শুক্রবার, ২৩ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনার সঙ্গে সহাবস্থান

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

করোনার সঙ্গে সহাবস্থান

করোনার মতিগতি বুঝতে ও যুঝতে মেঘে মেঘে বেলা তো কম হলো না। ‘শেষ হয়েও হলো না বা হচ্ছে না’র পর্যায়ে যাওয়ার আগেই বাঁ-হাতি স্পিনারের মতো বিভ্রান্তিকর বল ছুড়ছেই করোনা, হাতেও উইকেট বেশি নেই, এখনো কত ওভারের খেলা বাকি বোঝা যাচ্ছে না ‘নো বল’ আর ওয়াইডের ছড়াছড়িতে। গত শীতে যিনি বলেছিলেন এপ্রিলে গরম শুরু হলে করোনা কৈলাসে ফিরে যাবেন, সেপ্টেম্বের-অক্টোবরে এসে করোনা তাকেও ছুঁতে ছাড়ল না, নভেম্বরের নির্বাচনে তানার ‘কী জানি কী হয়’ অবস্থা। এবারের অক্টোবরে নোবেল প্রাইজ পাওয়ার সুযোগ পেলেন না ভ্যাকসিন আবিষ্কারকমন্ডলীরা। ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলেই করোনা পালানোর পথ পাবে না- এমন ধন্য আশা কুহকিনীর কূলকিনারা মিলছে না। সামনে শীতকাল, ইতিমধ্যে ইথারে চাউর হচ্ছে করোনার কোয়ার্টার ফাইনালের পর্দা উঠবে। এ অবস্থায় করোনাকে মোকাবিলার নতুন ছক আঁকার বিকল্প দেখা যাচ্ছে না। ভেবেচিন্তে দেখতে হবে, করোনা যখন থাকবেই আর বেশ কিছুকাল তাহলে তার সঙ্গে সহাবস্থানের একটা সমঝোতায় যাওয়া যুক্তিযুক্ত হবে বলে মনে করছেন অনেকে।

যেমন জাপান সরকার সম্প্রতি করোনার সঙ্গে সহাবস্থানের সিদ্ধান্ত নিয়ে ‘জীবনযাপনের নয়া নীতি’ মডেল ঘোষণা করে জাপানি জনগণকে নতুন মডেল অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছে। এ মডেল নীতিমালা জাপান করোনার মতিগতি, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, সংস্কৃতি এমনকি রাজনৈতিক অর্থনীতিতে তার প্রভাব প্রতিক্রিয়া এবং ঝুঁকি পর্যালোচনা করেই তৈরি করেছে। বিশ্বব্যাপী এটা এখন উপলব্ধির উপলব্ধিতে পরিণত হয়েছে যে, বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি চাল চালার জন্য করোনার উদ্ভব ও বিকাশ। এর সঙ্গে ভূরাজনীতি, বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থাপনায় মোড়লির হাতবদল, পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংসের সূক্ষ্ম সুতা টানাটানি জড়িত। সুতরাং করোনা সহজে নির্মূল হওয়ার নয়। অতীতের অন্যান্য মহামারীর চেয়ে করোনার প্রকাশ্য পার্থক্য হলো, এটি যতটা না প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্ট তার চেয়ে বেশি এটি ভেদবুদ্ধিপ্রসূত বৈজ্ঞানিক গবেষণা সৃষ্ট, এর উদ্দেশ্য রাজনৈতিক অর্থনীতির রেজিলিয়েন্ট পাওয়ারসহ মানুষের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক শক্তি-সামর্থ্য ধ্বংসকারী এবং অতীতের তুলনায় বর্তমানে মানুষের মবিলিটি মাইগ্রেশন সুযোগ বেশি হওয়ায় মানুষেরই ভিতরে ভাইরাসবাহী করোনা দ্রুত ছড়িয়েছে বিশ্বব্যাপী। সুতরাং করোনাকে সহসা সহজ ভাবার সুযোগ নেই।

করোনার সঙ্গে সহাবস্থানকল্পে ‘জীবনযাপনের জাপানি নয়া নীতি’ নির্দেশনাগুলো অবশ্যপালনীয় ও অনুসরণীয় এবং আটপৌরে জীবন ও অভ্যাস-সংস্কৃতির সঙ্গে স্থিতিশীল হওয়ার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। নীতিমালার শুরুতেই তিনটি বিষয় বা অভ্যাসকে মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসেবে বিবেচনার জন্য বলা হয়েছে- সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক ব্যবহার এবং ঘন ঘন হাত ধোয়া। এরপর কয়েকটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা- ১. সামাজিক দূরত্ব ২ মিটার বা সাড়ে ৬ ফুট বা প্রায় ৫ হাত, ২. নিয়মকানুন মেনেই ঘরের বাইরে যেতে হবে, ৩. কারও সঙ্গে সরাসরি বা সামনাসামনি কথা বলা এড়িয়ে চলতে হবে, ৪. বাইরে থেকে ঘরে ফিরেই হাতমুখ ধোয়া ও পরনের কাপড় পাল্টাতে হবে, ৫. কারও হাত স্পর্শ করলে সঙ্গে সঙ্গে হাত ধুতে হবে ৬. অনলাইনে বাজার ও ইলেকট্রনিক পেমেন্টের চেষ্টা করতে হবে, ৭. সুপার মার্কেটে একজন করে করে বাজার সওদা করা ভালো, মার্কেটে যে সময় লোকজন কম থাকে সে সময় যাওয়া চাই; ৮. কোনো নমুনাসামগ্রী না ছোঁয়া, ৯. পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চড়ার সময় কোনো কথা না বলা, ১০. যদ্দুর সম্ভব সাইকেলে চড়ে কিংবা হেঁটে কাজে যাবেন, ১১. সভা-সেমিনার-সম্মেলন অনলাইনে অংশগ্রহণ করা, ১২. সভায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা সীমিতকরণ, সবার মাস্ক পরা নিশ্চিত হওয়া এবং আলো-বাতাসের জন্য জানালা খোলা রাখা; ১৩. বাসায় বসে কাজ করা কিংবা অফ পিক পিরিয়ডে অফিসে যাওয়া, ১৪. যেসব দেশে বা স্থানে এখনো মহামারী বিরাজ করছে সেখানে ভ্রমণ না করা. ১৫. আত্মীয়ের বাসায় আসা-যাওয়া এড়িয়ে চলা, ১৬ যখনই রোগের লক্ষণ টের পাওয়া যাবে তখনই ভাবতে হবে কোথায় গিয়েছিলেন, কার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেছিল; ১৭. কারও সামনাসামনি না হয়ে পাশাপাশি বসে খাবার খাওয়া, ১৮. একটা বড় পাত্রে একসঙ্গে অনেকের খাবার না রেখে ভাগ ভাগ করে রেখে খাওয়া, ১৯. খাওয়ার সময় কথা কম, শাকসবজি বেশি খাওয়া; ২০. খাওয়ার সময় বেশি লোক একসঙ্গে নয়, ২১. বদ্ধ ঘর বা জায়গা, বেশি ভিড়ভাট্টা এবং কারও সঙ্গে অন্তরঙ্গ মেলামেশা পরিহার, ২২. নিজের সুস্থতা যাচাইয়ের জন্য প্রতিদিন সকালে নিজের তাপমাত্রা মাপা, ২৩. টয়লেট ফ্লাশ করার সময় ঢাকনা বন্ধ রাখা, ২৪. কোনো সংকীর্ণ জায়গায় বেশিক্ষণ না দাঁড়ানো, ২৫. হাঁটা বা দৌড়ানোর সময় বেশি লোক একসঙ্গে নয়। কারও সঙ্গে সাক্ষাতের সময় যথাযথ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।

জাপান সরকারের করোনাবিষয়ক জাতীয় কমিটির প্রধান শিগেরু ওও সংবাদকর্মীদের বলেছেন, এ তালিকা সাংকেতিক, এর বিস্তারিত সরকারি তথ্য বিবরণীতে পাওয়া যাবে। করোনা বিদায় হতে মনে হচ্ছে আরও বছর দেড়েক লাগবে তাই তার সঙ্গে সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করা সমীচীন। প্রত্যেকের উচিত নিজের ও সবার স্বার্থে এ নীতি অনুসরণ করা।

করোনার সঙ্গে সহাবস্থান অবলম্বনের জন্য বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট পরিবেশে আর যা যা করণীয়-

এক. মানসিক শান্তি ও শক্তি, সামাজিক সংহতি, সহানুভূতি সমানুভূতির সুরক্ষা দেশে বিদেশে করোনা নিয়ন্ত্রণ ও নিরাময় ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা ও ক্ষয়ক্ষতির বেহাল চিত্র দেখে আস্থাহীনতায় বাংলাদেশে আতঙ্ক, আশঙ্কা বেড়েই চলেছে; যা মানসিক অশান্তির উপসর্গ। অথচ মানসিক শান্তি বা মনের বল করোনার মতো ভয়াবহ মহামারী মোকাবিলার প্রাণশক্তি। আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে, কঠিন বাস্তবতায় করোনা মোকাবিলায় গৃহীত ব্যবস্থার স্বচ্ছতায় ও আন্তরিকতায় সবাইকে শামিল করতে পারলে গৃহীত সব পদক্ষেপে বিচ্যুতির পরিবর্তে সবাইকে অন্তর্ভুক্তিকরণের মাধ্যমে আস্থা ও জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠবে। দেখতে হবে ঐকমত্যের ঐশ্বর্য মতানৈক্যের মাশুল দিতে দিতে যেন শেষ না হয়।

প্রাচীনকাল থেকেই দেশ-কাল-পাত্রভেদে মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে আসছে। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন করতে সবার ভালোর জন্য জোরেশোরেই শুরু হলেও ‘সামাজিক দূরত্ব’ তৈরির কর্মসূচি কার্যকর হয়নি। মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী মহামারী নিয়ন্ত্রণে, মানুষকে উদ্ধারে সামাজিক সংহতির ভূমিকাই অগ্রগণ্য। এখানে সবাইকে সচেতন করে তুলতে হবে। বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতিতে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি ও সামাজিক বন্ধনরীতি যেখানে সুদৃঢ় সেখানে করোনা মোকাবিলায় আক্রান্তের সেবা-শুশ্রুষায় চিকিৎসাকর্মীর সমানুভূতি, পারিবারিক নৈকট্য, সামাজিক সহানুভূতি বিশেষ টনিক হিসেবে কাজ করবে।

দুই. অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ অভ্যন্তরীণ বাজার চাঙ্গা রাখতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। স্বাস্থ্য ও জীবিকা পরস্পরের হাত ধরে চলে। তাই করোনা মহামারী থেকে জনগণকে রক্ষায় স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ছোট-বড় ম্যানুফ্যাকচারিং, আমদানি-রপ্তানি, ব্যবসা বিপণন, কৃষি (খাদ্য, সবজি, মাছ, মাংস) উৎপাদন, পরিবহন, পর্যটন, সেবা ও আর্থিক খাতে পর্যায়ক্রমে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ উদ্যোক্তাদের করোনার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ যথাযথভাবে ডিজভার্স নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলাবিধান, সুশাসন কার্যকর ও নীতি-নৈতিকতার অধিষ্ঠান জোরদার করা।

করোনাকালে আমাদের বোধোদয় হচ্ছে সামনের দিনগুলোর নিয়ন্তা হবে ভার্চুয়াল যোগাযোগ সংস্কৃতি। ডিজিটাল প্রযুক্তি কর্মসূচিতে বাংলাদেশ সময়ের চেয়েও এগিয়ে আছে, এটি একটি বড় প্লাস পয়েন্ট। এ অবকাঠামোতেই বাংলাদেশের তরুণ উদ্যোক্তা উদ্ভাবক দেশে ও বিদেশে ভার্চুয়াল অর্থনীতিতে সফলতার সঙ্গে সংযুক্ত করতে মনোযোগ প্রয়োজন হবে। সরকারি খাতের চেয়ে বেসরকারি খাতে (বিশেষ করে ব্যক্তি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প/কর্ম উদ্যোগে) বিনিয়োগের পাল্লা ভারী করতে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ নীতিমালায় সংস্কার ও নতুন নতুন পথপন্থার সমাবেশ ঘটানো এখনই জরুরি। বেসরকারি বিনিয়োগই কর্মসৃজন, ভোক্তা সৃষ্টি ও পোষণ, পণ্য ও সেবা উৎপাদনের হাতিয়ার। ব্যাংক ঋণ প্রবাহ সরাসরি ক্ষুদ্র মাঝারিদের কাছে যাতে বিনা মাশুলে যাওয়া-আসা করতে পারে, বেল আউট-ইনসেনটিভ-প্রণোদনা সুযোগ-সুবিধা শুধু বড়রা বা মধ্যস্বত্বভোগীরা হাতিয়ে না নিতে পারে তার বিধান বা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

জাতীয় বাজেট বাস্তবায়ন ও প্রাক্কলন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছানোর প্রয়াস, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং এসডিজি বাস্তবায়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের বিদ্যমান সময়সূচি ও মানদন্ড করোনার প্রভাব পর্যালোচনার আলোকে পুনর্নির্ধারণ করা যেতে পারে।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব এবং এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর