মঙ্গলবার, ২০ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতা

এ কে এম শহীদুল হক

ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতা

সম্প্রতি দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণ বেড়ে গেছে। অনেকের মতে ধর্ষণ যেন মহামারীতে রূপ নিয়েছে। ধর্ষকদের গ্রেফতার ও বিচার দাবিতে দেশব্যাপী প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও সমাবেশ হচ্ছে। পুলিশ কঠোর অবস্থানে থেকে আসামিদের গ্রেফতার করছে। তদন্ত চলছে। কেউ কেউ ধর্ষকের ক্রসফায়ারে মৃত্যু দাবি করছে। সিলেটের এম সি কলেজ ক্যাম্পাসে গৃহবধূর ধর্ষণ এবং নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীর ওপর অমানবিক নির্যাতন সবার হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে।

নারীর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণ কেন হয়? কেন এর ঊর্ধ্বগতি? এ নিয়ে বিশিষ্টজনেরা ভিন্ন ভিন্ন মত দিচ্ছেন। নির্যাতন ও ধর্ষণের প্রকোপ হ্রাসের পরামর্শ দিচ্ছেন। ওইসব পরামর্শ মেনে পদক্ষেপ নিলে হয়তো ধর্ষণ ও নির্যাতন কিছুটা কমবে। কিন্তু এ জঘন্য অপরাধ শূন্যের কোঠায় আনা হয়তো কখনো সম্ভব হবে না। বিশ্বের কোনো দেশই তা সম্ভব করতে পারেনি। উন্নত, শিক্ষিত ও সভ্য দেশ হিসেবে পরিচিত দেশেও ধর্ষণ হয়। মুসলিম-অমুসলিম কোনো দেশই ধর্ষণ থেকে মুক্ত নয়। বিশ্বের যেসব দেশে দুর্নীতি একেবারে শূন্যের কোঠায়, সভ্যতার মানদ- অনেক ওপরে, শিক্ষা-দীক্ষা, অর্থনীতি, সামাজিক ন্যায়বিচারে যাদের প্রশংসনীয় অবস্থান আছে সেসব দেশেও ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশের কথা উল্লেখ করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ (Word Population Review) সংস্থার ২০২০ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, সুইজারল্যান্ডে প্রতি ১ লাখ মানুষের মধ্যে ৭৭.৫ জন নারী ধর্ষিত হয়। সুইডেনে এ হার ৬৩.৫, অস্ট্রেলিয়ায় ২৮.৬, বেলজিয়ামে ২৭.৯, যুক্তরাষ্ট্রে ২৭.৩, নিউজিল্যান্ডে ২৫.৮, নরওয়েতে ১৯.২, ফ্রান্সে ১৬.২, ফিনল্যান্ডে ১৫.২, অস্ট্রিয়ায় ১০.৪, জার্মানিতে ৯.৪, নেদারল্যান্ডসে ৯.২। আমরা জানি, ইউরোপের এসব দেশের জনগণ বেশ সভ্য। তারা দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। অথচ ধর্ষণের হার অনেক বেশি। বাংলাদেশে এ হার ৯.৮২। সবচেয়ে বেশি দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেখানে প্রতি ১ লাখ নারীর মধ্যে ১৩২.৪ জন ধর্ষিত হয়। সবচেয়ে কম মিসরে- ০.১০। জাপানে ১.০, নেপালে ০.৮, ভারতে ১.৮। এখন প্রশ্ন হলো, ধর্ষণ কেন হয়। একক কারণ দেখিয়ে এর জবাব দেওয়া যাবে না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে দুর্বল ভাবা ও নারীকে ভোগের সামগ্রী হিসেবে মনে করার যে বিকৃত মানসিকতা আছে তা নারীর প্রতি সহিংসতার একটি অন্যতম কারণ। একজন বিশিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব একবার নারীদের সম্পর্কে তেঁতুল তত্ত্ব দিয়ে বেশ সমালোচনার পাত্র হয়েছিলেন। নারীর ওপর সহিংসতার দায় তিনি প্রকারান্তরে নারীর ওপরই চাপাতে চেষ্টা করেছিলেন। এখানেই সুধীসমাজ ও সচেতন মহলের আপত্তি।

কোনো নারীকে বিশেষ কোনো পরিবেশে দেখে বিকৃত মানসিকতার একজন পুরুষের মাথায় হয়তো কুচিন্তা আসবে। তার পাশবিক লালসা জাগ্রত হতে পারে। পুরুষের এ বিকৃত লালসার শিকার নারী হয়। নারীর প্রতি এ সহিংসতার দায় সমাজ নারীকেই দেবে, তা তো হতে পারে না। নারীর প্রতি এমন অমানবিক ও অবিবেচনাপ্রসূত আচরণ চরম অবমাননাকর, নিষ্ঠুর, বৈষম্যমূলক, অন্যায় ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তাকে জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক, মনুষ্যত্ব, ভালো-মন্দ যাচাইয়ের জন্য মনস্তাত্ত্বিক মানদ- দান করেছেন। তার আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ধর্মীয় অনুশাসন দিয়েছেন। অনুশাসনের বরখেলাপ হলে মহাশাস্তির ব্যবস্থা রেখেছেন। সব ধর্মেই অন্যায় ও অপকর্মের শাস্তির বিধান উল্লেখ আছে। আমরা যদি মনুষ্যত্ববোধ ও বিবেকসম্পন্ন মানুষ হই তবে তেঁতুল দেখলে আমাদের জিবে পানি আসবে কেন? তাহলে মানুষ ও পশুর মধ্যে তফাত কোথায়? তেঁতুল দেখলে জিবে পানি এলে তা সংবরণের জন্যই সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে আল্লাহ মানুষকে তৈরি করেছেন। মানুষ যা পারে, পশু তা পারে না। মানুষ যদি পশুর মতো কাজ করে তবে সে তো পশুই হয়ে যায়। সে তখন মানুষ থাকে না। তার স্থান মনুষ্য সমাজে হওয়া উচিত নয়। সমাজের উচিত তাকে ঘৃণাভরে সমাজবিচ্যুত করা।

মানুষের নীতি-নৈতিকতা, মনুষ্যত্ববোধ, মানবিকতা ও বিবেক যখন লোপ পেয়ে শূন্য লেভেলে পৌঁছে তখন সে অমানুষ হয়ে যায়। এ ধরনের অমানুষরা যে কোনো জঘন্য অপরাধ করতে কোনো কুণ্ঠাবোধ করে না। মানুষরূপী এসব অমানুষ ও নরপিশাচই তাদের যৌনলালসা চরিতার্থ করার জন্য নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে সহিংসতার মাধ্যমে ধর্ষণ করে থাকে।

একজন ধর্ষক তো অবশ্যই কোনো মায়ের সন্তান, কোনো বোনের ভাই, কোনো নারীর স্বামী, হয়তো কোনো মেয়ের বাবা। তার মা-বোন-স্ত্রী-কন্যা যদি কোনো দুর্বৃত্ত কর্তৃক ধর্ষিত হয় তখন তার মনের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তা কি সে ক্ষণিকের জন্যও মনে করে না। এ উপলব্ধি থাকলে সে কখনো ধর্ষণের মতো গর্হিত কর্ম কিছুতেই করতে পারে না। নারী মানে ভোগের সামগ্রী নয়। নারী মায়ের জাতি, ভাইয়ের বোন, কোনো স্বামীর স্ত্রী বা কোনো বাবার মেয়ে- এ কথা সব সময় পুরুষ মনে রাখলে তার দ্বারা কোনো নারী নির্যাতিত হতে পারে না।

অভিযোগ আছে, ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত বা ক্ষমতাধরের ছত্রচ্ছায়ায় যারা থাকে তারা এ ধরনের অপকর্ম করে। এ কথা যদি সত্য ধরি তবে কি বলব ক্ষমতা মানুষকে অমানুষ করে তোলে? ক্ষমতাবানদের কি মা-বোন-স্ত্রী-কন্যা নেই? তাদের কি বিবেক, বিবেচনা ও মনুষ্যত্ববোধ থাকে না? রাজনৈতিক নেতা বা ক্ষমতাধর গুরুরা তাদের কর্মী ও ভক্তদের এসব অপকর্ম করতে কি সায় দেয়? আমি বিশ্বাস করি, তারা হয়তো তাদের কর্মী-সমর্থকদের ধর্ষণ ও জঘন্য অপকর্মে সায় দেয় না। কিন্তু অন্য ধরনের অপকর্ম যেমন- মাস্তানি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, ক্ষমতার অপব্যবহার, মানুষকে ভয়-ভীতির মধ্যে রাখা ইত্যাদি নানাবিধ অপকর্ম ক্ষমতাসীনদের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে এবং দলের নাম ব্যবহার করেই তারা করে। এসব ক্ষেত্রে দলের অনেক নেতাই তাদের তেমন একটা নিয়ন্ত্রণ করে না। এসব সুবিধাবাদী লোক নিজের স্বার্থে তথাকথিত রাজনীতি করে। তারা জনগণের কল্যাণে কাজ খুব কমই করে। তারা নেতার মন পাওয়ার জন্য, তার আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ার জন্য তার নামে স্লোগান দেয়, আগে-পিছে মোটরসাইকেল রাইডার নিয়ে নেতার সফরসঙ্গী হয়, বড় বড় পোস্টার ছাপিয়ে এবং গেট তৈরি করে তাতে নেতার ও নিজের ছবি ছাপায় এবং নেতা এলাকায় গেলে সব সময় তার সঙ্গে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব কাজের জন্য খরচের টাকাও মানুষের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করে আদায় করে। মানুষের মধ্যে এমন একটা ধারণা দেয় যে, সে নেতার খুব ঘনিষ্ঠ। এ প্রক্রিয়ায় সে এলাকায় একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। বাস্তবিক পক্ষেই রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি ও কোনো কোনো স্থানীয় ক্ষমতাবান নেতার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন পেয়ে এসব সুবিধাবাদী লোক আস্তে আস্তে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। অন্যের প্রতি আধিপত্য বিস্তারের প্রবণতা তাদের মধ্যে জন্মে। তখন তারা যে কোনো গর্হিত অপকর্ম করতে কুণ্ঠাবোধ করে না।

সমাজে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ই ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার প্রধান কারণ। সামাজিক সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে কিংবা ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মতো জঘন্য অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি নাগরিকদের নৈতিক মূল্যবোধের উন্নয়ন করতে হবে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে ধর্ষণ ও নির্যাতনকারী তথা অপরাধীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রেহাই পেয়ে যায়। বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন মুলতবি থাকলে বাদী ও সাক্ষীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তারা বারবার আদালতে যেতে অনীহা প্রকাশ করে। অনেক সময় সাক্ষী পাওয়া যায় না বা কিছু কিছু সাক্ষী আর্থিক সুবিধা নিয়ে বৈরী হয়ে যায়। আবার দীর্ঘদিন পর মামলার রায়ে আসামির সাজা হলেও তা জনগণ জানতে পারে না। শাস্তি জনসম্মুখে না আসায় মানুষ মনে করে দেশে বিচারহীনতার কারণে অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। তাই গুরুতর ও স্পর্শকাতর অপরাধগুলোর বিচারকার্য ত্বরিত গতিতে স¤পন্ন করে সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা হলে জনমনে স্বস্তি আসবে এবং অপরাধ হ্রাস পাবে।

একই সঙ্গে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ তথা গোটা সমাজকে এসব অপরাধের বিরুদ্ধ সামাজিক আন্দোলন ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাদের মর্যাদা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রতি পরিবারের সন্তানদের পারিবারিক শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে। শিশু-কিশোরদের নৈতিকতার শিক্ষা ও চর্চার বিষয়টি বাবা-মা ও পরিবারের বয়স্কদের দেখতে হবে। শুধু একাডেমিক ফল ভালো করলে হবে না, সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলতে হবে। তাদের নীতিমান ও আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এ দায়িত্ব পরিবার, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবাইকে নিতে হবে। স্কুল -কলেজের সিলেবাসে নারীর প্রতি সম্মান, নারীর মর্যাদাসহ অন্যান্য সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে শিক্ষা ও গঠনমূলক বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। শিশু বয়স থেকেই শিশুর মননশীলতায় নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ গেঁথে দিতে হবে। এভাবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নিয়ে সমস্যার সমাধানে এগিয়ে যেতে হবে। রাজনীতিবিদরা দেশের ও জনগণের কল্যাণের জন্যই কাজ করেন। দেশের স্বাধীনতা, সার্বিক উন্নয়ন, সংস্কার সবকিছুই রাজনীতিবিদের হাত ধরেই এসেছে। তাদের আছে গৌরবোজ্জ্বল ও ত্যাগের ইতিহাস। কাজেই সমাজ থেকে ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতাসহ অন্যান্য সামাজিক ও জঘন্য অপরাধ দমন ও মূলোৎপাটনের জন্য রাজনীতিবিদদেরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। জনমত ও জনসচেতনতা সৃষ্টিতে রাজনীতিবিদরাই উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারেন।

এ ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার নারীর সঙ্গে পুলিশের সহানুভূতিশীল আচরণ করা একান্ত বাঞ্ছনীয়। ভিকটিমের মানসিক আঘাতের প্রতিক্রিয়া লাঘবের জন্য পুলিশকে এমন সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে ভিকটিম মনে করে পুলিশ তার বন্ধু হিসেবে কাজ করছে। পুলিশের ওপর তার আস্থা ও নির্ভরযোগ্যতার জায়গায় যেন কোনো সংশয় না থাকে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে ত্বরিত কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিলে ভুক্তভোগী ও তার আত্মীয়স্বজন মানসিক শান্তি পাবে। পুলিশের প্রতি তাদের আস্থা সৃষ্টি হবে। এ ধরনের জঘন্য ও সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে জনমত ও জনসচেতনতা তৈরি এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সহায়তা পাওয়ার জন্য পুলিশকে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম চলমান রাখতে হবে এবং তা কার্যকর করতে হবে।

                লেখক : সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ।

সর্বশেষ খবর