শনিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

সোনালি আঁশের স্বপ্ন

ভাস্কর রাসা

সোনালি আঁশ (পাট) বাংলাদেশের অন্যতম মূল্যবান অর্থকরী ফসল। আমাদের বাংলাদেশের মতো এত ভালোমানের পাট পৃথিবীর আর কোথাও জন্মায় না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর একাধিক জ্বালাময়ী ভাষণে উল্লেখ করেছেন, আমাদের পাটসম্পদ থেকে আয় করা বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের প্রাপ্য, তা থেকে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা আমাদের বঞ্চিত করছে। লড়াই করে আমাদের অধিকার আদায় করে নিতে হবে। স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বেশি আগুন লাগে পাটের গুদামগুলোতে। কারণ, পাটকে ধ্বংস করে দিতে পারলে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে ব্যর্থ হবে। বঙ্গবন্ধু সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতেই পরিকল্পিতভাবে স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি চক্র এ কাজটি করেছিল। পাটকলগুলোকে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে বিভিন্ন চক্রান্ত তখন থেকে চলছে। যেসব পাটকল স্বাধীনতার আগে লাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল, স্বাধীনতার পরই সে পাটকলগুলো কেন অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো এর কারণ ও প্রতিকার বিষয়ে কখনো কোনো জোরালো পদক্ষেপ কোনো সরকারের আমলে গ্রহণ করা হয়নি। বরং এসব প্রতিষ্ঠানকে আরও লোকসানের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে মাথাভারী প্রশাসনের ব্যবস্থা করা হলো। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পাটকল আদমজী বন্ধ করে দেওয়া হলো। সরকারিভাবে বলা হলো, অব্যাহত লোকসানের জন্য আদমজী বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। কেমন অদ্ভুত ব্যাপার যে, মাথা ব্যথা হলে কি মাথা কেটে ফেলতে হয়, নাকি মাথা ব্যথার চিকিৎসা করতে হয়? আদমজী বন্ধের কারণে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হলো। আদমজী বন্ধের প্রতিবাদে পাটকল শ্রমিকদের বাঘা বাঘা নেতার  ভূমিকা জোরালো ছিল না। বিলের বড় মাছটা মারা গেছে, এখন ছোট মাছগুলোকে মারা সহজ হবে। আদমজী বন্ধের পর যা রইল সরকারের হাতে তাদের অবস্থাও দিন দিন রুগ্ন থেকে রুগ্নতর হতে লাগল। অবশেষে সরকারি সব পাটকল বন্ধ ঘোষণা করল বর্তমান সরকার। সরকারি এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাজপথে প্রতিবাদ করেছে পাটকল শ্রমিক সংগঠন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। তারা বলেছে যে টাকা খরচ করে পাটকল বন্ধ করতে হবে, সে টাকা দিয়ে পাটকলগুলোকে আধুনিকায়ন করা যায় অনায়াসে। এমনকি ১৪-দলীয় অনেক শ্রিক দলও এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ১৪-দলীয় জোট তাদের নির্বাচনী ইশ্তেহারের কথাও উল্লেখ করেছে। পাটকলগুলোকে মাথাভারী প্রশাসনের হাত থেকে মুক্ত করে অভিজ্ঞ পাটকল শ্রমিকদের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কিংবা সমবায়ের মাধ্যমে চালু করা যেতে পারে। যেখানে ৫০ ভাগ মালিকানা সরকারের থাকবে, ২৫ ভাগ থাকবে অভিজ্ঞ শ্রমিকদের আর ২৫ ভাগ থাকবে ব্যবসায়ীদের। সেই সঙ্গে প্রতিটি কলের পরিচালনা পরিষদে উল্লিখিতদের থাকবে শ্রমিক প্রতিনিধি এবং প্রতিটি পাটকল স্বাধীনভাবে পণ্য  কেনাবেচা করতে পারবে আরও ১০টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মতো। আজকের পৃথিবীতে পাটের বহুমাত্রিক ব্যবহার দেখা দিয়েছে। পাটের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। পাটের জিনোম আবিষ্কার করেছেন একজন মেধাবী বাঙালি বিজ্ঞানী শামসুল আলম। আমাদের পাট নিয়ে বহু ষড়যন্ত্র হচ্ছে দেশি-বিদেশি চক্রের দ্বারা। বেশ কয়েক বছর আগে একটি আলোকচিত্র প্রতিষ্ঠান ঢাকায় পাটের একটি আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। সে প্রদর্শনীর কয়েকটি ভেন্যু ছিল, এর একটি ভেন্যু ছিল পুরাতন ঢাকার শাঁখারিবাজারে। সে অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকজন বিদেশি বক্তাও ছিলেন। সেখানে বাংলাদেশের একজন স্বঘোষিত পাটতন্তু বিশেষজ্ঞ (একসময় যিনি বাম তাত্ত্বিক ছিলেন পরে উগ্র ও কট্টর ধর্মীয় গোষ্ঠীর তাত্ত্বিক নেতা হয়েছেন) বলছিলেন, ব্রিটিশ্রা এ দেশে এসে পাট আবিষ্কার করেছে। অথচ ইতিহাস হচ্ছে বেনিয়ারা অনেকে এ দেশে এসে পাটসম্পদকে লুণ্ঠন করেছে। আমাদের কৃষককে নীল চাষে বাধ্য করেছে এবং অনেক অত্যাচার করেছে। আমাদের পাটের প্যাটার্নবন্ড রাইট দাবি করতে বহুভাবে বেনিয়া ব্রিটিশ্রা আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের সুকৌশ্লে ব্যবহার ও ষড়যন্ত্র করেছে। আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে পাটবস্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। মধ্যযুগে মহর আলীর পাটের শাড়ি, হাজার বুটিক পাটের শাড়ি, সৈয়দ হকের নূরুলদীনের সারাজীবনে আগুন পাটের শাড়ির উল্লেখ পাওয়া যায়। শীতপ্রধান দেশ্সমূহে পাটবস্ত্রের চাহিদা আছে, কারণ পাট তাপ ধরে রাখে। পাটখড়ি থেকে বিজ্ঞানী কুদরাত-এ-খুদা পারটেক্স আবিষ্কার করেছেন। পাটের জীবনচক্র আবিষ্কারকে কাজে লগিয়ে আরও উন্নত পাট উৎপাদন করা সম্ভব। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার মাধ্যমে পাটশিল্পের হারানো অর্থনৈতিক ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। তাই সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ করা হবে সোনালি আঁশের সম্ভাবনার মুখে ছিপি এঁটে দেওয়া।

বাংলাদেশের কৃতীসন্তান বিশ্খ্যাত স্থপতি, স্থাপত্যশিল্পের দিকপাল, নলাকৃত স্থাপত্যের জনক এফ আর খান। তাঁর এক সাক্ষাৎকার পাঠ করেছিলাম প্রায় ৩০ বছর আগে। সেখানে তিনি বলেছেন, তাঁকে একবার কোনো এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে প্রশ্ন করা হয়েছিল, নলাকৃত স্থাপত্যের ধারণা তিনি কোথা থেকে পেলেন? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, ছোটবেলায় সম্ভবত নানাবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলেন তাঁরা সপরিবার। সে সময় একদিন প্রবল ঝড় ও বৃষ্টি হয়েছিল, গ্রামের অনেক বাড়িঘর মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, কিন্তু রান্নাঘরের পাশে যে কয়েক আঁটি পাটখড়ির ওপরের অংশ বাঁধা ছিল আর গোড়ার অংশ গোল করে ছড়ানো ছিল ঝড়ে সেই পাটখড়ির আঁটিগুলোর কিছুই হয়নি আগের মতোই দাঁড়িয়ে ছিল। সেই কিশোর বয়সে দেখা দৃশ্যটি পরবর্তীতে নলাকৃত স্থাপত্যের সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিল। বিশ্খ্যাত এই স্থপতির কোনো সৃষ্টিকর্ম আমাদের দেশে নেই। কয়েক বছর আগে জেনেছিলাম গুলশানের কোনো বাড়ির নকশা ও স্থাপত্য তাঁর সৃষ্টি, দুর্ভাগ্যবশ্ত সেই বাড়িটি আমি খোঁজ করে পাইনি। ব্রিটিশ আমলে পাটের আঁশের ব্যবসা এমন পর্যায়ে বিস্তার লাভ করেছিল যে, নারায়ণগঞ্জের নাম পাল্টে ডাকা হতো প্রাচ্যের ডান্ডি। সুদূর স্কটল্যান্ডে ডান্ডি বন্দর ছিল বিশ্বের পাটপণ্য বাজারজাতকরণের মূল কেন্দ্র। সেখানে পাটের ব্যবসায়ীদের বলা হতো দ্য জুট ব্যারেন্স। মধ্যযুগের ইতিহাসবিদ আবুল ফজল রচিত আইনি-ই-আকবরিতে (১৫৪২-১৬০৫) পাটপণ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। চীন দেশের হান রাজবংশের সময় ২০৬-২২০ খ্রিস্টপূর্ব পাট দ্বারা তৈরি বিভিন্ন পণ্যের ব্যবহারের উল্লেখ আছে। সর্বোপরি বলতে চাই- বন্ধ পাটকলগুলো চালু করতে হবে সময়োপযোগী প্রযুক্তি ব্যবহার করে। আর মাথাভারী ব্যবস্থাপনা বাদ দিতে হবে।

লেখক : ভাস্কর্য শিল্পী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর