মঙ্গলবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিকে অভিনন্দন

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিকে অভিনন্দন

নারী নির্যাতনবিরোধী উত্তাল আন্দোলনের মধ্যেও শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনিকে অভিনন্দন। তার মাতৃসুলভ বক্তব্য সারা জাতিকে আলোড়িত অভিভূত করেছে। সবকিছুর ভালোমন্দ থাকবে। যে কোনো সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে লোক থাকে, মত থাকে। কিন্তু দীপু মনির বক্তব্য- ‘আমিও একজন মা। আমার সন্তানদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে পারি না। তাই পরীক্ষা নয়, অতীতের ফলাফল মূল্যায়ন করে পাস দেওয়া হবে।’ এ এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। একটা পরীক্ষার জন্য আসমান ভেঙে পড়বে না। অথচ ১৫-২০ লাখ পরীক্ষার্থীকে অত সময় একত্রে রেখে সংক্রমণের ঝুঁকি নেওয়া কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। মুক্তিযুদ্ধের পর ’৭২ সালে অটো পাস দেওয়া হয়েছিল। তাতে আসমান ভেঙে পড়েনি, এবারও ভেঙে পড়বে না। বরং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী হয়ে থাকবে। শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে মার্জিত একজন মহিলা দীপু মনির নাম ভবিষ্যতে অনেক দিন আলোচিত হবে। শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলন যথেষ্ট ভালো করেছিলেন। তারপর দীপু মনির সিদ্ধান্ত আমাকে আনন্দিত করেছে। জানি, এ সিদ্ধান্তে প্রধানমন্ত্রীর হাত আছে। তার ইচ্ছা ছাড়া এমন এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হতে পারে না। একসময় আমি ভাবতাম, কোনো দিন যদি বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রী হন, তিনি শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পেলে খুবই ভালো হবে। তিনি অবশ্যই মন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী নন। চারদিকে অন্ধকারে নিমজ্জিত দায়িত্ব ও মূল্যবোধহীন হতাশার মধ্যে দীপু মনির এ সিদ্ধান্ত এক আলোকবর্তিকা ও মুক্তির সুবাতাস। দেশের এ অরাজক অবস্থা থেকে মুক্তির প্রধান হাতিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আমাদের সন্তানরা আজ লেখাপড়া শিখছে। কিন্তু মানবিক হচ্ছে না, শিক্ষার কোনো গুণ অর্জন করছে না। তা সন্তানদের দোষ নয়, দোষ ব্যবস্থাপনার। আগেকার দিনে শিক্ষক ছিলেন পিতা-মাতা, আজকের শিক্ষক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তা নয়। কোনো মানবিক গুণাগুণ শিক্ষা দেওয়া হয় না। অনুকরণ অনুসরণ করার মতো কেউ নেই। তাই সমাজে এত অবক্ষয়। রাস্তাঘাটে গাড়ি-ঘোড়ায় ‘মায়ের দোয়া, মা জননী, মাকে মনে পড়ে’ কত কথা লেখা থাকে। কিন্তু সেই মায়ের জাত নারীর আজ কোনো সম্মান নেই। কী করে এটা সম্ভব! জীবনে দুবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছি- ’৭১-এ পাকিস্তানি হানাদারদের থেকে, ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে। মায়ের সামনে মাথা তুলে কথা বলতে পারতাম না। মা-মাটিই আমার জীবন। বাবা-মা নেই। বাবা চলে গেছেন ২০ বছর, মা ১৬ বছর। ছোট্ট এক মেয়ে আমার কলিজার টুকরা। এখনো কোলে বসলে জড়িয়ে ধরে যখন জিজ্ঞেস করি, তোমাকে আমার কেন এত ভালো লাগে? বাচ্চাটি কিছুই বলতে পারে না। কিন্তু আমি জানি, কুশিকে যখন জড়িয়ে ধরি মনে হয় মাকে জড়িয়ে আছি। এমন অনুভূতি সবার কেন হয় না? আমরা অনেক কিছু পেয়েছি- রাস্তাঘাট, দালানকোঠা, অর্থবিত্ত, ক্ষমতা-আধিপত্য। কিন্তু মায়া-মমতা-ভালোবাসায় কাঙাল হতে চলেছি। এত রাগ কেন হবে। কোনো ক্ষুব্ধ মানুষ কখনো ভালো কিছু করতে পারে না, বড় হতে পারে না। মহাভারতের কৌরবরা ধ্রুপদীর বস্ত্র হরণ করেছিল। তার ফল হয়েছিল পা-বের হাতে কৌরবের ধ্বংস। নোয়াখালীতে আমার মায়ের আমার বোনের বস্ত্রহরণ ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না। কেন এমন হবে? শিক্ষাব্যবস্থায় যদি আমরা উপযুক্ত সন্তান গড়ে তোলার প্রক্রিয়া নিতে পারি, সমাজকে যদি সচল সক্রিয় করে তুলতে পারি তাহলে নারী নির্যাতন, নারীর অসম্মান সামাজিকভাবেই প্রতিরোধ করা যাবে। বাচ্চারা মিছিল করে আন্দোলন করে ধর্ষকের ফাঁসি চাচ্ছে। ধর্ষককে শুধু ফাঁসি দিলেই সমস্যার সমাধান হবে? ধর্ষকও কিন্তু মানুষ। সেও কিন্তু কোনো ধর্ষিতার ভাই, বন্ধু, পিতা। শুধু একপক্ষ দেখলেই চলবে না। মেয়েদের রক্ষা করতে গিয়ে ছেলেদের ধ্বংস করা যাবে না, উচিতও না। সামাজিক বাঁধন আলগা হওয়া, বিচার-আচার নষ্ট হওয়া এবং দুর্নীতিবাজ তস্করদের প্রতিপত্তির কারণে ধর্ষণের এমন লাগামহীন বৃদ্ধি। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হলে এমনিতেই ধর্ষণ অনেকাংশে কমে যাবে। আমাদের সবকিছু ভেবেচিন্তে করা উচিত, সরকারকেও ভেবে দেখা উচিত। কোনো কিছু হেলাফেলা করা ভালো না। কোথা থেকে স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠে সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়- তাই হুঁশিয়ার সাবধান! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমি খুবই ভালোবাসি। তাকেও বলব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক অগ্নিকু-। সেখানে ভালোভাবে থাকা বড় কঠিন। তাই বুঝেশুনে কথা বলবেন। মানুষের অনুভূতিতে আঘাত লাগে এমন কিছু করবেন না। ভালো মানুষ অনেক সময় অসুবিধায় পড়ে। আপনিও পড়তে পারেন। তেমন যেন না হয়।

আমার অতি আপনজন অধ্যাপক মাজহারুল ইসলাম সেদিন ইন্তেকাল করেছেন। বেশ বয়স হয়েছিল। ১৯২৭ সালে আমাদের পাশের গ্রাম চারানে তাঁর জন্ম। বাংলাদেশে এমন শল্যচিকিৎসক দ্বিতীয়জন ছিল কিনা বলতে পারব না। কত অপারেশন করেছেন একত্র করলে হয়তো গিনেস বুকে নাম উঠবে। একজন ভালো মানুষ বলতে যা বোঝায় আমার চাচা মাজহারুল ইসলাম ছিলেন তাই। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ছিল নিবিড় সম্পর্ক। কলকাতা বেকার হোস্টেলে তিনি থাকতেন। বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাবা সিরাজুল হক আর মাজহারুল ইসলাম ছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুবই ঘনিষ্ঠ। সেই মাজহারুল ইসলাম চলে গেলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ছিলেন। ময়মনসিংহ মেডিকেলের ছাত্র ডা. শাহজাদা চৌধুরী ও ডা. নিশিকান্ত সাহা ছিল কাদেরিয়া বাহিনীর চিকিৎসক। শুধু চিকিৎসক বললে কম বলা হবে, কাদেরিয়া বাহিনী নয়, সমগ্র মুক্তাঞ্চলের ডা. শাহজাদা ছিল প্রধান ভরসা। মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসহ মুক্তাঞ্চলের প্রায় ৮০ লাখ মানুষের চিকিৎসা ডা. শাহজাদা ও নিশিকে দেখতে হতো। শাহজাদা ও নিশি দুজনই ছিল অধ্যাপক মাজহারুল ইসলামের ছাত্র। শাহজাদাকে যুদ্ধের মধ্যেই ময়মনসিংহ পাঠিয়েছিলাম। কারণ চাচা মাজহারুল ইসলাম চিঠি দিয়ে দুবার আমার কাছে লোক পাঠিয়েছিলেন, ‘বাবা, আমি কী করব? তোমাদের মুক্তাঞ্চলে চলে আসব নাকি ভারতে চলে যাব? এখানে থাকা প্রতি মুহূর্তে জীবনের ঝুঁকি।’ শাহজাদাকে পাঠিয়ে তাঁকে ময়মনসিংহ মেডিকেলেই থাকতে বলেছিলাম। যাতে যুদ্ধাহতরা তাঁর কাছে চিকিৎসা পায়, বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া আহতরা সাহায্য পায়। তা তিনি করেছিলেন, অত্যন্ত সফলতার সঙ্গেই। আমাকে বড় ভালোবাসতেন, সম্মান করতেন। কখনো কখনো কমান্ডার হিসেবে মান্য করার চেষ্টা করতেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে দীর্ঘ ১৬ বছর নির্বাসনে কাটিয়ে দেশে ফেরার পর তাঁর বড় ছেলে খুব সম্ভবত ডা. ফয়সালের বিয়েতে দাওয়াত করেছিলেন। বলেছিলাম, চাচা, আমি তো মাংস খাই না, ছুঁইও না। বিয়েতে গিয়ে কী করব? অফিসার্স ক্লাবে তাঁর ছেলের বিয়েতে আমার জন্য বাড়ি থেকে রান্না করে টিফিন ক্যারিয়ারে নিয়ে গিয়েছিলেন। অমন করেছিলেন আরেকজন জহুরুল ইসলাম। এখন তো অনেক ধনী। পাকিস্তান আমলে জহুরুল ইসলামের আশপাশে কেউ ছিলেন না। সেনাকুঞ্জে তাঁর মেয়ের বিয়েতে আমার জন্য বাড়ি থেকে রান্না করে নিয়ে গিয়েছিলেন। জহুরুল ইসলামের স্ত্রী আমার মায়ের মতো অসাধারণ মানুষ। সেদিন জননেতা রাশেদ খান মেনন পাশে বসেছিলেন। আমি মাংস খাই না শুনে বলেছিলেন, ‘কাদের, বাঘ মাংস খাওয়া ছেড়ে দিলে সেটা কেমন হয়। মাংস না খাওয়া বাঘকে তো কেউ পরোয়া করবে না।’ সেদিনের সে কথাটি আমার তেমন ভালো লাগেনি। কিন্তু কথাটি মূল্যহীন ছিল না।

সেদিন বারডেম-২, সেগুনবাগিচায় গিয়েছিলাম কুঁড়িমণির জন্য। অধ্যাপক এ কে আজাদ বারডেমের সভাপতি। অধ্যাপক ইব্রাহীমের প্রতিষ্ঠিত বারডেমের সভাপতি এ কে আজাদকে আগে আমি অধ্যাপক ইব্রাহীমের মেয়ের জামাই হিসেবেই মনে করতাম। কিন্তু না। তিনি মানুষ হিসেবেও অনন্য। বছর দশেক আগে একবার আমার বন্ধু কবি সাযযাদ কাদির বাবরের ছোট ভাই তৈমুরের জন্যও বারডেমে গিয়েছিলাম এ কে আজাদের কাছে। তৈমুর বেশ কিছুদিন অজ্ঞান হয়ে ইনটেনসিভ কেয়ারে ছিল। বিল হয়েছিল ৫-৬ লাখ। সে টাকা দেওয়ার ওদের ক্ষমতা ছিল না। ব্যাপারটা বলতেই একজন মহান দরদি মানুষের মতো বলেছিলেন, ‘আপনি এসেছেন এরপর আর কথা থাকে!’ একটা চিঠি নিয়ে সবকিছু মওকুফ করে দিয়েছিলেন। কুঁড়িমণির জন্য সেদিন ফোন করেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে বলছিলেন, ‘ভাই, আপনি আমাকে নিয়ে লিখেছিলেন আমি কি আপনার লেখার যোগ্য? মেয়েকে একবার আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। আপনার মেয়ে তো আমারও মেয়ে। আমার মেয়ে না?’ বলেছিলাম নিশ্চয়ই। সেদিন গিয়েছিলাম। বড় ভালো লেগেছে। একসময় কথা হলো অধ্যাপক মাজহারুল ইসলামকে নিয়ে। বললেন, ‘এক অর্থে আমার শিক্ষকও বলতে পারেন। যদিও তাঁর কাছে পড়িনি। কিন্তু সে সময় আমরা ছাত্র ছিলাম।’ এক ফাঁকে বললেন, ‘একবার স্যারের বাড়ি গেছি। গিয়ে দেখি গ্রামের অসংখ্য মানুষ। বললাম, ঢাকা শহরে এত মানুষ আপনার অসুবিধা হয় না?’

-অসুবিধা হবে কেন? গ্রামের মানুষ ঢাকায় এলে যাবে কোথায়? গ্রামের মানুষের আমার ওপর একটা হক আছে না?

একসময় আমার মেয়েকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘লতিফ ভাই কিন্তু আমার বন্ধু। তবু তোমার বাবাকে আমি বড় ভাইয়ের মতো মনে করি।’ উঠে আসার সময় বললেন, ‘ভাই কেমন আছে? তাকে বলবেন, আমি তাঁর কথা বলেছি, মনে করেছি। সব সময় লতিফ ভাইয়ের কথা মনে করি।’

বিশৃঙ্খলার জন্য ভুঞাপুর গিয়েও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ ভোলার জানাজার নামাজ আদায় করতে পারিনি। অমন বিশৃঙ্খল জানাজা কখনো দেখিনি। লেখাটি অনেকেই পড়েছেন, যোগাযোগ করেছেন। এমনকি প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর নাতি অধ্যক্ষ খালেদা হাবীবের ছেলে আতিকুল হাবীব সেদিন এসেছিল। সঙ্গে ছিল প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ স্মারকগ্রন্থ। যে স্মারকগ্রন্থ বেশ কয়েক বছর আগেই আদ্যোপ্রান্ত পড়েছি। ছেলেবেলায় তেমন লেখাপড়া করিনি তাই কথার মালা গাঁথতে শিখিনি। বুকের ভিতর থেকে সাদামাটা যা আসে তাই প্রকাশ করি। সত্যিই আমরা প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর মূল্যায়ন করতে পারিনি, যথাযোগ্য মর্যাদা দিইনি। ইদানীং তো কেউ কাউকেই মূল্য দিতে চায় না। বঙ্গবন্ধুকেই যখন স্বীকার করে না বা করতে চায় না তখন আমরা কে? বাঙালি জাতির জন্য শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অভাবনীয়। কিন্তু আমরা তাঁদের কাকেই-বা কতটা মনে করি। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুকে ভুলে যেতে বা ভুলিয়ে দিতে কতই-না প্রয়াস। কারবালায় ইমাম হোসাইনের হত্যা যেমন মুসলিম জাহানকে নাড়া দিয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর সপরিবার নির্মম হত্যাও তো আমাদের জন্য কম কথা নয়। মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা অস্বীকার করে বর্তমান রাজনীতি কত দিন চলবে জানি না। সত্য সত্যই। সত্যকে অস্বীকার করাই বরং বোকামি। তাই আবদুল হামিদ ভোলার জানাজা নিয়ে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ সম্পর্কে তেমন বেশি কিছু লিখিনি। যা সত্য যা বাস্তব তাও লিখতে পারিনি। আমাদের সত্যকে স্বীকার করা উচিত। সে জানাজায় শুধু মাসুদ কাছে আসতে গিয়ে দূরে সরে যায়নি, ভোলার ছেলেকেও দেখলাম দূরে দূরে ঘোরাফেরা করছে। চালচলন সবই নাটকীয়। পরে শুনলাম নাট্যজগতে তার নাকি বেশ পদচারণ। হতেও পারে। কিন্তু তার বাবা ভোলা আমার কাছে ছিল তার চেয়েও প্রিয়।

মুক্তিযুদ্ধটা কোনো ছেলেখেলা ছিল না। যদিও ইদানীং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে বলে যারা দাপনায়ে বেড়ায় তারা মুক্তিযুদ্ধকে সম্মান করে না হৃদয়ে লালন করে না। স্বার্থের জন্য যার যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই করে বা বলে। মুক্তিযুদ্ধের যদি কোনো গুরুত্ব বা মহিমা না থাকে তাহলে মুক্তিযোদ্ধাদের কি থাকে? কিছুই না। এই সাদা সোজা কথাটাও সরলপ্রাণ মুক্তিযোদ্ধারা বুঝতে চায় না, সত্যি কথা বলতে কি বুঝতেও পারে না। আমার প্রিয় বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ ভোলার দক্ষতা যোগ্যতা ও উচ্চতা কোনো দেশের সেনাবাহিনীর কোয়াটার মাস্টার জেনারেলের চেয়ে মোটেই কম ছিল না বরং বেশি ছিল। পূর্বাঞ্চলের ছালাম ফকির, খোরশেদ আলম আরও হামিদুল হক বীরপ্রতীক, খোরশেদ মাস্টার- এ ধরনের আরও কয়েকজন না থাকলে যেমন আমাকে অনেক বেগ পেতে হতো, তেমনি পশ্চিমাঞ্চলে ভোলা, আলীম, খোদাবক্স, বারী মিঞা, মোয়াজ্জেম হোসেন খান দুদু এরাও একই রকম। এদের দায়িত্ব পালনের কোনো তুলনা নেই। আঙ্গারগারার পরশুরাম মেম্বারের বাড়ি থেকে ইপিআরদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র ধুমখালির ছালাম ফকির, খোরশেদ আলম আরও হামিদুল হক বীরপ্রতীকরা যেভাবে লুকিয়ে রেখেছিল ১১ আগস্ট পাকিস্তান হানাদারদের জাহাজ ধ্বংস করে কাদেরিয়া বাহিনী যে অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ দখল করেছিল তা তার চেয়েও পরম দক্ষতায় আবদুল হামিদ ভোলার নেতৃত্বে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। সেনাবাহিনীর কোয়াটার মাস্টার জেনারেলরা স্বাভাবিক অবস্থায় নির্বিঘ্নে নিরাপদে কাজ করে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে ছিল পায়ে পায়ে বিপদ, আক্রমণের ভয়। এতসবের মধ্যেও ভোলারা দক্ষতা ও সফলতার সঙ্গে কাদেরিয়া বাহিনীকে জোগান দিয়েছে, কখনো কোনো ত্রুটি হয়নি। পুরো যুদ্ধে আমরা হানাদারদের যেমন নাস্তানাবুদ করেছি, তাদের অস্ত্র দখল করেছি, আমাদের তেমন ক্ষয়ক্ষতি বা অস্ত্র হাতছাড়া হয়নি। সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে শুধু একবার হুমায়ুন বাঙালের অতিরিক্ত অস্ত্র সরিষাবাড়ীর দিক থেকে এসে হানাদাররা ঝাওয়াইল বেঙ্গুলা আক্রমণ করে দখল করে নিয়েছিল। যে জন্য হুমায়ুন বাঙালকে অনেক তিরস্কার সহ্য করতে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে হুমায়ুন বাঙালের কোম্পানির ক্ষিপ্রতা ও দক্ষতা ছিল অসাধারণ। তার ভূমিকা ছিল উল্লেখ করার মতো। এত কিছুর পরও তার কোম্পানির অস্ত্র খোয়া যাওয়ায় একটা সময় তাকে বেশ ম্রিয়মাণ হতে হয়েছিল। যোগ্য মানুষ তার কর্মকান্ডে তার স্থান দখল করে নেয়। যুদ্ধের শেষের দিকে তার দক্ষতা, যোগ্যতা ও দৃঢ়তা তাকে যথেষ্ট সফলতা দিয়েছিল। তাকে নিয়ে হানাদারদের মধ্যে এক অলৌকিক আলোচনা ছিল। আগস্টের পর হানাদাররা মনে করত কাদেরিয়া বাহিনী শুধু মানুষের নয়, তাতে হনুমানও আছে। হুমায়ুনের দলকে তারা হনুমান কোম্পানি মনে করত। এসবের অনেক শুভ প্রভাবও পড়েছিল। যে কারণে হানাদাররা কখনো সুস্থভাবে কাদেরিয়া বাহিনী নিয়ে ভাবতে পারত না। একসময় তো তাদের আমার সম্পর্কে ধারণা হয়েছিল আমি দানব না মানব। যখন ওরা খবর পেত আমি গোপালপুর, দুপুর গড়াতে না গড়াতেই শুনত নাগরপুর। তখন হানাদাররা বলতে শুরু করেছিল- ‘এ কিয়া চিজ্ হ্যায়, কাভি ইধার কাভি ওধার। ইয়ে শ্যালা মানব হ্যায় ইয়া দানব।’ এখন যুদ্ধের কথা, যুদ্ধদিনের কথা ভাবতেই যেন কেমন লাগে।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

 

সর্বশেষ খবর