শুক্রবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

শিল্পিত অপমান

মাকিদ হায়দার

শিল্পিত অপমান

‘দিন ফুরায়ে যায়রে আমার, দিন ফুরায়ে যায়’-স্বভাব কবি গোবিন্দ চন্দ্র দাসের ‘দিন ফুরায়ে যায়’ কবিতাটি পাঠ্য ছিল স্কুল জীবনের শেষ দিকে। স্কুল জীবনের আনন্দমথিত দিনে আমাদের মতো কোনো ছেলেমেয়েই কবিতাটিকে পাঠ্য হিসেবে গ্রহণ করলেও এর অন্তর্নিহিত গূঢ় বিষয়টিকে আমরা কোনো ছাত্রছাত্রীই অনুধাবন করিনি। সূর্য উঠবে দিনান্তে অস্তাচলে যাবে, চন্দ্র উঠবে, তার জোছনা ছড়িয়ে দেবে পথে-প্রান্তরে শাখা-প্রশাখায়। প্রেমিক-প্রেমিকাদের মনে হবে, জোছনা রোদে একবার দুজনাই ভিজে আসি। জোছনা রোদে ভিজতে ভিজতে একসময় পূর্ণিমার ওই আলোকিত সমুদ্রে হঠাৎ একখন্ড মেঘ এসে অবুঝের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল তার নড়বার চড়বার যেন ইচ্ছেই নেই। বাতাস তাকে সরিয়ে না দিলে আষাঢ়-শ্রাবণের মেঘ সে রাতে জোছনাকে আর ফুটতে না দিয়ে অন্ধকারেই রেখে দিত প্রেমিক যুগলদের। সেই তরুণ-তরুণীর একবারও মনে আসেনি দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে, সময় গড়িয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। সামনের দিকে শুভ দিন, নাকি অশুভ দিন, জানবার যদি কোনো উপায় থাকত তাহলে হয়তো মানবজাতি একটু সতর্ক হতো, থাকত সচেতন, কিন্তু সেটি যখন হয়নি, তখন মানুষ মাত্রই অন্ধকারে না থেকে আলোকিত হওয়ার আশায় কেউ শিক্ষা-দীক্ষায় নিজেকে আলোকিত করলেও সবাই যে আলোর ঝরনাধারায় অবগাহন করবেন সেটি অনেকের জন্য প্রযোজ্য নয়। আমাদের দেশের শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনে আলোকিত মানুষেরা মাঝে মাঝে দু-একটা গল্প কবিতা ছড়া লিখেন, অনেক সময় ভাবতে থাকেন, আমি বোধহয় ছড়াকার সুকুমার রায়, অথবা কবি রবিঠাকুরের সমমর্যাদায় এসে গেছি। তারা একবারও বুঝতে পারে না, তাদের অখাদ্য লেখাগুলো একদিন গোখাদ্যেও পরিণত হবে না, বরং জঞ্জাল বলেই কাল ফেলে দেবে তার অনন্ত অন্ধকার গহ্বরে। ওই সব লেখক-লেখিকা সজ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে হোক, সময়-সুযোগ এবং সভা-সমিতিতে কিংবা কোনো শিল্প-সাহিত্যের তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত যদি হন কিছু কথামালা উপস্থিত দর্শ্বক-শ্রোতাকে উপহারের জন্য, তখন তারা নিজেদের এমনভাবে উপস্থাপন করেন, অনেক সময় নিজের কাছে নিজেকে পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কিংবা দানবীর হাজী মুহসীন বলেই মিনিট বিশ্ব-তিরিশেক তারা জ্ঞান বিতরণ করেন। সেই জ্ঞান বিতরণকারী যদি বিদ্যায়তনের শিক্ষক কিংবা শিক্ষিকা হয়ে থাকেন তাহলে তো সোনায় সোহাগা।

উপস্থিত দর্শ্বক-শ্রোতা সবাই যেন তাদের ছাত্রছাত্রী। সামনেই মাইক, কথা বলতে অসুবিধা নেই জেনেই কথা বলতেই থাকেন, বাধ্য হন আয়োজকদের একজন তিনি হয়তোবা খান মাহবুব, মাইকপ্রিয় কথকের কানে কানে বলে দেন, তাড়াতাড়ি শেষ করুন, সময় শেষ। মাইকপ্রিয় তার পরও বলেন, আমার আর দুটি কথা আছে। অনুরূপভাবে এবার একজন গদ্যকার কবি মহিলা। লিখেন, কী লিখেন, তা তিনিই জানেন, আর জানেন ‘বাংলা কবিতা উৎসব-২০২০’ আয়োজকের প্রধান ব্যক্তি। প্রখ্যাত কবি টাঙ্গাইল নিবাসী কবি মাহমুদ কামাল।

কবি মাহমুদ কামালদের এমন একটি সংগঠন সেটি বাংলাদেশের অন্যতম, শিল্প সাহিত্যের প্রাণকেন্দ্রে ‘অরণি’। ‘অরণি’ সাহিত্য পুরস্কার ২০২০ পেয়েছেন চারজন। দুজন বাংলাদেশি কবি, আর দুজন পশ্চিমবঙ্গের। সুখের বিষয়, অরণি সাহিত্য পুরস্কার প্রতি বছরই দিয়ে থাকে। অর্থমূল্য ঈর্ষাযোগ্য।

অনুরূপভাবে টাঙ্গাইল সাধারণ গ্রন্থাগার, টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদ এবং স্থানীয় বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ এবং স্থানীয় জিলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান খান ফারুক স্থানীয় প্রশাসন সবার সমবেত সানন্দে এ বছর ৩ মার্চ থেকে ৫ মার্চ পর্যন্ত টাঙ্গাইল পৌর উদ্যানে বাংলাদেশ্ব এবং পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে প্রায় ৭৮০ জন কবি লেখক ছড়াকার উপস্থিত হয়েছিলেন টাঙ্গাইল সাধারণ গ্রন্থাগারে। তিন দিনের আহার এবং নিদ্রার সুব্যবস্থা করেছিলেন, এবং একই সঙ্গে ঢাকা থেকে দুটি বাসভর্তি লেখক-লেখিকাকে নিয়ে উপস্থিত করেছিল বাংলা কবিতা উৎসবে। কবি মাহমুদ কামাল সর্বক্ষণই উপস্থিত ছিলেন প্রতিটি সেমিনারে, ঢাকার গণ্যমান্যরা এবং পশ্চিমবঙ্গের গণমান্যদের হাতে সম্মাননা ক্রেস্টসহ ঈর্ষণীয় অর্থমূল্যে সম্মানিত করলেও শুধু একজন ছড়াকার এবং একজন মহিলা কবি ৫ মার্চ বিকালের ঝড়বৃষ্টির পরে সাধারণ গ্রন্থাগার-প্রদত্ত উক্ত ঈর্ষণীয় অর্থ ফেরত দিলেন, বললেন কিছু অশোভন কথা। উপস্থিত আমরা সবাই, ওই দুজনের অশোভন বার্তা কথনে আহত না হয়ে পারিনি। আমার পাশেই ছিলেন একজন বয়সী ভদ্রমহিলা শিল্প ও সাহিত্যপ্রেমী। তিনি ক্ষোভে জানালেন, যারা আমাদের টাঙ্গাইল সাধারণ গ্রন্থাগারের প্রদত্ত অর্থ ফিরিয়ে দিলেন এবং টাঙ্গাইলবাসীকে অপমান করলেন, তিনি কিছুক্ষণ পরই বললেন যদি তিনি নিজের পকেট থেকে টাকা দিতেন তাহলে বলতে পারতেম পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার হাজী মুহসীন। তা তো নয়ই, এই এত বড় একটি অনুষ্ঠানের সব আয়োজক এবং এ আয়োজনের প্রাণপুরুষ, আজকের অনুষ্ঠানের শেষ সভাপতি কবি মাহমুদ কামালকে এবং বিদেশি অতিথিদের সামনে উক্ত লেখকদ্বয় যে অশোভন আচরণ করলেন সেটি অকল্পনীয়। এমনকি আমরা যারা বাংলাদেশি-কবি, লেখক, ছড়াকার, গল্পকার, উপস্থিত ছিলাম তারাও লজ্জা পেয়েছিলেম সাধারণ গ্রন্থাগার টাঙ্গাইলের দেওয়া সেই ঈর্ষণীয় অর্থ ফেরত দেওয়ায়। সবাই অপেক্ষায় ছিলাম শেষ অনুষ্ঠানের সভাপতি কবি, অধ্যাপক মাহমুদ কামালের কথা শোনবার, তিনি তার সংক্ষিপ্ত কথায় জানালেন, অরণি সাহিত্য পুরস্কার, টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদ পুরস্কার এবং সাধারণ গ্রন্থাগার পুরস্কার বিগত পাঁচটি বাংলা কবিতা উৎসবে গুণী লেখকদের হাতে তুলে দিতে পেরে নিজেদের গৌরবান্বিত মনে করেছি। এবং একই সঙ্গে টাঙ্গাইলের অধিকাংশ্ব কবিই সুপ্রতিষ্ঠিত পশ্চিমবঙ্গে এবং বাংলাদেশে। সেসব কবির অনেকেই বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন কবিতায় এবং আনন্দের সঙ্গেই বলতে পারি, টাঙ্গাইলে যত কবি সাহিত্যিকের জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের অন্য কোনো জেলায় আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে আজকেই এই তিন দিনব্যাপী শেষ অনুষ্ঠানে, আমাকে অতিকষ্টের সঙ্গে বলতে হচ্ছে আমি এবং সাধারণ গ্রন্থাগারকে যে অপমানটি করা হলো, সেটি দুঃখজনক। ইতিপূর্বে আমি এভাবে শিল্পিত অপমান হইনি, দেশে এবং বিদেশে। শুধু যে আমাকেই অপমান করা হলো তাই নয়, দুই টাঙ্গাইলবাসী কবি লেখক, অহংবোধে অপমান করলেন সাধারণ গ্রন্থাগারকে। বলাবাহুল্য, সাধারণ গ্রন্থাগার টাঙ্গাইলের সাধারণ সম্পাদকও আমি। আমরা শ্রোতাকুল সভাপতির ভাষণকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেম, এবং ওই দুজন ঈর্ষণীয় অর্থ ফেরত দেওয়ার দায়ে তখনই ভেবেছিলেম, অহংকার পতনের মূল।

প্রসঙ্গক্রমে, একটু অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও বলতে দ্বিধা নেই, কবিগুরুর নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তিতে বঙ্গসাহিত্যের অনেক পন্ডিতজন কবিগুরুকে আজেবাজে অশালীন মন্তব্য করেছিলেন। কবি জানতেন এবং তিনি শুনেও ছিলেন অশালীন কথনগুলো। তিনি আরও জানতেন, যেসব পন্ডিত, তাঁকে নিয়ে কটূক্তি করেছেন তাঁরাই একদিন, তাঁকে বিশাল প্যান্ডেল বানিয়ে সংবর্ধনা দেবেন, সঙ্গে ঈর্ষণীয় অনেক কিছু। কবি অনেক আগেই স্থির করেছিলেন, সেসব পন্ডিতের দেওয়া সংবর্ধনায় যাবেন ঠিকই কিন্তু তাদের দেওয়া কোনো উপহারসামগ্রী ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে-যেটি কবি রবীন্দ্রনাথই করতে পেরেছিলেন। আর কোথাকার কোন দুই অখ্যাত টাঙ্গাইলের লেখক-কবি সেদিন যা বলেছিলেন কিছু শুনেছিলেম, সেই অশালীন বাক্যগুলো শুধু আমাকেই নয় হয়তোবা অনেককেই এখনো আহত করে। ইতিমধ্যে পৃথিবীতে এসেছে করোনাকাল, গৃহবন্দী হয়ে আমি আপনি হাজার কোটি মানুষের জীবন দুর্বিষহ হতে চলেছে, সেই করোনাভাইরাসে ইতিমধ্যে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন প্রায় ১১ লাখ মানুষ।

গৃহবন্দী অবস্থাতেই সেই স্কুল জীবনের স্বভাব কবি গোবিন্দ চন্দ্র দাসের কবিতাটি পড়তে গিয়ে মনে হলো ‘দিন ফুরিয়ে যায়রে আমার দিন ফুরিয়ে যায়। সাঁঝের রবি ডুবছে মাঝে দিনটা গেলো বৃথা কাজে, আজ করবো না করবো কালি।’

বিচিত্র প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, ‘মৃত্যুকে লোকে চোর বলিয়া নিন্দা করে কিন্তু জীবনও যে চকিতের মধ্যে মৃত্যুকে চুরি করিয়া আপনার বহুবিস্তৃত পরিবারের মধ্যে রাখিয়া দেয়, সে কথার কেহ উল্লেখ করে না।’ আমি এখন প্রায় প্রতিদিনই দিন ফুরিয়ে যায় কবিতাটি পাঠ করি, মাঝে মাঝে ভাবী সেই শিল্পিত অপমানের দিনটির কথা। আরও ভাবী এই তো দেখতে পাচ্ছি সবাই পরিচিত আত্মীয়-অনাত্মীয় একে একে চলে যাচ্ছেন, দিন ফুরিয়ে গিয়েছিল, আমারও যাবে। তার আগে যেন আগামী সালের আমার জন্মদিনটাকে দেখে যেতে পারি।

 লেখক : কবি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর