শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

বরেন্দ্রে মাল্টা মতির কমলা চমক

শাইখ সিরাজ

বরেন্দ্রে মাল্টা মতির কমলা চমক

অক্টোবরের মাঝামাঝি। বেশ উজ্জ্বল রোদের সকাল। চলেছি বরেন্দ্রের পথ ধরে, মহানন্দার তীর ঘেঁষে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়ক ধরে। মাঠের পর মাঠ সবুজ শ্স্যের খেত। উঁচুনিচু জমিতে যেন কেউ বিছিয়ে রেখেছে সবুজ কার্পেট। শ্রতের এ সময়টায় খেতে খেতে আমনের ফসল। আবার কোনো কোনো খেত ভরে আছে আগাম রবিশ্স্যে, নানান ফল-ফসলে। বছর বিশেক আগেও এমন সবুজ ছিল না বরেন্দ্র। বরেন্দ্র মানেই ছিল খাঁখাঁ বিরান ভূমি, অনুর্বর শ্ক্ত মাটি, ফসলহীন মাঠ। অথচ ইতিহাস বলে, ‘বরেন্দ্র’ নামটি এসেছে ‘ইন্দ্রের বরপ্রাপ্ত ভূমি’ থেকে। অনেক অনেক আগে এ অঞ্চলটি ছিল উর্বর, ফল-ফসলে সমৃদ্ধ। কিন্তু কালক্রমে অযতেœ বহুকর্ষণে বরেন্দ্রের মাটি তার জৈবগুণ হারিয়ে ফেলে। মাটি শুষ্ক হয়ে যাওয়ার আরও একটি কারণ ছিল ফারাক্কা বাঁধ। কেবল একটি ফসল ফলাতে পারত এ অঞ্চলের মানুষ। আমনের ফসল ছাড়া আর কোনো ফলন ছিল না। আমও তখন এখনকার মতো অর্থকরী ফসল হয়ে ওঠেনি। ফলে অনাহার আর অভাব এ অঞ্চলের মানুষকে গ্রাস করে ফেলে। সেই আশির দশ্ক থেকে এ অঞ্চলের কৃষি ও কৃষকের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। প্রতিবেদন তৈরির কাজে বহুবার বরেন্দ্র অঞ্চলে এসেছি। এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী খাবার কলাইয়ের রুটির স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। মনে আছে, মাটির জৈবগুণ ফিরিয়ে আনতে ডালজাতীয় ফসল ফলানোর পরামর্শ দেওয়া হলো। কারণ ডালজাতীয় গাছের শিকড়ে নুডল থাকে যা নাইট্রোজেন ফিকসেশ্নের মাধ্যমে মাটিতে জৈব উপাদান যোগ করে। ফলে এ অঞ্চল হয়ে ওঠে ডালজাতীয় শ্স্যের ভান্ডার। কিন্তু পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাওয়ায় সেচ সুবিধাহীন মাটির এ অঞ্চল ফসল বৈচিত্র্য না থাকায় অভাব যাচ্ছিল না। মনে আছে, ২০০৪ সালে সামার টমেটো চাষের উদ্যোগের মাধ্যমে কৃষি উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালানো হয়। সেচ সমস্যা সমাধানের জন্য বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ পানি সংরক্ষণ, সমবায়ভিত্তিক পানি ব্যবহার, প্রিপেইড সেচব্যবস্থা চালু করেও কূলকিনারা করে উঠতে পারছিল না। ভাবা হতো, বরেন্দ্রে ফসল হয় না। বরেন্দ্রভূমির গাছ মারা যায়। বারিড পাইপ ইরিগেশ্নের মাধ্যমে বৃহত্তর বরেন্দ্র অঞ্চলে বহুমুখী বরেন্দ্র প্রকল্প কাজ শুরু করে। বরেন্দ্র অঞ্চলে সমতল ভূমি না থাকায় প্রচলিত নালার মাধ্যমে সেচ সম্প্রসারণ সম্ভব ছিল না, ফলে মাটির নিচ দিয়ে পাইপ বসিয়ে বিভিন্ন প্রান্তে আউটলেটের মাধ্যমে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। মনে আছে, আশির দশ্কের প্রথম দিকে টাঙ্গাইলের সখীপুর, ঘাটাইল, বাসাইল, সাগরদীঘি, গারো বাজার প্রভৃতি অঞ্চলের ভূমিরূপও একই রকম হওয়ায় এ অঞ্চলগুলোয় প্রথম জার্মানি সংস্থা জিটিজেড বারিড পাইপ ইরিগেশ্ন চালু করে। ব্যয়বহুল এ সেচ ব্যবস্থাপনা পুরো বরেন্দ্র অঞ্চলেও সম্প্রসারণ করা হয়। সরকারি-অসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্টায় বরেন্দ্রের রূপ পাল্টে গেলেও এখনো অনেক অঞ্চল আছে, কৃষক পানি না পাওয়ায় এখনো কৃষিকাজ ব্যাহত হচ্ছে। মনে আছে, ২০০৪ সালে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে, ২০০৫ সালে তানোরে, ২০০৬ সালে নওগাঁর পোরশায় দেখেছি পানির অভাবে সেচ দিতে পারেনি কৃষক। মাঠের পর মাঠ ফসল পানি না পেয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। খাবার পানির সংকটও দেখা দিয়েছে কোথাও কোথাও। সারা গ্রামের মধ্যে একটা পুকুরের তলদেশে হয়তো সামান্য পানি জমে আছে। তাই ভরসা। এমন রুক্ষ বরেন্দ্র! যাই হোক, সময় পাল্টেছে। আধুনিক প্রযুক্তি, উচ্চমূল্যের ফল-ফসল চাষের মাধ্যমে এ অঞ্চলের কৃষক বদলে নিয়েছে তাদের ভাগ্য। বরেন্দ্র এখন অনেকটাই সুজলা-সুফলা, ক্ষেত্রবিশেষ কৃষিতে অনেক বেশি সম্ভাবনাময়।

যাই হোক, মাঝ অক্টোবরের এ রোদ্রোজ্জ্বল সকালে এসে পৌঁছেছি চাঁপাইনবাবগঞ্জের জামতাড়া গ্রামে মতিউর রহমানের বাগানে। বছর দুয়েক আগেও একবার এসেছিলাম এখানে। মতিউর রহমান বিভিন্ন ফল-ফসলের মিশ্র বাগান গড়ে সাড়া ফেলেছেন। মাল্টা চাষ করে সাফল্য পাওয়ায় তিনি পরিচিতি পান মাল্টা মতিউর হিসেবে। শুধু মাল্টা নয়, পেয়ারা চাষ করেও পেয়েছেন অসাধারণ সাফল্য। তবে এবার এসেছি তার নতুন সাফল্য দেখতে। ১৬ বিঘার সমন্বিত কৃষি খামারের চাষ করেছেন তিন জাতের কমলা। একসময় আমরা জানতাম কমলার চাষ হয় পাহাড়ি জমিতে। কিন্তু নতুন জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে ফল-ফসলের ভৌগোলিক সীমারেখার সঙ্গে সঙ্গে এখন আর ঋতুভিত্তিক বাঁধাধরাও আর নেই। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, গত বছর ঝিনাইদহের মহেশ্পুরের কৃষক রফিকুলের কমলাবাগানের তথ্য তুলে ধরেছিলাম। মতিউরের বাগানে আগেরবার দেখেছিলাম গাছভর্তি মাল্টা। তখন কমলা গাছগুলো সবে রোপণ করা হয়েছিল। বলে রাখি, মতিউর বাংলাদেশ সরকারের সড়ক ও জনপথ বিভাগের একজন গাড়িচালক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এখনো সে পেশায় যুক্ত আছেন। ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন কৃষি উদ্যোগ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে যুক্ত হন কৃষির সঙ্গে। বলা যায় কৃষিই এনে দেয় তার অর্থনৈতিক সচ্ছলতা।

মতিউরের বাগানে প্রবেশ করতেই মন ভরে যায় গাছভর্তি হলুদ মাল্টা আর কমলার ঝাড় দেখে। সকালের উজ্জ্বল রোদে চকচক করে ওঠে হলুদাভ সবুজ কমলা ও মাল্টার ঝাড়। এ দৃশ্যের সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। মতিউর আগে চাষ করেছিলেন বারি-১ জাতের মাল্টা। এখন এর সঙ্গে যুক্ত করেছেন অস্ট্রেলিয়ান জাতের মাল্টা। আকারে বড় ও রঙে উজ্জ্বল হলুদ মাল্টাগুলো মনকাড়া। বাগানে হাঁটতে হাঁটতে কথা হয় মতিউরের সঙ্গে। বয়স পঞ্চাশ-পঞ্চান্নের কোঠায়। কিন্তু সাফল্য যেন বয়সকে হার মানিয়েছে, এক অন্যরকম তারুণ্য তার ভিতর। উচ্ছল কণ্ঠে বলে চলেন তার স্বপ্নের কথা- ‘স্যার, শুরু করেছিলাম ৭ বিঘা জমি লিজ নিয়ে। গতবার যখন এসেছিলেন ছিল ৬১ বিঘায় ফল-ফসলের চাষ। এখন করছি ৭০ বিঘায়। আল্লায় দিলে ভালো ফলন পাচ্ছি স্যার। স্বপ্ন আমার চাষ আরও বাড়ানোর। নিজের জমি হয়েছে ১৫ বিঘা। ‘নিশ্চয়ই স্বপ্নের পথে অনেকখানি এগিয়ে যাবেন মতিউর। সাড়ে পাঁচ শ কমলা গাছের প্রতিটিতে ফল ঝুলে আছে। রঙিন কমলা মানেই রঙিন টাকার স্বপ্ন। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কমলা-মাল্টা আমদানি হয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার ১৭০ টন। প্রতি টন ৯৩ হাজার টাকা হিসেবে এর মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ৮৮ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে কমলা-মাল্টা আমদানি হয়েছিল ১ লাখ ২ হাজার ১০০ টন। অর্থাৎ প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার কমলার চাহিদা রয়েছে আমাদের দেশের বাজারেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাহাড়ের মাটির সঙ্গে বরেন্দ্রের মাটির বৈশিষ্ট্যগত মিল আছে। ফলে এ মাটিতে সাইট্রাস জাতীয় ফলের চাষ ভালো হবে। তার প্রমাণ মতিউরের বাগান। একটা পাকা কমলা গাছ থেকে ছিঁড়ে স্বাদ নিয়ে দেখি, ভারি মিষ্টি! মতিউরের চেষ্টা শ্তভাগ অর্গানিক ফল-ফসল চাষের। বাগানে তাই জৈববালাই দমনের নানা ব্যবস্থাপনা। কালার চার্ট, সেক্স ফেরোমেন্ট ট্র্যাপ সবই আছে। কিন্তু সমস্যার সমাধান হচ্ছে না বলে জানালেন মতিউর। ব্যাগিং করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কমলা থেকে কেমন আয় হবে জানতে চাই মতিউরের কাছে। খুব আশাবাদী মতিউর। জানালেন এ বছর কম হলেও ৪ লাখ টাকার কমলা বিক্রি করা সম্ভব হবে। তবে সামনের বছর হবে তার মূল লাভ। কমলাবাগানে কাজ করছিলেন ছয়জন সাঁওতাল নারী। কথা বলি তাদের সঙ্গেও। এ বাগানে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে এতেই তারা খুশি।

মতিউর শুধু কমলা চাষই নয়, তৈরি করেছেন উন্নত জাতের কমলার চারা। গড়ে তুলেছেন ফল-ফসলের চারা বিক্রির নার্সারিও। সেখান থেকেও ভালো আয় আসে তার।

ব্যক্তিজীবনেও বেশ সফল মতিউর। এক ছেলে এক মেয়ে তার। ছেলের নাম নাহিদ, কম্পিউটার প্রকৌশ্ল বিদ্যায় শিক্ষা নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জে কৃষি যন্ত্রপাতির পসরা খুলেছেন। মেয়েটির নাম মিতু। জগন্নাথ বিশ্বিদ্যালয় থেকে সম্প্রতি পরিসংখ্যান বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করেছেন। বাবাকে দেখে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কৃষি উদ্যোক্তা হওয়ার। স্বপ্নও তার কৃষিকে ঘিরেই।

কৃষিই পাল্টে দিয়েছে মতিউরের জীবন। চাকরির ফাঁকে অবসর সময়টাকে তিনি ভরে তুলেছেন ফলে ফসলে। শুধু যে নিজেই সমৃদ্ধ হয়েছেন তা নয়, সমৃদ্ধ করেছেন অন্যদের। তার বাগান ও নার্সারিতে কর্মসংস্থান হয়েছে অনেকের। বরেন্দ্রের জমিতে সোনার ফসল ফলিয়ে অনুপ্রাণিত করেছেন অন্য কৃষককে। তার এ কৃষি উদ্যোগের জন্য পেয়েছেন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে নানা সম্মাননা। সেরা কৃষক ক্যাটাগরিতে পেয়েছেন ‘স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড চ্যানেল আই কৃষি পদক’।

দেশে উদ্যোগী ও শৌখিন কৃষকের হাত দিয়ে পাল্টে যাচ্ছে ফল-ফসলের বৈচিত্র্য। বাণিজ্যিক সম্ভাবনা সামনে রেখে কৃষক, তরুণ উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়িক উদ্যোক্তাদের হাত দিয়ে বদলে যাচ্ছে বরেন্দ্রের কৃষি। মাটি আর ফল-ফসলকে ভালোবেসে তারা কৃষির বহুমুখী সাফল্যের নজির গড়ছেন। পেয়ারা, বারোমাসি আম, ড্রাগন, মাল্টার পর শুরু হয়েছে কমলা উৎপাদন। পাহাড়ি মাটিতে জন্মানো কমলা এখন সমতলে চাষ করছেন চাষিরা। বরেন্দ্র অঞ্চলের মাটিতে কমলার দারুণ উৎপাদন জানান দিচ্ছে অপার সম্ভাবনার কথা। আমি বিশ্বাস করি, মতিউরের মতো উদ্যোগী কৃষকের হাত ধরেই ফলের আমদানিনির্ভরতা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব। বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে বহুদূর।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।  

[email protected]

সর্বশেষ খবর