শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা
স্মরণ

রাজাপুরের রাজর্ষি

ইবনে ওয়াহেদ

রাজাপুরের রাজর্ষি

নোয়াখালী শহরে নারকেলবীথি-শোভিত বিশাল এক জলাশয়। এর উত্তরপাড়ে জেলা প্রশাসকের অফিস ভবন। ভবনটির পশ্চিম-দক্ষিণ দিকে বিরাট মসজিদ। এর পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত জননেতা আবদুল মালেক উকিল। লাখ লাখ শোকার্ত মানুষ অশ্রুসিক্ত চোখে বিদায় দিচ্ছে, তাঁকে শুইয়ে দিচ্ছে কবরে- দৃশ্যটা আজও চোখে ভেসে ওঠে। দেখতে দেখতে পার হয়ে গেছে ৩৩টি বছর।

গুণমুগ্ধরা আবদুল মালেক উকিলকে নানাভাবে আঁকেন। তারা তাঁকে রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কোর কমান্ডারদের একজন/দেশের সংবিধানপ্রণেতাদের অন্যতম/তীক্ষè মেধাসম্পন্ন ব্যবহারজীবী/অকুতোভয় রাজনীতিক/স্বল্প সময়ে জনচিত্ত জয়ে সক্ষম এক নেতা ইত্যাদি বলে অভিহিত করেন। সাধারণ মানুষের মনে তাঁর যে ছবি সেখানে তিনি তাদের প্রিয় ‘উকিল সাহেব’ আর বৃহত্তর নোয়াখালীর সর্বত্র এখনো তাঁর প্রসঙ্গে মানুষ বলে থাকে ‘আংগো উকিল সাব’ (আমাদের উকিল সাহেব)।

আবদুল মালেক উকিল (জন্ম : ১ অক্টোবর, ১৯২৫-মৃত্যু : ১৭ অক্টোবর, ১৯৮৭) সম্পর্কে আমার মতে, হৃদয়ছোঁয়া কথাটি বলেছেন বিখ্যাত সাংবাদিক আসফদ্দৌলা রেজা। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে সহপাঠী ছিলেন মালেক উকিলের। তাঁর স্মৃতিচারণা- ‘ছাত্রাবাসে মালেক ছিল আমার রুমমেট। তাকে আমরা বলতাম “রাজাপুরের রাজর্ষি”। কারণ তার মধ্যে একই সঙ্গে রাজা আর ঋষির গুণাবলি। রাজার কর্তব্য সর্বজনের সমান কল্যাণবর্তী হওয়া; ঋষির বৈশিষ্ট্য বিষয়সম্পত্তির প্রতি নির্মোহ থেকে পুণ্যপথ নির্দেশকরণ। রাজাপুর হলো মালেকের জন্মগ্রাম। এভাবেই সে হয়ে উঠল রাজাপুরের রাজর্ষি।’

‘মালেক তো ধনকুবের পরিবার থেকে আসা নয়। কিন্তু কোনো ছাত্র বিপদে পড়লে যেভাবে পয়সা-কড়ি তার হাতে দিয়ে দিত, ওই স্টাইলটা ছিল রাজকীয়।’ বলেন আসফদ্দৌলা, ‘এমনও হয়েছে দিতে দিতে ওর হাত একদম খালি। তখন ধার-কর্জ করত। ওয়াদা করলে রক্ষা করতই। এসব অভ্যাস তার এখনো (১৯৭৪) আছে।’

গণআন্দোলন সংগঠক আবদুল মালেক উকিল : বেশ কয়েকবার কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি, বঙ্গবন্ধুর ক্যাবিনেটের মন্ত্রী, সংসদে শেখ হাসিনা যখন (১৯৮৬)  বিরোধী দলের নেতা, তিনি তখন উপনেতা। এ ছাড়া তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে বিরোধী দলের নেতা। আর্টস কাউন্সিলের জেলা সভাপতি ছিলেন, জেলা শহরের প্রধান পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বহু বছর। বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা তিনি; মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিদেশে জনমত গড়তে তিনি দেশে দেশে ঘুরতেন। ওই সময় সংসার-সন্তান থেকে ছিলেন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। এসবই জানা কথা। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তাঁর আরেকটি স্বর্ণাভ ভূমিকা অনেকেরই অজানা। ১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলোর সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন প্রাদেশিক পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা আবদুল মালেক উকিল। এ সম্মেলনেই বঙ্গবন্ধু উত্থাপন করেছিলেন বাঙালির মুক্তিসনদ ছয় দফা কর্মসূচি।

মহান এই নেতার বিষয়ে স্বল্পপরিসরে বর্ণনা দান দুরূহ জানি। তবু এ প্রজন্মের উদ্দেশে এ লেখা নিবেদন করছি যাতে তারা প্রণোদিত হতে পারেন। নীতির প্রশ্নে আপসহীন মালেক উকিল তেজস্বী ছিলেন, ছিলেন খুবই মিষ্টভাষী। তাঁর প্রিয়ভাজন ছিলেন অথচ জিয়া-এরশাদ আমলে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা দলে ভিড়েছেন এমন ব্যক্তিদের শাপান্ত করতে তাঁকে দেখা যায়নি। মর্মাহত নেতা শুধু উচ্চারণ করতেন- ‘আল্লাহ হ্যাতারে হেদায়েত করুন।’

রাজনীতিতে যেসব তরুণ তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচর এবং তাঁকে ‘চাচা’ ডাকতেন তাদের প্রসঙ্গে তিনি বলতেন, ‘এরা আমার ঘরের পোলা’। এদের প্রতি তাঁর ছিল পিতৃসুলভ স্নেহ। উচ্চস্তরের আইনজীবী আবদুল মালেক উকিলের কেসপ্রতি ফি ছিল ১১০ টাকা। অ্যাডভোকেট মুস্তাফিজুর রহমান লুতু বলেছেন, ‘স্যার গড়ে রোজ পাঁচটা কেস করতেন। চিন্তা করেন! পাকিস্তান আমলে রোজ ৫৫০ টাকা। ওই টাকা এখনকার ২২ হাজার টাকা। এ আয়ের ৮০ ভাগই তিনি তাঁর দলের নেতা-কর্মীর পেছনে ব্যয় করেছেন। নইলে স্যার ঢাকায় অ্যাটলিস্ট পাঁচটি বাড়ি করতে পারতেন।’

তাঁর মতো দেশহিতব্রতী উদারপ্রাণ নেতার সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকুক, আজ মহান নেতার মৃত্যুদিনে এই হোক বাঙালি জাতির প্রার্থনা।

             লেখক : মুক্তিযোদ্ধা।

 

 

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর