বৃহস্পতিবার, ২২ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

নিরাপদ সড়ক : প্রয়োজন আইন প্রয়োগ ও সচেতনতা

মো. আবু নাছের

নিরাপদ সড়ক : প্রয়োজন আইন প্রয়োগ ও সচেতনতা

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি বিশ্বব্যাপী একটি অন্যতম প্রধান সামাজিক, অর্থনৈতিক ও জনস্বাস্থ্যগত সমস্যা। সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্বের সব দেশেই কমবেশি ঘটছে, পাশাপাশি দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার প্রচেষ্টাও চলছে অবিরাম। নিরাপদ সড়কের দাবি যেমন দিন দিন জোরালো হচ্ছে তেমন এ লক্ষ্য অর্জনে সরকারি-বেসরকারি প্রয়াসও হচ্ছে শক্তিশালী। এ বাস্তবতায় দেশে সড়ক নিরাপত্তা তথা নিরাপদ সড়কের অবিরাম প্রচেষ্টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এ প্রত্যাশা আরও জোরদার করেছে। এমন বাস্তবতায় সরকারের আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের পাশাপাশি সড়ক ব্যবহারকারীদের সচেতনতা তৈরির উদ্যোগও দৃশ্যমান। নিরাপদ সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার প্রত্যাশায় ‘মুজিববর্ষের শপথ, সড়ক করব নিরাপদ’ প্রতিপাদ্য নিয়ে চতুর্থবারের মতো দেশে আজ পালিত হচ্ছে নিরাপদ সড়ক দিবস।

আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় আইনগত কাঠামোর সঙ্গে সমন্বয় করে ন্যাশনাল রোড সেইফটি স্ট্র্যাটেজিক অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়ন করছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। ইতিমধ্যে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ কার্যকর হয়েছে। নিরাপদ সড়কবিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটি, সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদ এবং জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ ছাড়া কাউন্সিল অনুমোদিত ১১১টি সুপারিশ বাস্তবায়নে কাজ করছে একটি টাস্কফোর্স। বিভিন্ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন তদারকিতে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে জাতীয় মনিটরিং কমিটি। নিরাপদ সড়ক সরকারের অগ্রাধিকার। এ লক্ষ্য অর্জনে ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন কার্যক্রমের পাশাপাশি আরও কিছু নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী মহাসড়কের পাশে পণ্যবাহী যানবাহন চালকদের জন্য প্রথম পর্যায়ে চারটি সড়ক-বিশ্রামাগার নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। সড়ক-মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি অপসারণের পাশাপাশি দেশব্যাপী বিভিন্ন মহাসড়কে ১২১টি দুর্ঘটনাপ্রবণ স্পটের ঝুঁকি হ্রাস করা হয়েছে। জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে সাইন-সিগন্যাল ও রোড মার্কিং স্থাপন, বাস-বে নির্মাণসহ ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক করিডোর উন্নয়নে নেওয়া হয়েছে বিশেষ উদ্যোগ। সড়ক নির্মাণে গুণগতমান নিশ্চিতের পাশাপাশি অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণে আরও অধিকসংখ্যক ওজন স্কেল স্থাপন করা হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ সড়কমোহনা ঝুঁকিমুক্ত করার কাজও এগিয়ে চলেছে। এর পাশাপাশি সড়কের পাশে যত্রতত্র বাস থামানো বন্ধে পরিকল্পিত বাস স্টপেজ নির্মাণ করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে অপরিকল্পিত গতিরোধক দুর্ঘটনা ঘটায়, তাই ৫৫০টি অপরিকল্পিত গতিরোধক এরই মধ্যে অপসারণ করা হয়েছে। আধুনিক সড়ক ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও চালু করা হয়েছে রোড সেইফটি অডিট। এ পর্যন্ত সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের আওতাধীন প্রায় ৫০০ কিলোমিটার মহাসড়কে রোড সেইফটি অডিট পরিচালনা করা হয়েছে, চলমান রয়েছে আরও ৩০০ কিলোমিটারে।

গবেষণায় দেখা যায়, মহাসড়কের মাঝখানে বিভাজক স্থাপনের ফলে যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়ানো যায়। বিগত এক দশকে প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার মহাসড়ক চার বা তদূর্ধ্ব লেনে উন্নীত করা হয়েছে, ফলে এসব মহাসড়কে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এসেছে।  দুর্ঘটনায় জীবন ও সম্পদের ক্ষতি কমিয়ে আনতে ইতিমধ্যে ২২টি জাতীয় মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি সড়ক নিরাপত্তায় হাইওয়ে পুলিশের জনবল ও সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতকরণে প্রয়োজন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত চালক। এ বাস্তবতা উপলব্ধি করে সরকার পেশাজীবী গাড়িচালকদের প্রশিক্ষণ সুবিধা অব্যাহতভাবে বাড়িয়ে চলেছে। বিগত দুই অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার পেশাজীবী চালককে সড়ক নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পেশাদার নারী গাড়িচালক তৈরির সুযোগ ছাড়াও মোটর ড্রাইভিং স্কুলের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে মোটরযানের ফিটনেস প্রদানের পাশাপাশি গাড়িচালকদের লাইসেন্স, যানবাহন রেজিস্ট্রেশনে স্মার্টকার্ড ও নম্বরফলকে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। সেবা সহজীকরণের অংশ হিসেবে বিআরটিএর বিভিন্ন পরিবহন সেবা অনলাইনে দেওয়া হচ্ছে। ঘরে বসে ও ভোগান্তি ছাড়া সেবা গ্রহণ করছে সেবাগ্রহীতারা। মহাসড়কে যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে এবং ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের অননুমোদিত বাম্পার অপসারণ করা হয়েছে।

সড়ক নিরাপত্তায় পথচারী তথা সড়ক ব্যবহারকারীদের সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাফিক আইন মেনে চলার পাশাপাশি যানবাহন চালানো অবস্থায় সিটবেল্ট বাঁধা ও চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোন ব্যবহার বন্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে জনগণকে সচেতন করতে নেওয়া হয়েছে বিশেষ কর্মসূচি। বাধ্যতামূলক করা হয়েছে মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীর জন্য হেলমেট ব্যবহার। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সড়ক-মহাসড়কে নছিমন, করিমন, ভটভটিসহ নন-মোটরাইজড যানবাহন চালনা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সচেতনতা তৈরির অংশ হিসেবে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাক-প্রাথমিক থেকে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতকরণে প্রকৌশলগত ত্রুটি অপসারণের পাশাপাশি আইনের বাস্তবায়ন এবং সড়ক ব্যবহারকারীদের সচেতনতা- এ তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এ বাস্তবতায় জনসচেতনতা তৈরিতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহ সমন্বিতভাবে কাজ করছে। একক কোনো কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা নয়, সড়ক নিরাপদ করতে সব অংশীজন ও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগসমূহের কার্যকর সমন্বয় জরুরি। নিজে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি অন্যকে সচেতন করা এবং ট্রাফিক আইন মেনে চলার মধ্য দিয়ে পূরণ হতে পারে নিরাপদ সড়কের প্রত্যাশা। নিশ্চিত হতে পারে সড়ক নিরাপত্তা।

লেখক : উপপ্রধান তথ্য অফিসার সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।

সর্বশেষ খবর