সোমবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

সীমাহীন বেদনা আর দৈন্যের খবর

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

সীমাহীন বেদনা আর দৈন্যের খবর

ভালো খবর তো কিছু নেই। করোনার শুরু থেকেই শুধুই দুঃসংবাদ শুনতে হচ্ছে। তারপর ইদানীং সামাজিক অপরাধের সীমাহীন বৃদ্ধি, কোনটা রেখে কোনটার কথা বলি। ধর্ষণের মতো চরম মানবতাবিরোধী অপরাধের খবরে মিডিয়া সয়লাব। বাবার কাছে মেয়ে নিরাপদ নয়, শিক্ষকের কাছে ছাত্রী নিরাপদ নয়, মাদ্রাসার মাওলানার কাছেও সে আজ অসহায়। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রে মানুষের আকাক্সক্ষা এবং তার সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে একই তালে মূল্যবোধের শ্রীবৃদ্ধি না ঘটলে যা হয় সেটাই আজ হচ্ছে। দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি অলি-গলিতে ছড়িয়ে পড়ায় তা আজ সর্বগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে।

মানুষের পশুবৃত্তিকে লাগামহীন করার তিন উপাদান- মাসল, মানি আর মাস্টার রাজনীতি হাতে থাকলে যা মন চায় সেটাই করা যায়, পাওয়া যায়। তার সঙ্গে আইন ও বিচার প্রক্রিয়া যদি অকার্যকর হয় তাহলে তো কথাই নেই। গত ১৪ তারিখে সহযোগী পত্রিকায় একজন আইন বিশেষজ্ঞ তথ্য দিয়েছেন, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন মামলায় সাজার শতকরা হার মাত্র ০.৪৫ শতাংশ, প্রায় ৯৯.৫৫ ভাগ অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। একদিনে অথবা হঠাৎ করে মানুষরূপী পশুদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পায়নি। দীর্ঘদিন যাবৎ সবদিকের পুঞ্জীভূত অবক্ষয়ের প্রতিফলন। আগে এ সম্পর্কে কেউ বলেনি লেখেনি তা কিন্তু নয়। তবে যার যা করার ছিল তারা সেটা করেনি বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উল্টোটি করেছে। এরা সমাজে অপরিচিত নয়। তারপরও এদের আমরা ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিয়ে বিপুলভাবে বিজয়ী করি। একাত্তরের গণধর্ষণকারী মতিউর রহমান নিজামী যখন বিপুল ভোটে জয়লাভ করে মন্ত্রী হয় তখন ধর্ষণ থামাবেন কী করে। ধর্ষণকারী পুরস্কৃত হয়, মন্ত্রী-এমপি হয়। সমাজ ও রাষ্ট্র চালায় মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী, বাকিরা বৃহত্তর জনগণ গড্ডলিকা প্রবাহ, চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মানুষ সমাজ থেকে বহু আগেই বিদায় হয়ে গেছে। রাজনীতি, ক্ষমতা আর অর্থের কাছে সবকিছুই অর্থহীন। কাকে দোষারোপ করবেন।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের পথ ধরে পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় আসা দুই সামরিক শাসক ১৫ বছর ধরে রাষ্ট্র ও রাজনীতির যে সর্বনাশ করেছেন সেটি আজ সর্বত্র মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ায় আমরা পথ খুঁজে পাচ্ছি না। একদিকে টান দিলে আরেক দিকে থাকে না। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার সবকিছু ধূলিসাৎ করে যারা বাংলাদেশকে আরেকটি পাকিস্তান বানাতে চায় তারা রাজনীতিতে এখনো বহাল ও অটুট আছে। এই পক্ষ ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্ষণ শুরু হয়। ২০০১ সালের ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের প্রধান ইংরেজি পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় খবর ছাপা হয়, সদ্য ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডার বাহিনীর হাতে এক রাতে ভোলার চরফ্যাশনে ২০০ হিন্দু নারী ধর্ষিত হয়েছে। এর কোনো বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি। তাই সংক্রামক ব্যাধির ভাইরাসের মতো এটি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। সব সামলানোর দায় এখন একজনের, তার নাম শেখ হাসিনা। তিনি যে বঙ্গবন্ধুর কন্যা। বাংলাদেশের মানুষকে ফেলে তিনি তো কোথাও যেতে পারবেন না। অনেকেই তো পগার পাড়ি দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। তিনি আছেন বলে ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে। শেখ হাসিনার ওপর সব বোঝা চাপিয়ে দিয়ে আমরা সবাই নিজেদের ভাগ্য গড়ার কাজে মালকোঁচা দিয়ে নেমে পড়েছি। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অ্যাকাডেমিক সার্কেল ভঙ্গুর ও দুর্বল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ন্যায়পরায়ণতা, নৈতিকতা ও আদর্শ সংবলিত একজন শুদ্ধ মানুষের প্রতীক হবেন, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু কোনো কোনো ভাইস চ্যান্সেলর সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় যা পড়ি ও শুনি তা হজমযোগ্য নয়। সমাজে এমন একজন মনীষী নেই, যার ডাকে বৃহত্তর মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে সব অনাচার-অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়বে। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে ভলতিয়ারের একটি কথা- স্ট্যাম্প আউট অল অ্যাবিউসেস, অর্থাৎ সব নির্যাতন ও নির্যাতনকারীকে উৎখাত কর। লাখ লাখ মানুষ ফ্রান্সের সর্বত্র প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার সূত্র ধরেই ফরাসি বিপ্লব হয়ে যায় ১৭৮৯ সালে। এক সময়ে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে বোকা প্রকৃতির কিছু মানুষ ছিল। তারা নিজের পাওয়ানাটা বুঝত না। দেশ, মানুষ ও সমাজের জন্য রাজনীতি করত, কেউ শক্ত হাতে কলম ধরত, আবার কেউবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে হুঙ্কার ছাড়ত। এই বোকাদের সংখ্যা এখন নেই বললেই চলে। সুতরাং যা হওয়ার তাই হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নতুন তত্ত্বের জন্ম হয়েছে। আর তা হলো ভালো, সৎ, আদর্শবান ও দেশপ্রেমিক মানুষ দিয়ে নাকি কোনো কাজ হয় না। কথাটির বাস্তবতা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সমাজ-রাষ্ট্রের সবকিছু দুর্বৃত্ত আর নষ্টদের দখলে চলে গেছে। সব জায়গায় একই কথা ভাগাভাগি সমানে সমান, দশআনি-ছয়আনি, নাকি বারআনি-চারআনি ভাগাভাগি হবে তাই নিয়ে নিজেদের মধ্যে তারা খুনোখুনি করছে। এই যে দুর্বৃত্ত, এরা দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে শতকরা হিসাবে খুবই কম। কিন্তু এদের আছে মানি আর মাসল, অর্থাৎ বৈধ-অবৈধ অস্ত্র, তার সঙ্গে অপরাজনীতির ছত্রছায়া। এতসব অধঃপতন আর দুঃসংবাদের মধ্যে আরেকটি ছোট সংবাদ মনটাকে আরও ব্যথিত করেছে। কয়েক দিন আগে, ৪ অথবা ৫ অক্টোবর বাংলাদেশের একটি প্রধান দৈনিকের অনলাইন ভার্সনে ছোট করে খবরটি প্রকাশ পায়। তাতে বলা হয়, মহান মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্রগুলো বাংলাদেশ বিক্রি করে দিচ্ছে। পত্রিকার খবর অনুযায়ী ২৬ হাজারের কিছু বেশি অস্ত্র আছে, যার মধ্যে রাইফেলের সংখ্যা বেশি। জার্মান সরকার নাকি এগুলো কিনে নিতে চাইছে। কী রকম দাম হতে পারে তার কিছু খবরে উল্লেখ নেই। কী কারণে বাংলাদেশ বিক্রি করে দিচ্ছে, জার্মানি কেন কিনে নিচ্ছে তার কিছুই খবরে উল্লেখ নেই। বাংলাদেশ কেন বিক্রি করে দিচ্ছে তা জানতে পারলে ভালো হতো। কয়েকটি কারণ অনুমান করা যায়। এক. হতে পারে এগুলো রাখার জায়গা হচ্ছে না। দুই. অযথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তার চেয়ে কিছু টাকা পাওয়া গেলে মন্দ কি। তিন. এই লোহালক্কড় আবর্জনার কী মূল্য আছে। এখান থেকেই কথাটা শুরু করতে চাই। বেশির ভাগ মানুষের কাছে সত্যিই হয়তো এগুলো পুরনো লোহালক্কড় ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু আমাদের মতো কিছু বোকা মানুষের কাছে এর মূল্য অর্থ দিয়ে নির্ধারণ করা যায় না, এগুলো এককথায় অমূল্য। বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের জন্য অমূল্য সম্পদ। দিন যত যাবে ততই এর মূল্য বৃদ্ধি পাবে, যদি যথার্থ সংরক্ষণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। এতদিন অবহেলায় পড়ে থাকার কারণে কিছু মানুষের কাছে এগুলোকে হয়তো আবর্জনা মনে হচ্ছে। আমাদের সর্বোচ্চ গর্ব এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ ও অনুপ্রেরণার জায়গা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। তাই মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত একটা রশির মূল্যও অপরিসীম। একটা অস্ত্র, একটা রাইফেল যথার্থ ক্যাপশনসহ জাদুঘরে থাকলে সেগুলো কত আগ্রহভরে শত বছর পরের প্রজন্ম পড়বে তা কি আমরা ভাবতে পারছি না। হতে পারে একটা অস্ত্রের একটা ক্যাপশনই তৈরি করবে সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় শত হাজার মুক্তিযোদ্ধা। যুবকরা জীবন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত না থাকলে দেশকে রক্ষা করবে কারা? গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের স্মারকচিহ্ন কোনো দেশ বিক্রি করে দেয় ভাবা যায় না, শুনিনি। এ বিষয়ে আমার পড়া শ্রেষ্ঠ একটা বই থেকে কিছু উদ্ধৃতি না দিয়ে পারছি না।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কমলাকান্তের দপ্তর গ্রন্থের ৫৮ পৃষ্ঠায় তৎকালীন বঙ্গদেশের দুর্দশার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, “আমার বঙ্গদেশে সুখের স্মৃতি আছে, নিদর্শন কই? সুখ মনে পড়িল, কিন্তু চাহিব কোন দিকে? আর্য রাজধানীর চিহ্ন কই? আর্যের ইতিহাস কই? জীবনচরিত কই? কীর্তি কই, কীর্তি স্তম্ভ কই? সমরক্ষেত্র কই? সুখ গিয়েছে, সুখ চিহ্নও গিয়েছে, বধূ গিয়াছে, বৃন্দাবনও গিয়েছে, চাহিব কোন দিকে?” একটা জাতির যদি চাহিবার দিক না থাকে তার চেয়ে দৈন্যের খবর আর হতে পারে না। কিন্তু বাঙালি, আমরা তো এখন আর এতিম জাতি নই। একাত্তরের সব স্মারকচিহ্ন আমাদের জন্য অমীয় অফুরন্ত সম্পদ, চিরন্তন অনুপ্রেরণার উৎসস্থল। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত আলোচ্য অস্ত্রগুলো বিক্রির উদ্যোগ যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে এর চেয়ে দৈন্যের খবর আর কিছু হতে পারে না। ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে জেরুজালেম থেকে এএফপি সংবাদ সংস্থা কর্তৃক একটা সংবাদ প্রকাশিত হয়। তাতে জানা যায়, ১৯২২ সালে তখন জাপানে অবস্থানকালে একজন বার্তাবাহকের মাধ্যমে আলবার্ট আইনস্টাইন সে বছর পদার্থ বিদ্যায় নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির খবরটি পান। এমন একটা ভালো খবর বয়ে আনার জন্য বার্তাবাহককে কী দেওয়া যায় ভাবতে গিয়ে হোটেলের একটা প্যাডে জার্মানি ভাষায় আইনস্টাইন দুটি মন্তব্য লিখে দেন। মন্তব্য দুটি বাংলা করলে সেটি হয়তো এমন হবে, ‘অস্থিরতায় পূর্ণ বিরামহীন আকাক্সক্ষার পেছনে ছোটার চেয়ে শান্ত, স্থির ও মধ্যমমানের জীবন মানুষকে অনেক বেশি সুখ ও শান্তি দিতে পারে’। দ্বিতীয়টির অর্থ, ‘ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়’। ৯৫ বছর পর ২০১৭ সালে হ্যামবুর্গ শহরের একজন জার্মান এই লেখাটি প্রকাশ্যে আনেন এবং তা নিলামে দিতে চান। ইসরাইল সরকার সেই কাগজটি লক্ষাধিক ডলারে কিনে নিতে চাইছে। ওই প্যাডে কী লেখা আছে, তারচেয়ে এটা আইনস্টাইনের লেখা, সেটাই অমূল্য। মুক্তিযুদ্ধের স্মারক রক্ষার্থে আমরা কতটুকু কী করতে পেরেছি। খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো একটা সমাধিস্থল হতে পারে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অনুপ্রেরণার স্থল। মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এর চেয়ে বড় কাজ হতো যদি জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সর্বত্র সব সময় রাষ্ট্রীয় সম্মান পেতেন। এটা কি খুবই কঠিন কাজ। হাই কোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্মারকচিহ্নগুলো নির্মাণের কাজ ১০ বছরেও শুরু হলো না।  বিশ্বব্যাপী সব দেশে মিত্রবাহিনীর জন্য বিশিষ্ট স্মৃতিস্তম্ভ আছে। বাংলাদেশে কিছুই হয়নি। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো বিক্রির খবরে আশ্চর্য হইনি।  কেবল দুঃখ পেয়েছি, এই যা।  সীমাহীন দৈন্যের খবর।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

 

সর্বশেষ খবর