সোমবার, ১২ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

নতুনদের ভবিষ্যৎ

অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত

নতুনদের ভবিষ্যৎ

আমরা শতভাগ যুবকের ভবিষ্যৎ গড়ে দিতে না পারলেও যুবসমাজের একটি বিরাট অংশকে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। বিশেষ করে যারা আমরা বয়োজ্যেষ্ঠ। আমাদের ব্যর্থতা, আচরণ এবং কৃতকর্মের ফলে যদি সমাজব্যবস্থা বসবাস অযোগ্য হয়ে যায়, তখন সমাজ আমাদের সবাইকে দায়ী করবে। কিছু কিছু মানুষ আছেন যারা সমাজের সব কিছুকেই দুষতে ভালোবাসেন; যেমন পিতা-মাতা, শিক্ষক, স্ত্রী-সন্তান বা স্বামী-শ্বশুর, বস, অধস্তন, ভাগ্যরেখা, কপাল, আর্থিক অবস্থা এমনকি সরকারকে। এর থেকে উত্তরণের পথ সত্য, সততা এবং ভালোকে খুঁজে বের করা। আলবার্ট আইনস্টাইন নিউইয়র্কের আলবানিতে ১৫ অক্টোবর, ১৯৩৬-এ এক ভাষণে বলেছিলেন- ‘আমি সেই ধারণার বিরোধী, যাতে বলা হয় যে, একজন মানুষকে পরবর্তী জীবনে যেসব জ্ঞান সরাসরি ব্যবহার করতে হয়, স্কুলে সে বিষয়গুলো শেখাতে হবে। জীবনের চাহিদা এত বহুমুখী যে, স্কুলে সেসব বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব নয়। এ ছাড়া একজন মানুষকে একটি প্রাণহীন যন্ত্র হিসেবে গণ্য করা আমার কাছে আপত্তিকর মনে হয়। সব সময়ই স্কুলের এই লক্ষ্য থাকা উচিত যে, একজন তরুণ যেন স্কুলজীবন শেষে বিশেষজ্ঞ হিসেবে নয়, এক সুসংগত ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে ওঠে। বিশেষ জ্ঞান অর্জন নয়, স্বাধীনভাবে চিন্তা করা ও নিজের বিচার ক্ষমতা বিকশিত করাকেই সর্বদা অগ্রাধিকার দিতে হবে।’ পরিশ্রমী জাতিই পারে তাদের ভবিষ্যৎ সুন্দরভাবে গড়তে। অবশ্যই নিষ্কাম কর্মই মূলশক্তি। ফলের প্রত্যাশা বা লাভ-অলাভ চিন্তা করে কোনো কাজ করা, নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে সমাজ বা রাষ্ট্রের বিশেষ কোনো কাজে নাও আসতে পারে। এ ধরনের কর্ম সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলদায়ক নয়। যখনই কেউ বলে-আমি যে কোনো সময় তোমার এই অনুরোধ রক্ষা করে কাজটি করে দেব। ধরে নিতে পারেন আপনার এই কাজ ওই ব্যক্তিকে দিয়ে কখনো হবে না। কেননা যে কোনো সময় বলতে অনাদিকালও বুঝায়। যখন কেউ বলবে আগামী সপ্তাহে আমি ছুটি নিয়ে অথবা আমার প্রচুর সময় আছে তোমার এ কাজ, সমাজ তথা জাতির মঙ্গলে আমি অবশ্যই করে দেব। ধরে নিন, আপনার জন্য এ রকম সপ্তাহ আসবে এবং যাবে কাজ হবে না। অর্থাৎ শুরুর আগেই ব্যর্থতা।  প্রতিটি নাগরিক যখন চিন্তা করবে-কী পেলাম বা কী পেলাম না। তখন রাষ্ট্রকে দেওয়ার কিছুই থাকে না। কারণ সে অতৃপ্ত। অতৃপ্ত আত্মা দিতে যেমন জানে না, তেমনি তৃপ্তির সঙ্গে নিতেও পারে না। তারা নিজের ওপর আশীর্বাদ এবং হিসাব যেমন নিতে চায় না, হিসাব নেয় কেবল দুঃখ বা অপ্রাপ্তির। তাদের মধ্যে কখনো প্রসন্নতা বা আত্মপ্রসাদ জন্মায় না। কোনো কাজের জন্য কাউকে ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা জানানো শুধু আত্মপ্রসাদ নয়। ধরে নিন, আপনি কোথায়ও একটি বক্তৃতা দিচ্ছেন, উপস্থিত দর্শক শ্রোতাদের কেউ যদি আপনার বক্তব্য থেকে ভুল তথ্য পান তাহলে মেনে নিতে হবে, আপনার বক্তব্য আপনি ভুলভাবে বা অবোধগম্যভাবে উপস্থাপন করেছেন। অথবা যারা শুনেছেন তারা আংশিক বা অসম্পূর্ণভাবে শুনেছেন। শ্রুতিবিদ্যার ভাষায় একে আংশিক শ্রুতি মনোযোগ বলা হয়।

আংশিক শুনানি নিয়ে একটি রসাত্মক গল্প আপনাদের কাছে তুলে ধরছি। এটা যেমন তেমন গল্প নয়। মদ্যপানের অপকারিতা নিয়ে এক ডাক্তারের বক্তব্য। ডাক্তার সাহেবকে এক সমাজসেবী সংস্থা একটি বিশেষ এলাকার মদ্যপায়ীদের সামনে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। শিক্ষিত, নিরক্ষর, ধনী, দিনমজুর এক বিশাল জনগোষ্ঠীর সামনে ডাক্তার সাহেব বক্তৃতা দেবেন। বক্তৃতামঞ্চে উঠেই তিনি দেখলেন, দর্শক-শ্রোতার কিছু অংশ ইতিমধ্যে মদ্যপান করে এসেছেন। ডাক্তার সাহেব বক্তৃতা ছাড়া ও ব্যবহারিকভাবে মদ ব্যবহারের খারাপ দিক তুলে ধরার জন্য দুটি জার (বোতল) যার একটিতে বিশুদ্ধ পানি এবং অপরটিতে বিশুদ্ধ অ্যালকোহলে পূর্ণ করেন। অতঃপর বক্তব্য শুরুর আগে তিনি দুটো জারে দুটো জ্যান্ত কৃমি ছেড়ে দেন। সবাই উৎসুক হয়ে তা দেখছিলেন। ফলাফল বিশুদ্ধ পানির কৃমিটি সাঁতরিয়ে উপরে উঠে আসে এবং জীবিত থাকে। অ্যালকোহলে থাকা কৃমিটি মরে, গলে, অ্যালকোহলের সঙ্গে মিশে যায় সবার চোখের সামনে। তারপর বক্তা বলেন-আমাদের শরীরের ভিতরের সব কিছুকে মদ্যপান এমনভাবেই ধ্বংস করে দেয়। দর্শক-শ্রোতাদের জিজ্ঞেস করলেন এই বক্তৃতা এবং ব্যবহারিক পরীক্ষা থেকে আপনারা কী নৈতিক শিক্ষা পেলেন? পেছনের সারিতে বসা একজন দাঁড়িয়ে বিনম্রভাবে পান্ডিত্য নিয়ে জবাব দিলেন-যদি আমরা মদ্যপান করি, তাহলে আমাদের পেটে কৃমি থাকবে না। আসলে কি তাই? অবশ্যই নয়। পুরো হলে হাসির রোল পড়ে গেল। কেন এই ধরনের জবাব? একেই বলা হয় আংশিক শুনানি এবং দ্বিতীয়ত, ধারণ ক্ষমতার অভাব। এদের মধ্যে থেকে একজন স্ব-শিক্ষিত হাতুড়ে ডাক্তার পরদিন যত বাচ্চাকে তার কাছে নিয়ে আসা হয়েছিল, যাদের পেটে কৃমি আছে বলে মনে করেছেন, তাদের সবাইকে তিনি কৃমিনাশকের পরিবর্তে মদ্যপান করাতে বললেন। এট হলো নিজের সুবিধার জন্য শোনা (self interest listening) অর্থাৎ ব্যবসায়িক বা প্রাপ্তি যোগের আশায় তিনি সেখানে সমবেত হয়েছিলেন একটা বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে, আমি নতুন কোনো চিকিৎসাপদ্ধতি হয়তো শিখতে পাব, মাতালদের জন্য! মূল কথা হলো-আমরা যা শুনতে চাই তা শুনি, যা বলা হয় আত্মোপলব্ধিতে নেই না।

আমরা যখন কোনো কাজে যাই, আমরা শুধু হাত-পা, চোখ-কান নিয়ে যাই না। আমরা পুরো দেহ নিয়েই যাই। একই সঙ্গে আমরা মগজে করে পারিবারিক সমস্যাকেও সবার অজান্তে নিয়ে যাই এবং কর্মক্ষেত্রে আমাদের চাপের মাত্রা, মানসিক ও আবেগকে প্রভাবিত করে, ফলশ্রুতিতে উৎপাদন বা আউটপুট কমে আসবে। এর প্রভাব ব্যক্তিজীবন, পেশাগত জীবন এমনকি সমাজে অবনমনের ভূমিকা রাখতে পারে। যুবসমাজের সামনে সঠিক, সত্য ও সুন্দরকে তুলে ধরতে হবে। শুধু ভুল ধরিয়ে, সমাজের খারাপ দিক তুলে ধরে, যুবসমাজের ভবিষ্যৎ গড়ে দেওয়া যাবে না। যুবসমাজ যদি মানসিক, শারীরিক, সততা নিয়ে সার্বিকভাবে শক্তিশালী হয়, তাহলে কোনো কিছুই তাদের মনের শান্তি বিনষ্ট করতে পারে না। তাদের ভালো কথা, গঠনমূলক কথা বলতে শিখতে হবে। বিখ্যাত মনীষীদের জীবনকে চলার পথের পাথেয় করে তুলতে হবে। সব প্রতিবেশী এবং বন্ধুদের বুঝতে দিতে হবে তুমি তাদের ভালো গুণের পছন্দ এবং প্রশংসা করতে দ্বিধান্বিত নও। সূর্য বা চাঁদের উল্টোপিঠের দিকে তাকানোর চেষ্টা কর না। নিজে সবচেয়ে ভালোটার কথা চিন্তা কর। ভালো কাজ কর। মানুষের কাছ থেকে ভালোটার প্রত্যাশা কর। অন্যের সুন্দর অর্জনকে, কৃতিত্বকে শ্রদ্ধা জানাতে কুণ্ঠিত বোধ কর না। অতীতের ভুলের চিন্তা না করে ভবিষ্যতের ভালো চিন্তা করতে শিখ। সবার সঙ্গে বিনয় এবং হাসি মুখে কথা বল। অন্যের সমালোচনা করে সময় নষ্ট না করে নিজে গড়ে তোল। তাহলেই আত্মতৃপ্তি আসবে এবং কাজ করার ইচ্ছা দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা যুবসমাজকে প্রভাবিত করে। এটাই যুবসমাজই উন্নয়নের সবচেয়ে বড়শক্তি। যুবসমাজের মনকে প্রজ্বলিত করে, উজ্জ্বল দিনের প্রত্যাশায় সমাজ তথা রাষ্ট্রের উন্নয়ন সম্ভব। তাদের পঞ্চইন্দ্রিয়কে সমানভাবে শানিত করে সাধারণ জ্ঞান এবং দেশ প্রেমের প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা হাতে তুলে দিতে হবে। দেশকে সমৃদ্ধশালী করতে হলে, রাষ্ট্রনায়কের ভীষণ পূর্ণ করতে হলে, জনগণকে দারিদ্র্যসীমার ঊর্ধ্বে নিতে হলে সবার আগে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের অধিকতর উন্নতি প্রয়োজন। যুবসমাজকে কঠোরভাবে কর্মব্যস্ত দক্ষ, প্রশিক্ষিত জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

আমাদের এখনই স্থির সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কত সময়ের মধ্যে দারিদ্র্যকে শূন্যের কোঠায় নামানো যাবে, শতভাগ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী নিশ্চিত করা যাবে, গুণগত এবং মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা যাবে। আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত যা জনগণের মানবিক মূল্যবোধকে শানিত করবে। স্থূূলকথা হচ্ছে কর্মবিষয়ক মানসিক প্রেরণা এবং কর্ম সংগ্রহ হচ্ছে তার বহিঃপ্রকাশ। নেলসন ম্যান্ডেলাকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তাকে কীভাবে মনে রাখলে খুশি হবেন তিনি? তাঁর উত্তর ছিল, ‘আমি চাই আমার সম্পর্কে এরকম কথাই বলা হোক, এখানে এমন এক মানুষ শায়িত আছেন, যিনি পৃথিবীতে তার কর্তব্য সম্পাদন করেছেন। আমি চাই এটুকুই বলা হোক আমার সম্পর্কে।’ সুতরাং আমি বলব, প্রতিটি তরুণের সম্ভাবনা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। তাহলেই দেশ সমৃদ্ধ হবে। দেশপ্রেমিককেই মানুষ মনে রাখবে। তার কর্মকে মনে রাখবে। সারা বিশ্বের তরুণদের নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। তারা এই বিশ্বকে কীভাবে দেখতে চায়। কতখানি নিরাপদ পৃথিবী তারা নির্মাণ করতে চায়। আজকে তাদের অবদান, আগামীর পৃথিবীকে আরও নিরাপদ করবে। তখন নেলসন ম্যান্ডেলার আন্দোলন, স্বপ্ন পূরণ হবে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন পূরণ হবে। যুবসমাজ নির্ধারণ করবে আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। 

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর