সোমবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২০ ০০:০০ টা

দুর্গাপূজার আধ্যাত্মিক ভাবনা

ফনিন্দ্র সরকার

দুর্গাপূজার আধ্যাত্মিক ভাবনা

সনাতন হিন্দু ধর্মে দুর্গাপূজা একটি বড় উৎসব। আবহমান বাংলার উৎসব ঐতিহ্য লালন করে দুর্গাপূজা হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে ভক্তহৃদয়ে আধ্যাত্মিক স্পন্দন সৃষ্টির পাশাপাশি অনুভূত হয় সীমাহীন আনন্দ ও উন্মাদনা। পৌরাণিক কাহিনির আলোকে দুর্গাপূজার নানা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ রয়েছে। কীভাবে বৈদিক যুগ থেকে এ পূজার প্রচলন, এর লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা থাকলেও কালের প্রবাহে বাঙালির ধর্মাচার ও সংস্কৃতিতে জায়গা করে নিয়েছে দুর্গাপূজা। আধ্যাত্মিক দিক থেকে এটি একটি ধর্মীয় শ্রেণির আরাধনার অনুষঙ্গ হলেও উৎসব হয়ে উঠেছে সার্বজনীন। দুর্গাপূজা হচ্ছে একটি মহাশক্তির পূজা। আসলে অদৃশ্য মহাশক্তির দৃশ্যমান রূপবৈচিত্র্যে দেবী দুর্গা বিভাসিতা। ‘শক্তি, শব্দটি ব্যাকরণগত দিক থেকে স্ত্রীবাচক শব্দ।

তাই দেবী দুর্গা শক্তিরই দৃশ্যমান মূর্তি। পৃথিবীতে এ শক্তি অনাদিকালের। পৃথিবী নামক এ গ্রহটিই শক্তির অনুষঙ্গ। সে দিক থেকে পৃথিবীটাই একটি দেবী। সে দেবীর পূজাটা হয়ে থাকে নারী মূর্তির মাধ্যমকে কেন্দ্র করে। দুর্গা, যাকে দুঃখ বোধ থেকে জানার সুযোগ হয়। কিংবা যিনি দুর্গা অর্থাৎ মহাসংকট থেকে মুক্ত করেন। দৈত্যনাশ সূচক পাপ, তাপ, রোগ, ভয় থেকে মুক্ত করেন দেবী দুর্গা। তিনি দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে লীলাবিলাসে মর্ত্যে করেন অবগাহন- এ জন্য তিনি দুর্গাত নাশিনী দুর্গা। দেবী দুর্গার অনেক নাম রয়েছে। কিন্তু দেবী দুর্গা নামে এই মানসলোকে একচ্ছত্র প্রভাব বিদ্যমান। ত্রেতা যুগে রামচন্দ্র রাবণ বধের জন্য দেবী আরাধনায় মত্ত হয়ে দুর্গাপূজা করেন শরৎকালে তাই শারোদোৎসব নামে পরিচিত। অকালে পূজা হয় বিধায় অকালবোধনও বলা হয়। আবার রাবণ বসন্তকালে দুর্গাপূজা করেছিলেন বলে একে বাসন্তী পূজাও বলা হয়। দার্শনিক তত্ত্বে দেবী মাহাত্ম্য অনেক গভীর এবং ব্যাপক।

এর আধ্যাত্মিক ভাবটি ধর্মীয় বিভিন্ন স্তম্ভে বর্ণিত আছে। ব্রহ্মা ও দেবগণ দেবীকে স্তব করছেন। বিশ্বেশ্বরী স্তুতি, নারায়ণী স্তুতি ইত্যাদিতে এর স্বরূপ বর্ণিত হয়েছে। তাছাড়া বেদের দেবী সুক্তে এ তত্ত্বের বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে। চন্ডীতে দেখা যায় দেবী নিত্যা, জগন্মূর্তি, সর্বব্যাপী, কার্যসিদ্ধির জন্য আবির্ভূতা। দেবী মহামায়া, এ জগতে মানবজাতি তাঁর মোহাগর্ভে পতিত হয় আবার তিনি সবার মুক্তির জন্য প্রসন্না হন। পাপীদের ঘরে দেবী অলক্ষ্মী, পুণ্যাত্মাদের গৃহে তিনি লক্ষ্মী। এ এক সমষ্টিরূপিণী মহাশক্তি। তিনি চিৎ শক্তি রূপে নিখিল জগদ্বাসীর মনের মন্দির অবস্থান করেন। তিনি এ বিশ্বের আদি কারণ। মহাপ্রলয়ের তিনি ভয়ঙ্কর ইশারা। এ জগতে যত নারী তা তাঁরই ভিন্ন ভিন্ন রূপ।

দুর্গাপূজা এবার অনেকটা নিরাভরণ পরিবেশে পালিত হচ্ছে। অদৃশ্য মহামারী করোনাকালের দুর্গাপূজায় ছিল না কোনো বাহ্যিক আড়ম্বর আয়োজন। তবে ভক্ত হৃদয়ে ভক্তির নির্যাসে ভরে উঠেছিল মায়ের পূজা। তাতে মহানন্দের সামান্যতম ঘাটতি হয়নি। বেদান্তে বলা হয়েছে, প্রত্যেক জীবেরই ছয়টি শত্রু রয়েছে তার মানবসত্তার অভ্যন্তরে। এগুলো হচ্ছে কাম, ক্রোধ, লোভ অর্থাৎ ভোগেচ্ছা, মোহ মানে ভ্রান্তি, মদ অর্থাৎ গর্ব ও দম্ভ। মাৎসর্য অর্থাৎ ঈর্ষা বা হিংসা। এগুলো ষড় রিপু বা ছয়টি শত্রু বলা হয়। কেবল মানুষ এগুলোকে আয়ত্তে রাখতে পারে আধ্যাত্মিক শক্তির সাহায্যে। সে শক্তি দায়িনী দেবী দুর্গা। সুতরাং উক্ত রিপু দমনে এবারের অনাড়ম্বর দেবী বন্দনা মানব সমাজে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। ভক্তরা ভাবগম্ভীর মাধুর্যে আচ্ছন্ন থেকেছেন। ব্যাপক আলোকসজ্জা, যান্ত্রিক যুগের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হয়েছে পূজামন্ডপ। দেবীর ঐশ্বর্যময় আলোকে উদ্ভাসিত হয়েছে মন্দির প্রাঙ্গণ। এবার মহাশক্তি দেবী দুর্গার দাস হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। এ প্রসঙ্গে একটি ছোট গল্প বলে শেষ করতে চাই। প্রায় পাঁচশত বছর আগে ভারতের কর্ণাটক প্রদেশের এক কৃপণ মণিমুক্তা ব্যবসায়ী ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি পুরন্দর দাস নামে পরিচিত হন। ইনি কাউকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতেন না। একদা দিব্যস্পর্শে সেই লোকটি একেবারে পাল্টে গেল। সে তার চারপাশের লোকদের ডেকে, তার সমস্ত সঞ্চিত সম্পদ ও অলঙ্কারাদি বিতরণ করে দিল এবং ছোট্ট একটি পুঁটলি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল দাসের মতো, ঈশ্বরের দাস, মানুষের দাসের মতো, আনন্দের সঙ্গে দার্শনিক ও আধ্যাত্মিকভাবে পূর্ণদিব্য সংগীত করতে করতে মানবজাতিকে জাগাবার জন্য। সেই পুরন্দর দাস এখনো মানুষের মনে প্রেরণা জাগায়। তার কী ঘটেছিল? সে নিজের অন্তরে এক বহুমূল্য মুক্তার সন্ধান পেয়েছিলেন। সংসারের ধনসম্পদ তার কাছে অর্থহীন হয়ে গিয়েছিল। সংসারের বিত্তবৈভব যে কিছুই নয়, এ বার্তাটি তিনি সব রকম মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। কাজেই মহাশক্তি দেবীর পূজায় আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জিত হোক সব মানবের অন্তর্লোকে। তবেই করোনা দুর্যোগে মানবসভ্যতা সুস্থ ও সুস্থির হয়ে উঠবে।  সবাইকে বিজয়াদশমীর শুভেচ্ছা।

              [email protected]

সর্বশেষ খবর