সোমবার, ২ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

আত্মহত্যা ভয়ঙ্কর কবিরা গুনাহ

মুফতি রুহুল আমীন কাসেমী

আত্মহত্যা ভয়ঙ্কর কবিরা গুনাহ

মহান রাব্বুল আলামীন মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে এবং সীমিত হায়াত দিয়ে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন, শুধু তাঁর ইবাদতের জন্য। দুনিয়াকে আখেরাতের সর্বোচ্চ সুখ ও শান্তিময় জান্নাত অর্জন করার ক্ষেত্র বানিয়েছেন। অস্থায়ী এই পৃথিবীতে প্রতিটি মানবজীবন সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহর হুকুম ও নবীর তরিকায় চলা একজন মুমিন ব্যক্তির জন্য দুনিয়ার সর্বসুখ অর্জন করা প্রায় দুরূহ ব্যাপার। প্রতিটি ব্যক্তির সুখ-শান্তির তকদিরী লিখন, কেবল আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়। নবীজি বলেন, দুনিয়াটা মুমিনের জন্য জেলখানা ও কাফিরের জন্য বেহেশতখানা। আল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে বেঁচে গেল এবং জান্নাতে প্রবেশ করল, সেই ব্যক্তি সর্বোচ্চ সফলকাম। দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জিন্দেগির কষ্ট মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু আখেরাতের চিরস্থায়ী জিন্দেগিতে জাহান্নামের কঠিন শাস্তি মেনে নেওয়া যায় না। মান অভিমান, বিরহ বিচ্ছেদ, প্রেম ভালোবাসায় টানাপড়েন ও সাংসারিক অভাব-অনটনের কষ্টে জর্জরিত বা কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে, অনেকের জীবন অতিষ্ঠ ও বিষময় হয়ে যায়। পরিশেষে চিরমুক্তির আশায় নিকৃষ্ট-কষ্টকর আত্মহত্যা ও আত্মহননের মতো ভয়ঙ্কর কবিরা গুনাহর পথ বেছে নেয়। যা একজন অবিবেচক, কা-জ্ঞানহীন পরাজিত ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব। আল্লাহ এবং তাঁর রসুল ও ফেরেশতাদের লানত এবং তার নিকটাত্মীয়, পরিচিতদের ধিক্কার নিয়ে চিরবিদায় হয়। আল্লাহ বলেন, তোমরা নিজেদের হত্যা কর না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ওপর দয়ালু। আর যে ব্যক্তি বাড়াবাড়ি ও জুলুমের মাধ্যমে এ কাজ করবে, আমি তাকে আগুনে পুড়াব। আর এ কাজ আল্লাহর পক্ষে সহজ। (সূরা আন নিসা) প্রিয় নবী (সা.) ইরশাদ করেন, তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের মধ্যে এক ব্যক্তি আহত হয়ে কষ্ট পাচ্ছিল, অতঃপর সে ব্যক্তি ব্যথা সহ্য করতে না পেরে একখানা ছুরি দ্বারা নিজের দেহে আঘাত করল এবং অতিরিক্ত রক্তপাত হয়ে সে ব্যক্তি মারা গেল। আল্লাহ ওহির মাধ্যমে আমাকে জানালেন, ‘আমার বান্দা আমাকে ডিঙিয়ে নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমি তার জন্য আমার জান্নাত হারাম করে দিলাম।’ (সহি বুখারি ও মুসলিম) অপর হাদিসে, রসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোনো লোহার অস্ত্র দিয়ে নিজেকে হত্যা করবে, সে জাহান্নামের আগুনে বসে অনন্তকাল ধরে সেই অস্ত্র দিয়েই নিজেকে আঘাত করে করে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করতে থাকবে। আর যে ব্যক্তি বিষপানে আত্মহত্যা করবে, সেও জাহান্নামের মধ্যে বসে অনন্তকাল ধরে বিষপান করে করে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করতে থাকবে। আর যে ব্যক্তি উঁচু পাহাড়ের ওপর থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামের মধ্যে আগুনের উঁচু পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে পড়ে অনন্তকাল মৃত্যু কষ্ট ভোগ করতে থাকবে। কিন্তু সেথায় আর কোনো দিন মৃত্যু হবে না। (সহি বুখারি ও মুসলিম) এমনিভাবে যে ব্যক্তি আগুনে পুড়ে, পানিতে ডুবে, ফাঁসিতে ঝুলে, চলন্ত রেলগাড়ির নিচে ঝাঁপ দিয়ে, হাইভোল্টেজ বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে ও ঘুমের ওষুধসহ যে কোনো জিনিস দিয়ে নিজে আত্মহত্যা করবে। জাহান্নামের আগুনে সেভাবেই অনন্তকাল সেই মৃত্যু যন্ত্রণার কষ্ট ভোগ করতে থাকবে। তবুও তাঁর মৃত্যু হবে না। অপর হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, এক ব্যক্তি নিজের ক্ষতস্থানের যন্ত্রণা সইতে না পেরে নিজের তরবারি দিয়ে আত্মহত্যা করে, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা শুনে বললেন, সে ব্যক্তি জাহান্নামি। সম্প্রতি পত্রিকার খবরে দেখা যাচ্ছে, পরিবারের পক্ষ থেকে ছেলেমেয়ের অসম প্রেম ভালোবাসা মেনে না নেওয়ায় যুগলবন্দীর আত্মহত্যা। অভাব-অনটনের সংসারে স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্য ও ভুল বোঝাবুঝির জেরে সন্তানকে হত্যাসহ নিজে আত্মহত্যা। চক্রহারে সুদ বৃদ্ধির কারণে ঋণের বোঝা ভারী হয়ে যাওয়ায় আত্মহত্যা। ধর্ষিত নারী বিচার না পেয়ে সামাজিক কলঙ্কের ছাপ মুছে ফেলতে আত্মহত্যা, মা-বাবার সঙ্গে মান অভিমান করে, অতি আবেগী কিশোর-কিশোরীর আত্মহত্যা। পরীক্ষায় ফেল করে ও বেকারত্বের গ্লানি সইতে না পেরে আত্মহত্যা করা যেন আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। যেন এর বিকল্প অন্য কোনো পথ নেই এবং এতেই সর্বোৎকৃষ্ট প্রতিশোধ ও সমাধান। আবেগকে প্রশ্রয় দিয়ে, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে, ইবলিশ শয়তানের প্ররোচনায় আত্মহত্যা করা কাপুরুষিত বোকামি কাজ, পরাজিত ব্যক্তির পৃষ্ঠপ্রদর্শনের নামান্তর। নিজের জীবন শেষ করে দিয়ে কোনো সমাধান হতে পারে না। এতে ব্যক্তি ও পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মা-বাবার মানসম্মান নষ্ট হয়। নিজের ইহকাল ও পরকাল সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে যায়। তার মানবজন্ম অনর্থক হয়ে যায়। সুতরাং এমন জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে, নীরবে ঠান্ডা মাথায় নিজেকে নিয়ে ভাবুন। নিজেকে মূল্যায়ন করুন। নিজেকে ভালোবাসুন। নিজের সন্তান, মা-বাবা ও ভাইবোনের কথা একবার ভাবুন। সুন্দর এই পৃথিবীতে নিজের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে বদ্ধপরিকর হোন। নিজের একান্ত বন্ধু, মা-বাবা, আত্মীয়, গুরুজন ও ধার্মিক জ্ঞানী ব্যক্তিদের শরণাপন্ন হন। আত্মহত্যার মতো জঘন্য পথ বর্জন করুন। সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাধান খুঁজে বের করুন। সবার সহযোগিতা ও পরামর্শে সামনে এগিয়ে চলুন। নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলুন। দেখবেন, একদিন নিজেই নিজেকে বোকা ভাববেন এবং তিরস্কার করবেন। বস্তুত, আল্লাহর দেওয়া প্রাণ ও আয়ুষ্কাল একটি মস্ত বড় নিয়ামত এবং আখেরাতের জন্য অনেক কাজ করার মহামূল্যবান সীমিত অবকাশ। একে যারা স্বহস্তে খতম করে, তাদের ওপর আল্লাহর ক্রোধ পতিত হওয়া অবশ্যম্ভাবী এবং তার দুনিয়া ও আখেরাত বরবাদ হয়ে যায়।

আল্লাহ আমাদের এই ভয়াবহ পরিণতি থেকে হেফাজত করুন।

লেখক : খতিব, কাওলার বাজার জামে মসজিদ দক্ষিণখান, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর