শিরোনাম
শনিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

বিস্মৃতপ্রায় এক জেলা প্রশাসক ও জাদুঘর

সৌরেন চক্রবর্ত্তী

বিস্মৃতপ্রায় এক জেলা প্রশাসক ও জাদুঘর

১৮৬০ সালের ১ আগস্ট চট্টগ্রাম জেলা থেকে পৃথক হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার সৃষ্টি হয়। নবসৃষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান কার্যালয় প্রথমে চন্দ্রঘোনায় এবং পরে ১৮৬৮ সালে রাঙামাটি শহরে স্থানান্তরিত হয়। তদানীন্তন ১৭টি জেলার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের ছিল স্বতন্ত্র সত্তা। বনজ সম্পদে ব্যাপক সমৃদ্ধ তিন মহকুমার (রাঙামাটি, বান্দরবান ও রামগড়) সমন্বয়ে গঠিত এলাকাটির শাসন পদ্ধতিও ছিল সমতল অন্য জেলাগুলো থেকে পৃথক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় এবং প্রশাসনিক প্রয়োজনে পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এ তিন জেলায় বিভক্ত হয়। Captain Magrath ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা রাঙামাটির প্রথম জেলা প্রশাসক। Mr. T H Lewin, Mr. C S Murray, Mr. R H S Hutchinson, Mr. C G B Stevens, Mr. G L Hyde একাধিকবার জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এমনকি একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ পাঁচবারও জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর Mr. L H Niblett নামে একজন ব্রিটিশ কর্মকর্তা অপশন দিয়ে এ দেশে রয়ে যান। তিনি ১৯৪৮-১৯৫০ ও ১৯৫৪-১৯৫৬ সালে দ্বিতীয়বার পার্বত্য চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জেলা প্রশাসক হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় ইরানের সাবেক বাদশাহ রেজা শাহ পাহলভির ভাই, এ দেশে নিযুক্ত ইরানের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত প্রিন্স গোলাম রেজা পাহলভি রাঙামাটিতে বেড়াতে আসেন। জেলা প্রশাসক L H Niblett ১৯৫৬ সালের ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রদূত মহোদয়কে নিয়ে জেলা প্রশাসকের নিজস্ব হাতি ‘লাল বাহাদুরের’ পিঠে চড়ে চন্দ্রঘোনা এলাকায় গভীর জঙ্গলে শিকারে বের হন। তখন একটি বুনো হাতি জঙ্গল থেকে বের হয়ে তাঁদের দিকে এগিয়ে এলে রাষ্ট্রদূত মহোদয় বুনো হাতির মাথা লক্ষ্য করে বন্দুকের গুলি ছোড়েন। গুলিতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে বুনো হাতিটি রক্তাক্ত অবস্থায় গভীর জঙ্গলে চলে যায়। ওই ঘটনায় জেলা প্রশাসকের হাতি লাল বাহাদুর চঞ্চল হয়ে এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকলে রাষ্ট্রদূত, জেলা প্রশাসক এবং মাহুত হাতির পিঠ থেকে মাটিতে পড়ে যান এবং সবাই আহত হন। কিছুক্ষণ পর রাষ্ট্রদূত মহোদয় গুরুতর আহত জেলা প্রশাসকের গোঙানির শব্দ শুনে এগিয়ে গিয়ে দেখেন তাঁর পা ভেঙে গেছে এবং প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে লাল বাহাদুরের পায়ের নিচে পড়ে। মুমূর্ষু অবস্থায় জেলা প্রশাসক তাঁকে বলেন,

Your excellency, I am dying. I have got hundred rupees, please make over it to my daughter. এ কথা বলার কিছুক্ষণের মধ্যেই জেলা প্রশাসক ঘরনষবঃঃ শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। উল্লেখ্য, জেলা প্রশাসকের ‘জুন’ নামে ২৪-২৫ বছর বয়সের একটি কন্যাসন্তান ছিল যিনি তার বাবার সাহচর্য ও আদর পেতেন সবচেয়ে বেশি। ঘটনার পরদিন অর্থাৎ ১২ ডিসেম্ব^র রাষ্ট্রদূত মহোদয় জেলা সদর রাঙামাটিতে এ-সংক্রান্ত ঘটনার জবানবন্দি প্রদান করেন। এ-সংক্রান্ত নথিপত্র জেলা প্রশাসকের বাংলোয় সংরক্ষিত আছে। রাঙামাটিতে জেলা প্রশাসকের বাংলোর অদূরে রিজার্ভমুখ নামক জায়গায় খ্রিস্টান কবরস্থানে

Niblett-কে সমাহিত করা হয়। অন্যদিকে বিশ্বস্ত লাল বাহাদুর হাতিটি প্রিয় প্রভুর অকালপ্রয়াণে অনশন শুরু করে। বিরহকাতর হাতিটি অবশেষে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নেয়।

ছোট্ট টিলার ওপরে অবস্থিত ঝোপঝাড়ে পরিবেষ্টিত সমাধিস্থলটি দীর্ঘদিনের অযত্ন-অবহেলায় বিস্মৃতি ও ধ্বংসের মুখে নিপতিত হচ্ছিল। ২০০৯ সালের মার্চে আমি রাঙামাটির জেলা প্রশাসক পদে যোগদান করি। ইতিহাস-ঐতিহ্য-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে আমার ঝোঁক বরাবরই ছিল এবং আছে। স্থানীয় বর্ষীয়ান পাহাড়ি-বাঙালি মানুষের মুখে শুনতাম L H Niblett দেশভাগের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা রাঙামাটির একজন দক্ষ জেলা প্রশাসক ছিলেন। তিনি মানুষ হিসেবে খুব বড় মনের ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। পেশাগত জীবনের একপর্যায়ে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা ও আমার সহকর্মীদের নিয়ে জেলা প্রশাসকের সমাধিস্থলটি সংস্কার এবং বাংলোয় একটি জাদুঘর স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। সে অনুযায়ী যথারীতি কার্যক্রম শুরু হয়। চট্টগ্রাম থেকে এবং স্থানীয়ভাবে আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র সংগ্রহ করা হয়। প্রয়াত জেলা প্রশাসকের সমাধিস্থলটিসহ টিলার ওপর অবস্থিত সমগ্র কবরস্থানটি সুন্দরভাবে পুনর্র্নির্মাণ ও সংস্কারের মাধ্যমে নবরূপপ্রাপ্ত হয়। লেখা হয় সমাধিস্তম্ভ-লিপি। তাতে লেখা আছে-

Dearly beloved husband of                                                     May Irene Niblett                                                     Born : 10th June, 1894
         Died : 11th December 1956
While doing his duty                                                                         As
Deputy Commissioner
&
 District Magistrate
Chittagong Hill Tracts
Rangamati    

জেলা প্রশাসকের বাংলোর আঙিনায় L H Niblett-এর একটি দৃষ্টিনন্দন আবক্ষ প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়েছে এবং একটি ছোট্ট অথচ সুন্দর জাদুঘর তৈরি করা হয়েছে। যেখানে ব্রিটিশ আমল থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্ব ও উত্তরকালের অনেক জেলা প্রশাসকের ছবি সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করা হয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং পাহাড়ি নিসর্গের অপরূপ লীলাভূমি, দর্শনীয় স্থান এবং জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা। এসব বিষয়ের সঙ্গে সংগতি রেখে জাদুঘরটি সাজানো হয়েছে এবং নাম দেওয়া হয়েছে ‘ডিসি বাংলো জাদুঘর’। সহকর্মীদের ধৈর্য-নিষ্ঠা ও উৎসাহের ফলেই এসব যাবতীয় কাজ স্বচ্ছন্দ গতিতে আমি সম্পন্ন করতে সক্ষম হই।

L H Niblett এ দেশে চাকরি করতে এসে দেশভাগের পর এ দেশের জীবনের সঙ্গে তাঁর চিন্তার ও ভাবনার সম্মিলন ঘটিয়ে এ দেশের মানুষকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন এবং আমৃত্যু সেবা দিয়ে গেছেন। যেসব ব্যক্তি তাঁর কর্ম ও সৃষ্টির দ্বারা সমাজজীবনে ছাপ রেখে গেছেন বা যান পরবর্তী প্রজন্ম তাঁদের ঠিকই স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানায়।

 লেখক : সাবেক সিনিয়র সচিব।

[email protected]

 

 

সর্বশেষ খবর