে পারে না। দূরপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশসহ বেশ কটি দেশেই মাদকের জন্য বাধ্যতামূলক মৃত্যুদন্ড নিশ্চিতভাবেই অমানবিক। যেসব জঘন্য অপরাধের লাগাম টানা যাচ্ছে না শুধু সেখানেই দরকার ফাঁসির বিধান। আমি মনে করি ভারতের আইনই সর্বোত্তম। সেখানে বিধান হলো শুধু জঘন্যতম অপরাধে মৃত্যুদন্ড দেওয়া যাবে এবং তা হবে অত্যন্ত বিরল ক্ষেত্রে, যার জন্য আদালতকে যুক্তি প্রদর্শন করতে হবে। প্যারিস ভিত্তিক ‘প্যানাল রিফর্ম ইন্টারন্যাশনালের’ সঙ্গে আমি এবং আপিল বিভাগের মাননীয় বিচারপতি ইমান আলি মহোদয় যুক্ত ছিলাম। মাননীয় বিচারপতি ইমান আলি সম্ভবত এখনো যুক্ত রয়েছেন। ২০০২ সালের ডিসেম্বরে উক্ত সংস্থার এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আমার বিরল সুযোগ হয়েছিল মূল প্রবন্ধ পাঠের। সেই অনুষ্ঠানে সভাপতি ছিলেন ভারতের অতি প্রখ্যাত প্রধান বিচারপতি আনন্দ, পদ্মবিভূষণ। মূল প্রবন্ধে আমি লিখেছিলাম, যে সব অপরাধ মানবতাবোধের টুঁটি চেপে হত্যা করে সে সব বিরল অপরাধে মৃত্যুদন্ড রাখা সমীচীন হতে পারে। আমার লেখার পক্ষে সমর্থন ছিল না তা নয়। এটি আন্তর্জাতিক আইন এবং দলিলাদি দ্বারাও সমর্থিত।

শুধু আইনে সর্বোচ্চ সাজা হিসেবে ফাঁসির বিধান সংযোজনের মধ্যেই সমাধান নিহিত নেই। ধর্ষণের মামলায় দোষী সাব্যস্তের হার কেন এত কম তা নির্ধারণ করে সাব্যস্তের হার অবশ্যই বাড়াতে হবে, যার জন্য প্রয়োজন সাক্ষ্য আইনসহ অন্য আইনে পরিবর্তন। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ধর্ষিতা, ধর্ষিতার পরিবার এবং অন্যান্য সাক্ষীর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। ধর্ষণের ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা সংস্থা, তথাকথিত সালিশের নামে আপস রফার চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং ওই সব সালিশ বন্ধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে ধর্ষণ একটি আপস অযোগ্য অপরাধ বিধায় এতে আপসের চেষ্টা করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ধর্ষণের আসামিরা যাতে সহজে জামিনে বের হয়ে ধর্ষিতা এবং অন্য সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে বা টাকা-পয়সার প্রস্তাব দিয়ে বিচারের পথ রুদ্ধ করতে না পারে সে জন্য সরকারি আইনজীবীদের বিশেষ নজর রাখার জন্য নির্দেশ দিতে হবে। প্রতিটি সম্ভাব্য ক্ষেত্রে ডিএনএ পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। একজন ধর্ষিতার প্রথম প্রয়োজন মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা, সে ব্যবস্থাও করতে হবে, যার জন্য প্রয়োজন হবে বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত পুলিশ টিম গঠন করার। আদালতে যেন ধর্ষিতাকে তার ব্যক্তিজীবনের ওপর প্রশ্ন করে বিব্রত করা না যায় তার জন্য সাক্ষ্য আইনে পরিবর্তন আনতে হবে এবং তাকে আদালতের বাইরে রেখে তার সাক্ষী নিতে হবে ভিডিও পদ্ধতির মাধ্যমে।

তদন্ত এবং বিচার প্রক্রিয়া যাতে বিলম্বিত না হয় সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। হিন্দু পুরাণ বলে দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণকারীদের বহুদিন পরে হলেও অবশেষে কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হয়েছিল। বেগমগঞ্জের বস্ত্র হরণকারীদেরও একই পরিণতি নিশ্চিত করতে হবে।

               লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর