সোমবার, ১২ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

বারবার সেপ্টেম্বর আসুক ফিরে

প্রভাষ আমিন

বারবার সেপ্টেম্বর আসুক ফিরে

গত ৩১ জুলাই রাতে, মানে ঈদুল আজহার আগের রাতে টেকনাফ-কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা রাশেদ খান। তারপর দেশজুড়ে ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে অসাধারণ এক গণজাগরণ সৃষ্টি হয়। আমরা সবাই মানবাধিকারপন্থি হয়ে যাই। বছর দুয়েক আগে আরও একবার এ টেকনাফেরই কাউন্সিলর একরামুল হকের ক্রসফায়ার নিয়েও দেশজুড়ে অনেক হৈচৈ হয়েছিল। একরামুলকে হত্যার সময় তার কন্যা টেলিফোনে তার সঙ্গে কথা বলছিলেন। বাবার কাছে কন্যার প্রশ্ন ছিল, বাবা তুমি কান্না করতেছ যে? জবাবে এসেছে গুলির শব্দ। একরামুলের কন্যার সেই প্রশ্ন গোটা জাতিকে কাঁদিয়েছে। কিন্তু ক্রসফায়ার বন্ধ হয়নি। টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ, যিনি এখন মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে কারাগারে আছেন, তার বিরুদ্ধে ২০৪ জন মানুষকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যার অভিযোগ এসেছে। একরামুলের কান্না বা তার মেয়ের প্রশ্ন ক্রসফায়ারের রাশ টানতে না পারলেও শেষ পর্যন্ত সাবেক মেজর সিনহার মৃত্যুই হয়তো হত্যার এ উৎসব বন্ধ করতে পারত। গত সেপ্টেম্ব^র মাসে বাংলাদেশে একটিও ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেনি, এটা যে কত বড় স্বস্তির সেটি বুঝবেন; যখন জানবেন, এমন শূন্য ক্রসফায়ারের সর্বশেষ মাসটি ছিল ১১ বছর আগে, ২০০৯ সালের মার্চে। কিন্তু আমার ঘোরতর সন্দেহ হচ্ছে শূন্য মৃত্যুর এ সাফল্য, এ স্বস্তি আমরা ধরে রাখতে পারব কিনা।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দেখে আমার এ সন্দেহ হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বেগমগঞ্জের ঘটনায় দায়ীদের ক্রসফায়ারের দাবিতে সোচ্চার। হঠাৎ করে বাংলাদেশে আসা কেউ এ প্রতিক্রিয়া দেখে অবাক হতে পারেন, একটা সভ্য দেশে প্রকাশ্যে মানুষ ক্রসফায়ারের দাবি তুলতে পারে! কিন্তু আমি অবাক হইনি। দীর্ঘদিন ধরে দেখতে দেখতে আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষ মূলত ক্রসফায়ারপন্থি। শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নয়,  আইন প্রণেতারা জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে ক্রসফায়ারের দাবি তোলার মতো অবিশ্বাস্য কান্ডও এ বাংলাদেশেই ঘটেছে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশে ক্রসফায়ার নিয়ে গণভোট হলে ৯০ ভাগ বা তারচেয়েও বেশি মানুষ এর পক্ষে ভোট দেবে বলে আমার ধারণা। যাদের পরিবার বা আত্মীয়স্বজন বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন; তারাই হয়তো ক্রসফায়ারের বিপক্ষে ভোট দেবেন। কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক-যাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের বিচারবহির্ভূত কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, জনমত গঠন করার কথা তারাই প্রকাশ্যে ক্রসফায়ারের দাবি করছেন। কী ভয়ঙ্কর কথা। সাধারণ প্রবণতা কী বলে। রাষ্ট্র তার সুবিধামতো ক্রসফায়ার করবে, জনগণ রুখে দাঁড়াবে। কিন্তু বাংলাদেশে জনগণ ক্রসফায়ারের দাবি করে সরকারের কাজটি সহজ করে দিচ্ছে।

বাংলাদেশের গত দুটি নির্বাচন ভালো হয়নি। ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন, প্রার্থীবিহীন নির্বাচনে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্ব^র অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ভোট গ্রহণ নাকি আগের রাতে হয়েছিল। আইনগত বৈধতায় কোনো সমস্যা না থাকলেও পরপর দুটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকা সরকারের নৈতিক ভিত্তি খুব শক্ত নয়। সে কারণেই কিনা জানি না, হয়তো জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার অপরাধবোধ থেকেই এ সরকার জনমতকে খুব গুরুত্ব দেয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে কোনো ইস্যুতে গড়ে ওঠা জনমতের সঙ্গে খুব একটা সংঘাতে যায় না সরকার। দেশে অনেক ঘটনা ঘটে। কিন্তু আন্দোলন খুব দানা বাঁধার আগেই সরকার ব্যবস্থা নিয়ে নেয়। তাই সরকারকে গালি দেওয়ার গলার জোরটা আর থাকে না। যেমন সিলেটের এমসি কলেজের ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগ কর্মীদের দ্রুতই গ্রেফতার করা হয়েছে, ছাত্রলীগ বলে তারা কোনো ছাড় পায়নি। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের অভিযুক্তদেরও গ্রেফতারে বিলম্ব হয়নি। স্বতঃস্ফূর্ত কিন্তু প্রবল গণআন্দোলনের মুখে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড করার দাবিও মেনে নিয়েছে সরকার। এখন সরকার যদি জনমতের দোহাই দিয়ে সিলেট এমসি কলেজ এবং বেগমগঞ্জের অভিযুক্তদের নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারের নাটক সাজায়, ক্রসফায়ারে হত্যা করে; আপনাদের ক্ষোভ নিশ্চয়ই প্রশমিত হবে। কিন্তু বাংলাদেশে আবার বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ফিরিয়ে আনার দায়ও কিন্তু আপনাদেরই নিতে হবে। পরে আপনার কোনো নির্দোষ স্বজন যদি ক্রসফায়ারের শিকার হয়, প্রতিবাদ করার নৈতিক অধিকার আপনার থাকবে তো?

সেদিন এক সুশীল ঘরানার মানুষ বলছিলেন, ক্রসফায়ার যদি ঠিকমতো হয়, তাহলে ঠিকই আছে। কিন্তু বাংলাদেশে তো কিছুই ঠিকমতো হয় না। আমি অবাক হয়ে অনেকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এবং বললাম, ভাই আপনাকে ঠিক করতে হবে, আপনি ক্রসফায়ারের পক্ষে না বিপক্ষে। ভালো ক্রসফায়ার, খারাপ ক্রসফায়ার; ভুল ক্রসফায়ার, ঠিক ক্রসফায়ার বলে কিছু নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আত্মরক্ষার অতি বিরল দুয়েকটি ঘটনা বাদ দিলে সব ক্রসফায়ারই ভুল, ঠান্ডা মাথায় খুন। ক্রসফায়ারের শিকার ব্যক্তি যেই হোক, ক্রসফায়ারের দাবি জানিয়ে আপনি কিন্তু সরকারের বাহিনীগুলোকে বিনা বিচারে হত্যায় প্ররোচিত করছেন। আর যারা ক্রসফায়ারে মারা যাচ্ছেন, তারা দোষী না নির্দোষ, তা কে ঠিক করছে? কোন বিচারক তাদের মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করছেন এবং দিনে দিনেই তা কার্যকর করছেন?

যারা ক্রসফায়ার চাইছেন, মনে করছেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ক্রসফায়ারই একমাত্র সমাধান; তাদের আবেগটা বুঝতেও আমার অসুবিধা হয় না। বেগমগঞ্জের ভিডিওটি দেখার পর আরও অনেকের মতো আমারও প্রচ- রাগ হয়েছে। আমিও দায়ীদের কঠিন শাস্তি চেয়েছি। কিন্তু কঠিন শাস্তি মানে কিন্তু ক্রসফায়ার নয়। আমি প্রচলিত আইনে দ্রুত তাদের শাস্তি চাই। আমি জানি, ক্রসফায়ার হলো প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার প্রতি প্রবল অনাস্থার ফল। বাংলাদেশের আদালতগুলোর মামলাজট, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, প্রভাবশালী আসামির বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষী দিতে না যাওয়া, পুলিশের দুর্বল তদন্ত, আইনের নানা দুর্বলতা, বিত্তশালী আসামির আইন এবং বিচার প্রক্রিয়া কিনে নেওয়া ইত্যাদি নানাবিধ কারণে মানুষ ন্যায়বিচার পায় না। রাজনৈতিক ও অর্থের দাপটে অপরাধীরা বারবার পার পেয়ে যায়, সমাজে বুক ফুলিয়ে চলে। এসব কারণে মানুষ প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। তারা মামলা, তদন্ত, দ্রুত বিচার, আইন-আদালতের ওপর ভরসা করতে চাচ্ছে না। তারা দ্রুত বিচার নয়, দ্রুততম বিচার চান। ধর তক্তা, মার পেরেক স্টাইল। ক্রসফায়ারের সর্বশেষ যুক্তি হয়ে এসেছে বহুল আলোচিত অধ্যক্ষ গোপালকৃষ্ণ মুহুরি হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়া। ২০০১ সালের ১৬ নভেম্ব^র চট্টগ্রামের জামাল খান রোডে বাসায় ঢুকে অস্ত্রধারী ক্যাডাররা গোপালকৃষ্ণ মুহুরিকে হত্যা করে। ২০০৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে চার আসামি-নাছির, আজম, আলমগীর কবির ও তছলিমউদ্দিন মন্টুকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। ২০০৫ সালের মার্চে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামি নাছির র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়। ২০০৬ সালে হাই কোর্ট রায়ে আজম, আলমগীর কবির ও তছলিমউদ্দিন মন্টুর মৃত্যুদন্ড বহাল রাখে। কিন্তু দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে আজম, আলমগীর কবির ও তছলিমউদ্দিন মন্টুর মৃত্যুদন্ড রদ করে আমৃত্যু কারাদন্ডের আদেশ দিয়েছে আপিল বিভাগ। প্রথম কথা হলো, একটি হত্যা মামলার বিচার শেষ হতে ১৯ বছর লেগেছে। আর বিচারিক প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত ধাপে অভিযুক্তদের সাজা কমে গেছে। এখন কেউ যদি বলেন, নাছিরের মতো বাকি তিন আসামিকেও যদি র‌্যাব বা পুলিশ ২০০৫ সালেই ক্রসফায়ারে মেরে ফেলত তাহলেই গোপালকৃষ্ণ মুহুরির পরিবার ন্যায়বিচার পেত? কী জবাব দেবেন। তবে দীর্ঘসূত্রতা বা বিচারহীনতার দোহাই দিয়েও বিচারবহির্ভূত কর্মকান্ডকে উসকে দেওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের আসলে বিচার ব্যবস্থার সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে। মামলাজট কমানোর উপায় বের করতে হবে। বিচারক বাড়াতে হবে। তদন্ত যাতে ঠিকভাবে হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। সাক্ষীরা যাতে নির্ভয়ে সাক্ষ্য দিতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। এলিট ফোর্স বানানোর পাশাপাশি এলিট কোর্ট বানাতে হবে। বিচার ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো দূর করতে সরকারের ওপর চাপ দিতে হবে। কিন্তু বিচারব্যবস্থার সমস্যার জগদ্দল সরানো অনেক কঠিন। আর ক্রসফায়ার অনেক সহজ। তাই আমরা কঠিন দাবি না করে সহজ পন্থায় বিচারের উপায় বের করে নিয়েছি।

সমস্যা হলো বাংলাদেশে প্রচলিত বিচার প্রক্রিয়ার মৌলিক ধারণাটা হলো- দুজন দোষী ছাড়া পেয়ে যাক, তবু কোনো নির্দোষ ব্যক্তি যেন সাজা না পান। শাস্তি দেওয়ার আগে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হতে হয়। আর ক্রসফায়ারের ধারণাটা হলো, আটক ব্যক্তির ব্যাপারে সন্দেহ হলেই পুলিশ তার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে দিতে পারে। মারার পর খোঁজ শুরু হয়, তার বিরুদ্ধে কয়টি মামলা ছিল। মামলার তালিকা যত লম্বা, ক্রসফায়ারের বৈধতা যেন তত বেশি। মানুষের জীবন অমূল্য। কারণ বিজ্ঞানীরা অনেক কিছু পেরেছেন, মানুষের জীবন বানাতে পারেননি। এবং পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের প্রতিটি মানুষ আলাদা। একজনের আঙ্গুলের ছাপের সঙ্গে আরেকজনেরটা মিলবে না। একজনের ডিএনএর সঙ্গে আরেকজনেরটা মিলবে না। প্রতিটি মানুষই সৃষ্টিকর্তার অপার বিস্ময়। তাই সুনিশ্চিত না হলে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় না। এমনিতে বিশ্বের অনেকে দেশে মৃত্যুদন্ডের বিধান নেই। যেসব দেশে আছে সেখানেও মৃত্যুদন্ড বাস্তবায়নের আগে অনেকগুলো ধাপ আছে। বাংলাদেশে নিম্ন আদালত, হাই কোর্ট, আপিল বিভাগ, রিভিউ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা- সব ধাপ শেষ হওয়ার পরই কেবল মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়। কিন্তু ক্রসফায়ারে কোনো ধাপ নেই, বিচার নেই, আপিল নেই। সন্দেহ হলেই ঢুশ। একই দেশে দুই ধরনের বিচার চলতে পারে না।

যতই ক্ষোভ থাকুক, আইনের ত্রুটি থাকুক, বিচারহীনতা থাকুক; বিচারবহির্ভূত কোনো কিছু সমর্থন করার সুযোগ নেই। আইন পছন্দ না হলে সংশোধনের দাবি করব, বিচার প্রক্রিয়ার কোনো ব্যত্যয় হলে প্রতিবাদ করব। কিন্তু তাড়াহুড়া করে কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়ার সুযোগ নেই। ‘জাস্টিস ডিলেইড, জাস্টিস ডিনাইড’ এটা যেমন সত্যি; আবার ‘জাস্টিস হারিড, জাস্টিস বারিড’; এটাও তো অসত্য নয়। তাই যৌক্তিক সময়ে বিচারের জন্য আমাদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে। যে দেশে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে স্বাভাবিক আদালতে, যথাযথ প্রক্রিয়া শেষে; সে দেশে কিছুতেই ক্রসফায়ার চলতে পারে না। আমি ক্রসফায়ার নয়, দ্রুত বিচার চাই, আইনের শাসন চাই। আমরা চাই বারবার সেপ্টেম্ব^র ফিরে আসুক, শুধু একটি মাস নয়, চিরদিনের জন্য বাংলাদেশ ক্রসফায়ারশূন্য হোক।

               লেখক : সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর